2020 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লির দাঙ্গা এক দিক থেকে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। যেভাবে নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করে কয়েক দিন ধরে একটি সম্প্রদায়কে টার্গেট করে ওই সময়ে দিল্লিতে আক্রমণ করা হয়েছে, তার নজির ভারতের ইতিহাসে বিরল নয়। যেমন 1984 সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর শিখ নিধন। কিন্তু ঘটনার পর তার তদন্তের নাম করে যেভাবে ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর, এবং পরিকল্পিতভাবে পুলিশ ও প্রশাসন নিরন্তর পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে তাদের উপর – তার নজির স্বাধীন ভারতে বিরল। এর একমাত্র তুলনা টানা যেতে পারে 2002 সালে গুজরাটে গোধরা কাণ্ডের পর মুসলিমদের উপর পীড়নের সঙ্গে। কিন্তু নানা ধরনের দমনমূলক আইনের প্রয়োগ এবং সরকার-বিরোধী সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার যে প্রচেষ্টা দিল্লিতে এখন দেখা যাচ্ছে, তা 2002 সালের গুজরাটেও ছিল না। এই নজিরবিহীন রাষ্ট্রীয় পীড়নের ফলেই একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটছে – দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে বেসরকারি তথ্যানুসন্ধানী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের এক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। প্রাক্তন বিচারপতি মদন বি লোকুর, দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং ল কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ পি শাহ, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব জি কে পিল্লাই সহ ছাড়া আরও তিনজন আছেন এই তথ্যানুসন্ধানী কমিটিতে।
‘কন্সটিটিউশনাল কন্ডাক্ট গ্রুপ’ এই কমিটি গঠন করেছে। এই গ্রুপে বহু প্রাক্তন আমলা, সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার, শিক্ষাবিদ প্রমুখ আছেন। এঁদের কোনও ঘোষিত রাজনৈতিক আনুগত্য নেই। সংবিধান অনুসারে দেশের শাসন পরিচালিত হোক – এটাই তাঁদের একমাত্র দাবি। দিল্লি পুলিশের কর্মপদ্ধতি ও তদন্ত নিয়ে গুরুতর ভুলভ্রান্তি, পক্ষপাতদুষ্টতা এবং একদেশদর্শিতার যে সমস্ত অভিযোগ উঠেছে, তারই তদন্ত করবে এই কমিটি। দাঙ্গার চার্জশিট সম্পর্কে অরুন্ধতী রায় লিখছেন, এই হাজার পাতার চার্জশিটে একটা ছবি আছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে একটা টেবিলকে ঘিরে কয়েকজন বসে আছে- হ্যাঁ! একটা ঘরে, অফিসের বেসমেন্টে, দেখলেই বুঝতে পারবেন যে, তারা ষড়যন্ত্র করছেন। তাদের দিকে তাক করা অভিযোগের তীরচিহ্ন, তাদের চিহ্নিত করছে, তাদের নাম বলে দিচ্ছে!
দিল্লি দাঙ্গার পর সাত মাস অতিক্রান্ত। ইতিমধ্যে ছাত্রছাত্রী, গবেষক, আইনজীবী, সমাজকর্মী এবং অনেক সাধারণ মানুষকে বিনা অথবা মামুলি প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অনেক বিশিষ্টদের নাম নানা অছিলায় চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকজন বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে বারবার এফআইআর করার দাবি ওঠা সত্ত্বেও তা খারিজ হয়ে গেছে। বিভিন্ন মহল থেকে তাঁদের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। দাঙ্গা চলাকালীনই গত 26 ফেব্রুয়ারি দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরলিধর এবং তালবন্ত সিং পুলিশকে ‘বিবেকসম্পন্ন সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার নির্দেশ দেন এবং তাদের বিষাক্ত বক্তব্যের জন্য এই নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার নির্দেশ দেন। সেই সময় চারজন নেতার বক্তব্যের ভিডিও আদালতে দেখানো হয় এবং বিচারক সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতাকে তিরস্কার করেন এবং একই সঙ্গে এদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে বলেন। পুলিশ বলে তাঁরা এইসব ভিডিও দেখেইনি। আমরা ইতিমধ্যেই জানি যে, বিচারপতি মুরলিধর তড়িঘড়ি বদলি হয়ে যান এবং যিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তিনি নিদান দেন যে, এফআইআর জারি করার সঠিক সময় এখনও আসেনি। মানুষ এখনও সেই সঠিক সময়ের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে!
আরও পড়ুন: মিথ্যা ও কুৎসার যে আখ্যান ব্লুমসবেরি ছাপল না
শাসক দলের নেতাদের ঘৃণা-প্রচারের ভিডিও দিল্লি পুলিশ দেখেই উঠতে পারেনি, এমনকি তাঁদের কাউকে জেরা পর্যন্ত করেনি। কিন্তু সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের উজ্জ্বল নেতানেত্রী এবং সংখ্যালঘু মানুষদের ধরপাকড় করতে এবং তাঁদের ওপর তুচ্ছ কারণে দানবীয় ইউএপিএ ধারা চাপিয়ে দিতে তাদের সক্রিয়তা ইতিমধ্যেই প্রবাদপ্রতিম। এর পাশাপাশি সাতটি ভিডিও পাওয়া গেছে, যাতে দেখা যাচ্ছে পুলিশ দাঙ্গাকারীদের মদত দিচ্ছে। এমনকি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণও করছে। একটি ভিডিও যেটি ইতিমধ্যে বহুল প্রচারিত, তাতে দেখা যাচ্ছে পুলিশ কয়েকটি যুবককে বেধড়ক প্রহার করছে এবং তাঁদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করছে। এই নৃশংস কান্ডে ফয়জান নামে 24 বছরের যুবক মারা যান। এখনও ধারাবাহিক পুলিশি পীড়নের শিকার হয়ে চলেছেন বেশ কয়েকজন।
উমর খালিদ – বিদেশ মন্ত্রকের আগেও জানতেন ট্রাম্পের ভারত সফরের কথা!
তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ নাকি দশ লক্ষ পাতার, অথচ জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনে যে বক্তব্য রাখা হয়েছিল (অভিযোগ বিজেপি নেতার ওই বক্তব্যের পর দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে) সিসিটিভি ফুটেজে সেই অংশটুকু রহস্যজনক ভাবে গায়েব! অরুন্ধতী রায় মন্তব্য করছেন যে, “এই একই সরকার ঘোষণা করে যে দশ লক্ষ শ্রমিক, যারা কয়েক শত, কিছু ক্ষেত্রে কয়েক হাজার কিলোমিটার হেঁটে নিজের গ্রামে ফিরেছিল, তাদের সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই। সরকারের কোনও ধারণা নেই যে কতজন মারা গেছেন, অনাহারে থেকেছেন, কতজন অসুস্থ হয়ে গেছেন।“ উমর খালিদের ফোন থেকে নাকি 40 জিবি ডেটা পাওয়া গেছে। যদিও এটা পরিষ্কার নয় এটা দাঙ্গা সংক্রান্ত কিনা? একজন সাব-ইন্সপেক্টারের চরের খবর অনুসারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতে আগমনের সময় আন্তর্জাতিক স্তরে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য উমর আরও কয়েকজনের সঙ্গে দাঙ্গার পরিকল্পনা করেছিলেন। (আউটলুক পত্রিকা,17.09.20)। ট্রাম্পের আগমন নিয়ে পুলিশের বয়ানে বিস্তর ফাঁক আছে। তারা বলছে উমর, ভূতপূর্ব আপ কাউন্সিলার তাহির হুসেন, এবং ‘ইউনাইটেড এগেন্সট হেট’ সংস্থার খালিদ সাইফি 8 জানুয়ারি শাহিনবাগে একটি গোপন সভা করে। উদ্দেশ্য ছিল ট্রাম্প যখন ভারতে আসবেন তখন একটা বড় গণ্ডগোল সৃষ্টি করা। ওই সভায় সাইফি নাকি বলেন পয়সাকড়ি, ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, পিএফআই (পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া) সব করে দেবে। ঘটনা হচ্ছে মিডিয়াতে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ভারত আগমনের কথা 13 জানুয়ারি হিন্দু পত্রিকায় প্রথম ঘোষিত হয়। তাও তিনি কবে আসবেন সেটা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। সেখানে বলা ছিল সম্ভবত ফেব্রুয়ারির শেষে। দ্য কুইন্ট পত্রিকা ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু করে 8 জানুয়ারি অবধি বিদেশ মন্ত্রক এবং প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর সমস্ত প্রেস বিজ্ঞপ্তি যাচাই করে দেখেছে, কোথাও ট্রাম্পের আগমন সম্পর্কে কোনও উল্লেখ নেই। তাহলে পাঁচ দিন আগেই উমর ও তাঁর সঙ্গীরা সেই খবর পেলেন কী করে? এখনও অবধি পুলিশের কাছে এর কোনও সদুত্তর নেই। এই অভিযোগটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পুলিশকে যথেষ্ট মাথা খাটাতে হবে!
বিজেপির আইটি সেলের অমিত মালব্য টুইট করেছেন যে, 17 ফেব্রুয়ারি অমরাবতীতে প্রধানত মুসলিমদের একটি জনসভায় উমর খালিদ নাকি বলেছেন যে, ট্রাম্প যখন 24 তারিখ ভারতে আসবেন তখন তাঁরা যেন দলে দলে রাস্তায় নেমে আসেন। অথচ নিউজ18-এর 2 মার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী, উমর তাঁর বক্তব্যে বলেন- “24 ফেব্রুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ভারতে আসবেন আমরা তাঁকে জানাব যে, প্রধানমন্ত্রী এবং ভারত সরকার দেশকে বিভাজিত করতে চাইছেন। তাঁরা মহাত্মা গান্ধীর মূল্যবোধ ধ্বংস করতে চাইছেন এবং ভারতের মানুষ সেটার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। আমরা হিংসার বিরোধিতা হিংসা দিয়ে করব না, ঘৃণার বিরোধিতা ঘৃণা দিয়েও নয়। তাঁদের ঘৃণার উত্তর আমরা ভালবাসা দিয়ে দেব। তাঁরা লাঠি চালালে আমরা তেরঙ্গা তুলে ধরব, গুলি চালালে সংবিধান আঁকড়ে ধরব। আমাদের জেলে পাঠালে, ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’ গাইতে গাইতে চলে যাব।“ উমর খালিদের ওপর আগেই ইউএপিএ ধারা চাপানো হয়েছিল। 13 সেপ্টেম্বরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দশ দিন হেফাজতে রাখার পর সঙ্গে সঙ্গে আবার অন্য একটা কেসে দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার করা হয়। কোনও প্রমাণ ছাড়াই তাঁকে 22 অক্টোবর অবধি বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ডাক্তার এম এম আনোয়ার – কর্তব্য পালনের জন্য শাস্তির মুখে!
আল আমিন হাসপাতালের ডাক্তার আনোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর নাম তাহির হুসেনের কল রেকর্ডে পাওয়া গেছে। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে শুরু থেকেই তাহির হুসেন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁকে আইবি অফিসার অঙ্কিত শর্মার খুনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাহিরকে বলা হচ্ছে তিনি নাকি দাঙ্গা এবং সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্তের অন্যতম পান্ডা, সুতরাং তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ থাকা প্রমাণ করে যে ডাক্তারও ওই চক্রান্তে জড়িত। এছাড়া তিনি একটি ধর্না মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন যেখানে বাইরে গান্ধি, আম্বেদকরের ছবি টাঙিয়ে, ভিতরে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হচ্ছিল। আল আমিন হাসপাতাল নামেই একটি হাসপাতাল, আসলে এটি একটি ক্লিনিক, যেখানে উনিই ছিলেন একমাত্র ডাক্তার। 24-26 ফেব্রুয়ারি এলাকার বড় বড় হাসপাতাল রোগীর নাম অপছন্দ হলেই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ভর্তি করলেও অহেতুক বিনা চিকিৎসায় ফেলে রেখেছে। স্টাফ নেই, ওষুধ নেই এইসব অজুহাত দিয়েছে। রোগীর টেস্ট করলেও রিপোর্ট দিতে গড়িমসি করেছে। রোগীর মেডিকো-লিগ্যাল শংসাপত্র দিতে অস্বীকার করেছে। মোদ্দা কথা মুসলিম রোগী ভর্তি করলেও তাঁকে নানাভাবে হেনস্থা করেছে। ডাক্তার আনোয়ার ওই কঠিন সময়ে তাঁর সীমিত ক্ষমতার মধ্যে ছোট্ট ক্লিনিকে যথাসাধ্য পরিষেবা দিয়েছেন। অনেকে শুশ্রুষা পেয়েছেন, মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছেন। অন্য দেশ হলে ওই সংকটের সময় পরিষেবা দেওয়ার কারণে তিনি পুরষ্কৃত হতেন। কিন্তু মামুলি প্রমাণ খাড়া করে তাঁর নাম চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডি এস বিন্দ্রা – অভুক্তকে খাওয়ানোর দায়ে অপরাধী!
ডি.এস.বিন্দ্রা দিল্লির একজন আইনজীবী। তিনি শাহিনবাগে একটা লঙ্গর কিংবা জনতার রসুইঘর খুলেছিলেন। কিছু দিনের জন্য চাঁদবাগ অঞ্চলেও একটি লঙ্গর খুলেছিলেন। দিল্লি পুলিশ রতনলাল নামক এক কনস্টেবলের মৃত্যু সংক্রান্ত এফআইআর 60-তে তার নাম উল্লেখ করেছে। বিন্দ্রা হতভম্ব। দ্য কুইন্টকে তিনি বলেছেন, “আমি তো শুধুমাত্র একটা লঙ্গর দিয়েছি। এটা তো আমার ধর্ম। কী ভুলটা করেছি আমি? লঙ্গর দেওয়া কি অপরাধ?” চার্জশিটে বিন্দ্রার নাম আছে কিন্তু তাকে অভিযুক্ত করা হয়নি। কিন্তু বলা হয়েছে যে তিনি দাঙ্গায় জড়িত ছিলেন। সাক্ষী হচ্ছেন কনস্টেবল সুনীল ও জ্ঞান সিং। তাঁরা খবর দিয়েছেন বিন্দ্রা এবং আরও কয়েকজন মিলে ধর্না মঞ্চ সংগঠিত করেছেন। আবার দাবি করা হয়েছে নাজাম উল হাসান, তৌকির, গুড্ডু তাদের স্বীকারোক্তিতে বিন্দ্রার নাম বলেছেন। তিনজনেরই স্বীকারোক্তি দাঁড়ি, কমা, বানান ভুল সহ হুবহু এক! এটাও দাবি করা হয়েছে যে, তিনি নাকি ‘অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ সংগঠনের সদস্য। বিন্দ্রা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং অভিযোগ করেছেন যে, তাঁকে উত্তর দেওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়নি। বিন্দ্রা বলেন, “আমরা শিখ-মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যের একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভালবাসা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ। আমাদের এই প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি না দিয়ে, আমাদের সম্পর্কে অপবাদ ছড়ানো হচ্ছে।”
দেবাঞ্জনা কলিতা এবং নাতাশা নারোয়াল – স্লোগান দিয়ে ইউএপিএ!
এরা দু’জনেই জেএনইউর ছাত্রী, ‘পিঁজড়া তোড়’ (ছাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা) সংস্থার সদস্য এবং সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। তাঁদের পুলিশ বাড়ি থেকে 23 মে গ্রেপ্তার করে। এফআইআরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে তারা মহিলাদের একটা ধর্নায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল। এটা লেখা আছে যে তারা যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং সিএএ-বিরোধী স্লোগান দেয়। বিচারক তাঁদের জামিন দিয়ে দেন। তিনি বলেন যে তারা কোনও হিংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন না, শুধু নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলেন। বিচারকের এই রায় মিডিয়ায় দ্রুত প্রচার হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ক্রাইম ব্রাঞ্চ তাঁদের বিরুদ্ধে খুন, খুনের প্রচেষ্টা, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, দাঙ্গা করা ইত্যাদি মারাত্মক সব অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁদের ওপর ইউএপিএ প্রয়োগ করে এবং তাঁদের 14 দিনের হেফাজত দাবি করে। এইসব অভিযোগের নির্দিষ্ট কোনও প্রমাণ কিন্তু পুলিশ দাখিল করতে পারেনি। তারা যুক্তি দেয় যে, এই দু’জন জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনে ছিল। সেখানে জনতা পুলিশের নির্দেশ অমান্য করেছে, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করেছে। তাঁরা নাকি ‘ইন্ডিয়া এগেন্সট হেট’ (লক্ষ্য করুন এই সংগঠনের অন্যত্র নাম দেওয়া হচ্ছে ‘ইউনাইটেড এগেন্সট হেট’। পুলিশের কাজের গয়ংগচ্ছ মনোভাবের আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে চার্জশিটে সাক্ষীদের নাম ফাঁস হয়ে যাওয়া। পনেরো জন সাক্ষীর নাম যা তাঁদের নিরাপত্তার কারণে গোপন রাখার কথা তা প্রকাশ হয়ে গেছে। এই ঘটনা পুলিশের তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেয়। শিথিলতার এইরকম আরও অনেক উদাহরণ আছে। অনুমান করা হচ্ছে এর প্রধান কারণ হচ্ছে ওপর থেকে নির্দেশ ছিল, যত তাড়াতাড়ি এবং যত বেশি সম্ভব মানুষকে গ্রেপ্তার করো ও তাঁদের অভিযুক্ত করো) নামক সংগঠনের সাথে যুক্ত এবং তাঁদের হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ পাওয়া গেছে। তাতে দাঙ্গা শুরু হলে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তা বিস্তারিত ভাবে বলা আছে। পুলিশ আরও জানায় বছর 24 বয়সি একজন গাড়ির মিস্ত্রি শাহরুখ যিনি আমনের (18) খুনে অভিযুক্ত, তিনি তার স্বীকারোক্তিতে দেবাঞ্জনা, নাতাশা সহ আরও কয়েকজনের নাম করেছেন। শাহরুখ নিজে দাঙ্গায় একটি চোখ হারিয়েছেন, আরেকটি 90% ক্ষতিগ্রস্ত। তাঁর পরিবারের বক্তব্য, পুলিশ তাঁর ওপর প্রবল অত্যাচার করে এবং 10,000 টাকা দিতে বাধ্য করে। তাঁকে জোর করে একটি কাগজে সই করায়। শাহরুখ বলেন দৃষ্টিহীন হওয়ার কারণে তিনি জানেনও না যে, কাগজে কী লেখা আছে এবং তিনি কোনওদিন ‘পিঁজড়া তোড়’ নামক সংগঠনের কথা শোনেননি এবং অভিযুক্তদের কাউকেও চেনেন না।
আরও পড়ুন: একটি দাঙ্গা, চারটি রিপোর্ট, অজস্র প্রশ্ন
সফুরা জরগর – বক্তৃতা দিয়ে ডাকাতির কেস!
সফুরা জরগর জামিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটির মিডিয়া সমন্বয়কারী এবং সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। 10 এপ্রিল দিল্লি পুলিশ সফুরাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তাদের স্পেশ্যাল সেল অফিসে নিয়ে যায় এবং ছয় ঘন্টা জেরা করার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ জামিনযোগ্য হওয়ার কারণে এবং তিনি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারণে 13 এপ্রিল জেলা ও সেশনস কোর্ট তাঁকে জামিন দেয়। এরপরে পুলিশের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সেটা সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যে অবহিত। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওপর 18টি নতুন অভিযোগ চাপিয়ে দেওয়া হয়, যার মধ্যে ডাকাতি থেকে শুরু করে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র প্রায় সবই আছে। 18 এবং 21 এপ্রিল তিনি যখন আবার জামিনের জন্য আবেদন করেন তখন তাঁকে ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত করা হয়। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আপাতভাবে মামুলি। তিনি একটি সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। 2 জুন আবার তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ হয়। এমনটাও বলা হয় যে, এর আগে বহু মহিলা বন্দির হাসপাতালে প্রসব হয়েছে। তাই এটা জামিন দেওয়ার কোনও কারণ হতে পারে না। এর বিরুদ্ধে প্রবল জনমত তৈরি হয় এবং অবশেষে 23 জুন আদালত মানবিক কারণ দেখিয়ে সফুরাকে জামিন দিতে বাধ্য হয়।
উমর, সফুরা, দেবাঞ্জনা, নাতাশা এবং আরও অনেকের বিরুদ্ধে পুলিশ ইউএপিএ ধারা প্রয়োগ করেছে। এই আইন সম্পর্কে অরুন্ধতী রায় লিখছেন, “এই আইনের অধীনে প্রায় সবকিছুই অপরাধ, এমনকি রাষ্ট্র-বিরোধী চিন্তা করাও অপরাধ। তোমার দায়িত্ব নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করা। যত আমি এটা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি, তত মনে হয় এটা কতগুলো উন্মাদের সম্মুখে একজন সুস্থ মানুষের নিজের সুস্থতা প্রমাণ করার সামিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা অনুযায়ী একজন ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া অবধি তিনি নিরপরাধ। ইউএপিএ-তে সেটা পুরো উল্টে দেওয়া হয়েছে।“ বিচারপতি এ.পি.শাহ বলছেন, “এখন অভিযুক্তের দায়িত্ব নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করা। ইউএপিএ-তে জামিন দেওয়ার জন্য আদালত ধরেই নিচ্ছে যে, এফআইআরে যা অভিযোগ আছে তা ঠিক। অভিযুক্তকে প্রমাণ করতে হবে যে সেগুলি মিথ্যা। তাহলেই সে জামিন পেতে পারে, যেটা বাস্তবে অসম্ভব। সরকার এর চূড়ান্ত অপব্যবহার করছে যা অতীতের এমার্জেন্সি আমলের কথা মনে করিয়ে দেয়।'
পুলিশের পক্ষপাতদুষ্টতা
দিল্লি দাঙ্গায় পুলিশের তদন্ত একটা নির্দিষ্ট ছকে চলছে। এতে প্রচুর ফাঁক ফোকর, ছলচাতুরি আছে। কুড়ি বছর বয়সি হোটেলের বেয়ারা দিলবার নেগির ঘটনাটা দেখা যাক। তাঁর পোড়া এবং কাটাছেঁড়া মৃতদেহ শিব বিহার অঞ্চলে অনিল সুইটসের কাছে পড়ে ছিল। তাঁর হত্যার জন্য বারোজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের সবার বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, দাঙ্গা করা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা তৈরি করার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা বিশ্লেষণ করে দেখেছে যে, এই বারোজনের স্বীকারোক্তির বয়ান প্রায় এক, একটা থেকে আরেকটায় কপি-পেস্ট করা। একই শব্দ ও বাক্য প্রতিটিতে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। চার্জশিটে বলা হয়েছে 24 ফেব্রুয়ারি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি বাহিনী যখন লুঠপাট করছিল, তখন নেগিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। দ্য কুইন্ট পত্রিকা এই চার্জশিট জোগাড় করতে সমর্থ হয়েছে এবং তাতে বেশ কিছু গড়মিল পেয়েছে। যেমন সিসিটিভি ফুটেজের তারিখ এবং নেগির মৃত্যুর তারিখ ও সময় এক নয়।
শিব বিহারের হাসিম আলি (60) এবং যমুনা বিহারের সুভাষ ত্যাগীর (51) ঘটনা দেখা যাক। দু’জনেই এলাকায় হিংসার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা থানায় নালিশ জানাল এবং তাদের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান দেন। পুলিশ উল্টে দু’জনকেই বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ হাসিমকে এপ্রিলের চার তারিখে গ্রেপ্তার করে। ফটো ও ভিডিওর ভিত্তিতে পুলিশ জানায় যে, এলাকাতে তাকে দাঙ্গা করতে দেখা গেছে এবং অন্যদের হিংসায় প্ররোচিত করতেও দেখা গেছে। সুভাষকে এপ্রিলের নয় তারিখে পারভেজ আলমকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগের ভিত্তি হচ্ছে সুভাষ এবং পারভেজের মোবাইল লোকেশন একই জায়গায় দেখা গেছে। এলাকার লোকেরা বলছে পারভেজ গুলিতে মারা গেছে, পুলিশ বলছে আরও ভারী কোনও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে যে নিশানা করা হয়েছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। নানা অছিলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং তারপর তাদের সম্পর্কে কোনও তথ্য আত্মীয়স্বজন, তাদের আইনজীবীকে দেওয়া হচ্ছে না। রেহান আলির ঘটনাটা দেখা যাক। থানার লোক সাদা পোশাকে তাদের বাড়িতে আসে এবং তার দাদা রিয়াসত এবং বাবা লিয়াকতকে মার্চের সাত তারিখে তুলে নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসা করলে বলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা একটু বাদেই ফিরে আসবে। তারপর থেকে তাদের আর কোনও খবর নেই। রেহানকে রোজ থানায় গিয়ে তার বাবা ও দাদার খবরের জন্য হত্যে দিয়ে বসে থাকতে হয়। কৌশলটা হচ্ছে পরিবারের একজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে অন্য আরেকজনকে নিয়মিত থানায় আসতে বাধ্য করা। মনে রাখতে হবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই ধরনের হেনস্থা করা হয়েছে, যখন লকডাউন পুরো চালু হয়ে গেছে এবং করোনার প্রকোপ বাড়ছে। এই কারণে অভিযুক্তরা অসহায় হয়ে যায়, আইনের সাহায্য পেতেও অসুবিধা হয়। এছাড়া ফন্দি করে আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু আইনত কাউকে 24 ঘন্টার বেশি আটকে রাখা যায় না, তাই অন্তিম মুহূর্তে তাকে মুক্তি দিয়ে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিনোদ পেশায় ডিজে ছিলেন এবং বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানে মিউজিক সিস্টেম ভাড়া দিতেন। তিনি দাঙ্গায় খুন হন এবং তাকে হত্যার অভিযোগে আখতারকে (নাম পরিবর্তিত) 25 ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়। আখতারের স্ত্রী আফরিন বলেন, “বিনোদভাই আমাদের বন্ধু ছিলেন এবং এক দশক আগে যখন আমাদের বিবাহ হয় তখন তিনি ডিজে ছিলেন।“ আখতারের গ্রেপ্তারের সম্পর্কে তিনি বলেন, “ও নিচে দোকানে কাজ করছিল। পুলিশ এসে ওকে ডাকে এবং দশ মিনিটের জন্য তদন্তে সাহায্য করতে বলে। পুলিশ ওকে যমুনা বিহার থানায় নিয়ে যায়, সেখান থেকে দ্বারকায়। ওকে পুলিশ আশ্বস্ত করে যে, ওর কোনও দোষ নেই, শুধু তদন্তে সাহায্য করার জন্যই ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।“ তারপর থেকে তাঁকে আর ছাড়া হয়নি এবং আটকে রাখার জন্য কোনও প্রমাণও দেখানো হয়নি। বিনোদের ছেলে নীতিন এফআইআর করেন। তিনি দাঙ্গায় বেঁচে যান কিন্তু তার বাবা হাসপাতালে যাওয়ার পথে মারা যান। এফআইআরে তিনি কিন্তু কাউকে অভিযুক্ত করেননি। আখতারের ওপর IPC-র বিভিন্ন ধারা চাপানো হয়েছে। তাকে তিহার জেলে স্থানন্তরিত করা হয়।
শাদাব আহমেদ নামে জনৈক ব্যক্তি, যাকে ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং যিনি বর্তমানে পুলিশি হেফাজতে আছেন, তিনি দিল্লি আদালতে অভিযোগ করেন যে 24 এবং 26 আগস্ট তাঁকে বিভিন্ন নথিতে সই করতে বাধ্য করা হয়েছে। যদিও তিনি সেগুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত নন (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-21.09.20)। বিচারক তার অভিযোগ খারিজ করে দেন। তিনি যুক্তি দেন যে, শাদাব যখন তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন, তখন এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি। আইনজীবী জানান তার মক্কেলের সঙ্গে 25 আগস্ট তার ফোনে দু’ মিনিট কথা হয় এবং তারপর শাদাব কোভিড আক্রান্ত হন। 2 সেপ্টেম্বর শাদাব তাকে এই ঘটনা জানান এবং তারপর তিনি সেটা আদালতের নজরে আনেন। লক্ষ্যনীয় যে, ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইন যথেচ্ছ ভাবে সবার ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে এবং জোর করে, ভয় দেখিয়ে অনেককে স্বীকারোক্তি কিংবা অন্যদের অভিযুক্ত করে কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছে।
উপরোক্ত ঘটনাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন আইনজীবী দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখে জানান যে, বিধিবহির্ভূত ভাবে অনেককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আইনজীবীদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সুমিত নামক এক ব্যক্তির একটি সাম্প্রতিক কেস পর্যালোচনা করা যেতে পারে। তার বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ। একটি দোকানে অগ্নিসংযোগ এবং একটি স্কুটার, এয়ার কম্প্রেসার ও গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি। সুমিতকে জামিন দেওয়া হয়। বিচারক বলেন, তাকে তো বেশ শান্ত, সংযত দেখা যাচ্ছে। তাকে লাঠি হাতে আগুনের চারপাশে ঘুরতে দেখা গেছে। হয়তো তিনি আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি তো অন্য কোনও গলিতেও যাননি, নিজের দোকানের সামনেই ঘোরাফেরা করছেন। তার পরিবার দোতলায় থাকে, তাই তিনি দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করছেন। দ্বিতীয় অভিযোগের ক্ষেত্রে বিচারক বলেন যে, এয়ার কম্প্রেসার যখন সুমিতের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় তখন কোনও নিরপেক্ষ সাক্ষী ছিল না, শুধুমাত্র পুলিশের সাক্ষ্যর ভিত্তিতে তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যায় না। 20,000 টাকার বন্ড ও একজন সিকিউরিটি দাঁড় করিয়ে সুমিত জামিন পেয়ে যান। আরেকটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, জনৈক নিসার আহমেদ পুলিশের কাছে যে অভিযোগ করেছেন, তা পুরোটাই চার্জশিটে আছে কিন্তু এলাকার বিজেপি কাউন্সিলার কানহাইয়া লালের নাম গায়েব হয়ে গেছে। নিসার তাঁর অভিযোগে এই ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন। কারণ তিনি একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংসার পুরোধা নেতৃত্বে ছিলেন এবং তাঁদের সরিয়ে দেওয়া নিয়ে শ্লোগান দিয়েছেন । পুলিশ ও আদালতের যুক্তি, আইনের ব্যাখ্যা, বিচারের পদ্ধতিতে কোনও ধারাবাহিকতা নেই, ব্যক্তি অনুসারে বিভিন্নভাবে তা প্রয়োগ করা হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার জুলিও রিবেইরো দিল্লি পুলিশ কমিশনার এস.এন.শ্রীবাস্তবকে একটি মর্মস্পর্শী আবেদনে লিখেছেন যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যারা সঠিক কারণেই তাদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিদ্বেষমূলক আচরণের প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন, তাদের নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যাপারে নিশ্চিত করা হোক। দিল্লি পুলিশ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু যাঁরা ঘৃণা-প্রচার করে দাঙ্গায় প্ররোচনা দিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, প্রবেশ ভার্মা এদের কাছ থেকে কোনও কৈফিয়ত দাবি করা হয়নি, অথচ অসুস্থ মুসলিম মহিলারা, যারা একটি বৈষম্যমূলক আইনের প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলেন, তাদের মাসের পর মাস জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে। পুলিশ নিজের কাজের পর্যালোচনা করুক এবং বাহিনীতে যোগদানের সময় যে শপথ নিতে হয় তার মর্যাদা রক্ষা করুক।
বিরোধী দলের নেতা এবং স্বনামধন্য সমাজকর্মীদের অভিযুক্ত করার প্রচেষ্টা
দেবাঞ্জনা এবং নাতাশার জামিন তো এখনও দূরঅস্ত, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে তারা মিডিয়ায় শিরোনামে চলে আসেন, যখন পুলিশ দাবি করে যে তারা দু’জনেই তাঁদের স্বীকারোক্তিতে অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ এবং তথ্যচিত্র পরিচালক রাহুল রায়ের নাম করেছেন। তাঁরা অভিযুক্ত নন, কিন্তু সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটে তাঁদের নামের উল্লেখ আছে। এখানেও উভয়ের জবানবন্দির বয়ান হুবহু এক, কপি-পেস্ট। পরে তাদের স্টেটমেন্ট যখন প্রকাশ্যে আসে, দেখা যায় দু’জনেরই কাগজের ওপরে অস্পষ্ট ভাবে লেখা ‘আই রিফিউজ টু সাইন’। একইভাবে পিঁজড়া তোড়ের আরেকজন সদস্যা গুলফিশা ফতিমা, যিনি নিজেও ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত, তিনি নাকি তার জবানবন্দিতে সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি এবং স্বরাজ অভিযানের সভাপতি যোগেন্দ্র যাদবের নাম করেছেন। গুলফিশার উকিল মেহমুদ প্রছা বলেন, “এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। সরকার এই দাঙ্গা সম্পর্কে তাঁদের নিজেদের আখ্যান আরও মজবুত করার জন্যই এইসব প্রচার করছে।'
আবার প্রাক্তন কংগ্রেস কাউন্সিলার ইশরাত জাহান এবং খালিদ সাইফি তাদের স্বীকারোক্তিতে বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা সলমান খুরশিদ এবং আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের নাম করেছেন। ইশরাত নাকি বলেছেন, এঁরা ছাড়াও সমাজকর্মী হর্ষ মান্দার এবং যোগেন্দ্র যাদব বিভিন্ন বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন। দিল্লি দাঙ্গা সম্পর্কে মিডিয়ায় খুব কমই প্রচার হয়েছে। মানুষ প্রায় কিছুই জানে না, অনেকেই বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর বাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রচলিত ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় যে ,তাহির হোসেন নাকি স্বীকার করেছেন যে, তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দাঙ্গা বাঁধাবার চক্রান্ত করেছিলেন। ষড়যন্ত্র যে কত গভীর এবং সেটা যে বিদেশেও বিস্তৃত, সেটা প্রমাণ করতে ইসলাম প্রচারক জাকির নায়েকের নামও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। খালিদ সাইফি নাকি মালয়েশিয়ায় জাকির নায়েকের সঙ্গে দেখা করেন এবং তার সমর্থন প্রার্থনা করেন। বলাই বাহুল্য দু’জনই এই সংবাদকে পুরো ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছেন।
দু’টি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের কাহিনি
একটি গ্রুপের নাম ‘দিল্লি প্রোটেস্ট সাপোর্ট গ্রুপ’ (DPSG) এবং এর সদস্যদের মধ্যে সক্রিয় আন্দোলনকারীরা যেমন আছেন, তেমনই অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিও আছেন। 26 ডিসেম্বরে গ্রুপ প্রথম তৈরি হয় এবং এর এডমিন ছিলেন তথ্যচিত্র পরিচালক রাহুল রায় এবং সাবা দেওয়ান। এই গ্রুপে মূলত আন্দোলন কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে কথোপকথন, তর্কাতর্কি আছে। যেমন চাক্কা জ্যাম করা উচিত কিনা, এই নিয়ে ধুন্ধুমার তর্ক হয়। রাস্তা অবরোধ করলে মানুষের অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। সাবা দেওয়ান সতর্ক করছেন আন্দোলন যেন সর্বদা অহিংস থাকে। প্রত্যেকেই সংবিধানে তাদের বিশ্বাস ব্যক্ত করেন। প্রজাতন্ত্র দিবস কীভাবে পালন করা হবে সেটা নিয়ে কথা হয়। সৃষ্টিশীল লেখা এবং সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ লেখা সংগ্রহ করে ডেটাবেস তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়। এই গ্রুপের কথোপকথন নিয়ে অরুন্ধতী রায় লিখছেন, “এই তরুণ তরুণীদের কথাবার্তা উদ্যমপূর্ণ এবং তাতে দিশা আছে। বারবার অভিজ্ঞজনেরা তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে শান্ত থাকতে হবে এবং আন্দোলনকে সব সময় অহিংস রাখতে হবে। মাঝেমধ্যে তুচ্ছ কারণে অনর্গল তর্কাতর্কি হয়, যেরকমটা উৎসাহী কর্মীরা করে থাকে। আর সেটাই তো গণতন্ত্র। ঘটনা হচ্ছে আমাদের মনে হতে পারে এই ধরনের বার্তালাপ খুবই নিরীহ। কিন্তু এর ভিত্তিতেই অনেককে ইউএপিএতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বিভিন্ন চার্জশিটে নাম উল্লেখিত হয়েছে।'
আরেকটি গ্রুপ হচ্ছে ‘হিন্দু কট্টর একতা গ্রুপ’ যাদের সদস্যরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করার জন্য লোক জড়ো করার আহ্বান জানাচ্ছে। কে, কোথায়, কখন, কতজনের ক্ষতি করেছে, কটা মাদ্রাসা পোড়ানো হয়েছে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। খুন, ধর্ষণ, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ জাতীয় শব্দ এই গ্রুপের প্রায় প্রতিটি বাক্যে উচ্চারিত হচ্ছে। এই গ্রুপের 11জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে 9জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ও তাদের বিরুদ্ধে খুন, দাঙ্গা বাঁধানো, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে ইউএপিএ জারি হয়েছে কিনা খবর নেই (ওয়ার অনলাইন পত্রিকা-26.09.20)। অরুন্ধতী রায় লিখছেন, “এই গ্রুপের সদস্যরা গর্ব করছেন যে, একজন সংখ্যালঘু মানুষকে তিনি হত্যা করেছেন এবং সবাই খোলাখুলি বিজেপি নেতাদের গুণগান করছেন।'
দাঙ্গায় কি মুসলিমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করেছে?
দিল্লি দাঙ্গা সম্পর্কে সরকারি ভাষ্য হচ্ছে যে, সিএএ-বিরোধী আন্দোলন মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের আন্দোলন। এটাকে একটা ধর্মনিরপেক্ষ আবরণ দেওয়ার জন্য কিছু অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের সন্নিবিষ্ট করা হয়েছিল। শাহিনবাগ এবং অন্যান্য ধর্নাগুলোতে মুসলিমরা মূলত জমায়েত হয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই দাঙ্গা বাঁধানোর ছক প্রস্তুত করা হয়েছিল। অরুন্ধতী রায় লিখছেন যে, “আমাদের বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে যে, মুসলিম ছাত্রছাত্রী, অ্যাক্টিভিস্ট, গান্ধিবাদী, আর্বান নক্সাল, বামপন্থী, সবাই মিলে সিএএ, এনআরসি, এনপিআরের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সন্নিবিষ্ট হয়েছিল। কারণ তারা মনে করেছে যে লথিপত্র না থাকার কারণে এটা মুসলিম সম্প্রদায় এবং দেশের গরিব মানুষদের বিপন্ন করবে, তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে দেবে।“ তিনি লিখছেন, “আমিও সেটা বিশ্বাস করি।“ এর পরে তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলছেন, “বাবরি মসজিদ যেমন নিজেই নিজেকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, 2020-র দিল্লি দাঙ্গার পুলিশি বয়ান অনুযায়ী মুসলিমরা ষড়যন্ত্র করে নিজেদের হত্যা করেছেন, নিজেদের মসজিদ পুড়িয়েছেন, নিজেদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছেন, নিজেদের শিশুকে অনাথ করেছেন, এবং এই সবই করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখানোর জন্য যে, এই দেশে তাঁরা কী ভয়ানক সময় অতিবাহিত করছে।'
পুলিশ দিল্লি হাইকোর্টে এফিডেভিট করে আপ্রাণ দেখাতে চেষ্টা করেছে যে, উভয় সম্প্রদায় সমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা যুক্তি দেখাচ্ছে যে, দু’টি সম্প্রদায়ের মানুষ প্রায় সমান সমান গ্রেপ্তার হয়েছে। যেটা তারা সুচতুর ভাবে চেপে যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে মাসের পর মাস জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে এবং তাঁদের মারাত্মক সব অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে। পরিসংখ্যানের দিকে একটু নজর দিলেই বোঝা যাবে, কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দাঙ্গায় মৃত্যু হয়েছে 53 জনের, যার মধ্যে 38 জন মুসলিম। দাঙ্গায় 185টি বাড়ি, 468টি দোকান, 19টি ধর্মস্থান, এবং অন্তত 747টি গাড়ি ধ্বংস হয়েছে অথবা গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ঠেলা, ঘোড়ার গাড়িও আছে। 85-90% বাড়ি, 80-85% দোকানের মালিক ছিলেন মুসলিমরা, ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাড়ির বিপুলাংশের মালিকও মুসলিম। হিংসার প্রভাব কী নিদারুণ ভাবে একতরফা ছিল, সেটা আরও বোঝা যায় যখন দেখা যায় যে মুস্তাফাবাদ ইদ্গাহ এবং অন্য ন’টি স্থানে যে ত্রাণ শিবির স্থাপন করা হয়েছিল, সেখানে প্রায় সবাই ছিলেন মুসলিম। যারা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে প্রায় সবাই মুসলিম। দাঙ্গার এক মাস পরেই লকডাউন শুরু হয়ে যায় এবং শারীরিক দূরত্ববিধি চালু হয়ে যায়। এর ফলে ত্রাণ শিবিরগুলো বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে ঘরছাড়া মানুষ পুনরায় নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে এবং তাদের আবার নতুন করে ঠাঁই নেওয়ার জায়গার সন্ধান করতে হয়।
প্রতিবাদ, আন্দোলনের পরম্পরাকে বন্ধ করাই আসল লক্ষ্য
দিল্লি দাঙ্গা সম্পর্কে সরকারি ব্যাখ্যা হচ্ছে এটি একটি আর্বান-নক্সাল, জিহাদি ষড়যন্ত্র, যেটাতে বিদেশি ইন্ধনও ছিল। যে কোনও গণআন্দোলন হলেই এটাই এখন অবধারিত সরকারি ভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাথরস কান্ডে দেখুন। একজন মহিলা নিপীড়িতার পরিবারকে সহমর্মিতা জানাতে গেলে তাকে নক্সাল বলে দেগে দেওয়া হয়। কেরালার চারজন সাংবাদিককে পিএফআইয়ের সদস্য বলে গ্রেপ্তার করা হয়- নক্সাল-জিহাদি! এর সঙ্গে রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা একটি বিদেশি ষড়যন্ত্রও বটে। এক ছক! এই সরকার যে কতটা নৃশংস, তা বোঝা যায় যখন স্ট্যান স্বামীর মতো বন্দিত একজন 83 বছর বয়সের সমাজকর্মীকে তারা এই কোভিডের সময় টেনে হিঁচড়ে মুম্বাইয়ে নিয়ে যায় এবং সেখানে তালজোলা সেন্ট্রাল জেলে কারাবন্দি করে রাখে। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের এক ঝাঁক নেতানেত্রীদের গ্রেপ্তারই শুধু করা হয়নি, তাদের ইউএপিএতেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। কে একজন বলেছেন এটি একটি বেআইনি আইন! ভীমা কোরেগাঁও মামলায় সোমা সেন, রোনা উইলসনদের 2018-র জুন মাসে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখনও তাদের বিচারই শুরু হয়নি। অথচ এই আইনে কোনও প্রমাণ ছাড়া টানা 180 দিনের বেশি বন্দি রাখার নিয়ম নেই। সমস্ত আইনকানুন, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার উপেক্ষা করে শুধুমাত্র সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এবং দেশব্যাপী ধর্মীয় উন্মাদনার দাপটে এই মামলায় অভিযুক্তদের মাসের পর মাস জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে। উমর, দেবাঞ্জনা, সাইফিদের যে একই হাল হবে না, তার কী নিশ্চয়তা আছে?
সরকার নিশ্চিত করতে চাইছে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের মতো দেশজুড়ে সাড়াজাগানো প্রতিবাদ আর যেন দানা না বাঁধতে পারে। তাই একদিকে তারা যেমন মূল সংগঠকদের আটকে রাখছে, অন্যদিকে ধর্না, সমাবেশ ইত্যাদির ওপর আইন করে নিষেধাজ্ঞা আনার চেষ্টা করছে। সংসদে শ্রম-বিধি পাস করে তারা ধর্মঘট এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারকে সংকুচিত করে দিয়েছে। এখন শাহিনবাগের দৃষ্টান্ত টেনে বলছে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করা যাবে না। মহামান্য আদালত কি এখন তাহলে কে, কবে, কোথায় আন্দোলন করবে এটাও ঠিক করে দেবে? এই সরকার যে কোনও ধরনের আন্দোলনের ওপর খড়্গহস্ত; আদালত কী করে আশা করে কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় সমাবেশ করার জন্য এই সরকারের অনুমতি পাওয়া যাবে? মহামান্য আদালত বলছেন, ঔপনিবেশিক সময়ে প্রতিবাদের যে পন্থা ছিল, তা এখন করা যাবে না। আশুতোষ মিশ্র তাঁর ব্লগে লিখছেন, এর অর্থ আদালত স্বীকার করছেন যে, শাহিনবাগের আন্দোলন ঔপনিবেশিক ধাঁচের ছিল, যার অর্থ সেটা গান্ধিবাদী ছিল। অর্থাৎ, শাহিনবাগের দাদিরা আজকের প্রকৃত গান্ধিবাদী। একইভাবে যেটা অনুচ্চারিত যে, এখনকার শাসক স্বাধীনতা-পূর্ব আমলের মতোই দমনপীড়নমূলক।
পরিস্থিতি কঠিন, এবং তা আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে। আন্দোলনের পরিসর ক্রমশ সংকুচিত করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। রাষ্ট্রের অমানবিক আইনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে একটা গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি হয়েছিল, প্রবল দমনপীড়নের কারণে সেটা কুঁকড়ে গিয়ে একটা গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যেতে পারে। আইনি রাস্তা রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষের ক্ষোভ বিপথগামী হয়ে পড়তে পারে এবং তা চোরাগোপ্তা, জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে পর্যবসিত হতে পারে। গুজরাত দাঙ্গার পরেও সুপ্রিম কোর্ট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সুরাহা দেওয়ার জন্য ভাল কিছু রায় দিয়েছিল। জাস্টিস জে এস ভার্মার নেতৃত্বে ‘ন্যাশানাল হিউম্যান রাইটস কমিশন’ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। বিচারপতি শাহ বলছেন, “এই ধরনের সংকটের সময় বিচারব্যবস্থাই মানুষের শেষ আশা। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে সেটাও দিগভ্রান্ত হয়ে পড়েছে।“ তাঁর মতে, সংসদের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ্যে এসে গেছে। সন্দেহ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন শাসকের অনুগত হয়ে গেছে। তথ্য কমিশন প্রায় অকেজো। সংবাদমাধ্যম, কৃতবিদ্য নাগরিক সমাজ হয় চূর্ণ হয়ে গেছে, না হলে তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নিয়মিত আক্রমণ করা হচ্ছে- হয় অভিযোগ করা হচ্ছে যে ছাত্রছাত্রীরা গণ্ডগোল করছে, না হলে শিক্ষকদের কোনও চক্রান্তে লিপ্ত বলে ধরপাকড় করা হচ্ছে। এই ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যেও বিচারপতি শাহ আশা প্রকাশ করছেন যে, বিচারব্যবস্থার স্বর্ণযুগ ফিরে আসবে, তাঁরা আবার সক্রিয়ভাবে নাগরিকের অধিকার রক্ষা করবে।
বর্ষীয়ান, অভিজ্ঞ সমাজকর্মী হর্ষ মান্দার যিনি নৃশংস গুজরাট দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছেন, তিনি সদর্পে ঘোষণা করেছেন, ‘আমদের মূক করে দেওয়া যাবে না’। তিনি বলছেন, ‘আমরা এখানে ঘোষণা করছি এবং আশা করছি, দেশে উচ্চপদে যাঁরা আসীন তাঁরা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছেন যে সরকার কোনদিনও আমাদের চুপ করাতে পারবে না, স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে যে স্বপ্ন আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি- ঐক্যবদ্ধ ভাবে ন্যায্য ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে একটা দেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন- তা কোনওদিনও আমাদের থেকে তাঁরা কেড়ে নিতে পারবে না।'
বইটির প্রকাশনা থেকে ব্লুমসবেরির সরে যাওয়া তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে।
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী এখন রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
বিচারব্যবস্থার সরকারের অনুগত হয়ে পড়াটাই ভয়ঙ্কর বিপদ
কোনও কিছুই আর গোপন নয় আমাদের জীবনের।
দ্রৌপদীরা নগ্ন হয়ে প্রতিবাদী হলে পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভয় পায়, নিজেদের কৃতকর্ম ঢাকা দিতে চায়।
এই ধরণের অপরাধের তালিকায় উত্তর প্রদেশের নাম শীর্ষে (15.3 শতাংশ)।