×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • কৃষক আন্দোলন কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

    সোমনাথ গুহ | 19-01-2021

    প্রতীকী ছবি।

    কতিপয় বিশেষজ্ঞরা ইদানিং কৃষক আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন তুলছেন। এঁদের সবাইকে এক গোত্রে ফেলা যাবে না। এঁদের বক্তব্যে ফারাক আছে। কেউ সরাসরি তিনটি আইনের পক্ষে। কেউ বলছেন কিছু সংশোধন করলেই আইনগুলি কৃষকদের অনুকূল হয়ে যাবে। কেউ বলছেন ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) সংক্রান্ত চতর্থ একটা আইন করে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কেউ বলছেন পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং সংলগ্ন অঞ্চলে এখন যে ব্যবস্থা আছে, সেটাই কায়েম থাক। দেশের বাকি অঞ্চলে আইনগুলো চালু করে দেওয়া হোক। মোটমাট এঁরা কেউই আইন প্রত্যাহারের পক্ষে নন। আবার এঁরা যে আন্দোলনের বিপক্ষে এমনটাও নয়, বর সহানুভূতিশীল। এঁরা যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন, সেটার পাশাপাশি সেগুলোর উত্তর কী হতে পারে, সেটার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে।   

    প্রশ্ন:-1— অর্থনীতিবিদ থেকে ইংরাজি কাগজের সাংবাদিক বলছেন যে, আমাদের দেশে খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত, 70 লক্ষ টন চাল, গম ইত্যাদি এফসিআই-এর গুদামে পচে যাচ্ছে। বহুদিন ধরেই দেশ খাদ্যে স্বনির্ভর। আমরা আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন করছি। একজন বলছেন পাঞ্জাবের চাষিরা, যাঁরা সবুজ বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের উৎপাদিত শস্য আজকে গুদামে ইঁদুর খাচ্ছে।

    উত্তর- এটা একটা প্রহেলিকা! খাদ্যে আমরা স্বনির্ভর, শস্য পচে যাচ্ছে, অথচ ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’-এ আমরা 107টি দেশের মধ্যে 94-তম স্থানে; নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশেরও নীচে। 2019-এ ছিলাম 117টি দেশের মধ্যে 102-তম স্থানে। এই প্রহেলিকাটা এই বিশেষজ্ঞরা ব্যাখ্যা করু। বাস্তব হচ্ছে, এখন অন্তত এক-চতুর্থাংশ মানুষ অর্ধাহারে, অনাহারে থাকেন। নতি আয়োগের একটি রিপোর্ট বলছে, গত দুই বছরে আগের দশ বছরের তুলনায় অধিকসংখ্যক মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে নেমে গেছেন, ক্ষুধাপীড়িত হয়েছেন, তাঁদের উপার্জন কমে গেছেরেশন ব্যবস্থা প্রবলভাবে অপ্রতুল এবং তা 138 কোটি মানুষের কাছে পৌঁছয় না। স্থানীয় এলাকায় রেশনের দোকান থাকলেও দুর্নীতি, জাতপাত, দলবাজি ইত্যাদি কারণে খাদ্যশস্য প্রান্তিকতম, দরিদ্রতম মানুষগুলোর কাছে পৌঁছয় না। ত্রিশ বছর আগেও মানুষ রেশন ব্যবস্থার ওপর এত নির্ভরশীল ছিল না। ছোট চাষির জমিতেও নানা শাকসবজি এমনিই জন্মাত, আলের জলে কিলবিল করত কুচো মাছ— সবই প্রকৃতির দান! কষ্ট হলেও কোনরকমে পেটে কিছু জুটে যেত। সবুজ বিপ্লবের কল্যাণে কীটনাশক এল, সমস্ত রকম আগাছা, পোকামাকড়, মাছ, ব্যাঙচি বিষের প্রভাবে সাফ হয়ে গেল। যাঁরা অরণ্যের কাছে বসবাস করতেন, তাঁদের জঙ্গল থেকে কলাটা-লোটা জুটে যেত, সঙ্গে ছিল নানা পশুপাখি শিকার। দেদার বৃক্ষচ্ছেদনের ফলে জঙ্গল সাফ হয়ে যাচ্ছে, খাদ্যের এই প্রাকৃতিক উৎসগুলো থেকে মানুষ আজ বঞ্চিত হয়ে গেছে আজ সে পুরোপুরি সরকারি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। তাঁর কোন কাজ নেই, কোনউপার্জনও নেই। খাবার কিনে খাওয়ার মতো সঙ্গতি তাঁর নেইবই-পড়া পণ্ডিতরা এই রূঢ় বাস্তব সম্পর্কে অবহিত নন।

    প্রশ্ন:-2 উপরোক্ত বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই এঁরা বলেন, এত চাল-গম উৎপাদনের প্রয়োজন কী, এর বদলে তুল, আখ, বিভিন্ন ফল চাষ করলে তো ভালো হয়!

    উত্তর- চাষিরা বলেন আমাদের কোন আপত্তি নেই। সরকার এমএসপি দিক, সরকারি মান্ডিতে এইসব পণ্য ক্রয় করার ব্যবস্থা করুক, আমরা সানন্দে এইসব ফসল চাষ করব।

    প্রশ্ন:-3 দু’নম্বর প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আরকটি বিষয়, যা তাঁরা উল্লেখ করেন, তা হল- পাঞ্জাবে বর্ষা কম, গরমকালে চাষ হয়। এই ধান, গম চাষের জন্য প্রচুর জল লাগে, ভৌমজলের স্তর দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। তাই অন্য ফসল চাষ করা প্রয়োজন।

    উত্তর- তাহলে তো বলতে হবে গোড়ায় গলদ। বৃষ্টি কম, গ্রীষ্মে চাষ সত্ত্বেও পাঞ্জাবকে কেন সবুজ বিপ্লবের ধাত্রীভূমি হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল? ধান-গম বেশি জল খায়, এটার চেয়ে ভৌমজল কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ দেদার উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার। সবুজ বিপ্লবের দান এই ধরনের বীজের কথা এরা সুকৌশলে এড়িয়ে যান। 

    প্রশ্ন:-4 এত কৃষিজীবী কেন? এঁরা তো অন্য কোন কাজ করতে পারেন। দেশে পরিবার পিছু জমির পরিমাণ মাত্র এক হেক্টর। চাষিরা কেন শিল্প, পরিষেবা ক্ষেত্রে নিযুক্ত হচ্ছেন না?

    উত্তর- কাজ কোথায়? লকডাউনে 2 কোটি স্থায়ী চাকরি বিলোপ হয়ে গেছে। অস্থায়ী, বদলি, ক্যাজুয়াল এই ধরনের খুচরো কাজের বাজার যে কত সীমিত হয়ে গেছে, তার কোন হিসাব নেই। নরেগায় কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ এত কমে গেছে যে, মজুরি ক্রমাগত পড়তির দিকে100 দিনের পরিবর্তে এখন গড়পড়তা 44 দিন কাজ পাওয়া যায়। এরপর শিল্প, পরিষেবা! এত দিবাস্বপ্ন! হিসাব বলছে দেশে 5 কোটি ছোট ও প্রান্তিক কৃষক পরিবার আছে। এঁদের উপার্জন বাড়ানো সর্বাগ্রে প্রয়োজন। নরেগায় বরাদ্দ বাড়াও। সরকারি ক্যান্টিন খুলে দুঃস্থ মানুষদের সস্তায় খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।

    প্রশ্ন:-5 সরকার কৃষকদের প্রশ্রয় দেয়। তাঁরা কম দামে সার পায়, বিদ্যুতের খরচ দিতে হয় না। কম সুদে ঋণ পায়, বিভিন্ন কৃষক সহায়ক প্রকল্পে সরকারের থেকে টাকা পায়?

    উত্তর- প্রথম কথা হল, যে ছাড়গুলো দেওয়া হয়, তা 90% কৃষককে লাভজনক মূল্য না দিয়ে ঘাটতিটা পুষিয়ে নেওয়া হয়। দ্বিতীয় কথা আমেরিকা, ইউরোপ সর্বত্র কৃষিতে বিপুল অনুদান দেওয়া হয়, যদিও উন্নত দেশগুলিতে কৃষিজীবীর সংখ্যা অনেক কম। এছাড়া শিল্পপতিদের যে জলের দরে জমি দেওয়া হয়, সরকারি পরিকাঠামো যে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয় ব্যবহার করার জন্য? দূরদর্শনের ফ্রি ডিশ বা ডিটিএইচ পরিষেবা যেভাবে চোরাপথে বেসরকারি চ্যানেল ব্যবহার করে। বিএসএনএলের পরিকাঠামো ব্যবহার করে বেসরকারি টেলিকম সংস্থা যেভাবে রাতারাতি টেলিকম বাজারের দখল নিয়ে নেয়। এইরকম প্রচুর উদাহরণ দেওয়া যায়। দেশের মানুষ যখন সংকটে পড়ে, তখন তো এই আদানি-আম্বানদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ লকডাউন চলাকালীন যখন দেশজুড়ে বুভুক্ষ শ্রমিকদের ঢল নেমেছিল, তখন এই পাঞ্জাবের কৃষকরা লঙ্গর খুলে তাঁদের ক্ষুধা নিবারণ করেছিলেন, গুরুদ্বর খুলে দিয়েছিলেন তাঁদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য।   

    প্রশ্ন:-6 মাত্র 6% কৃষক এমএসপি পায়, তাহলে সেটা চালু রেখে লাভটা কি?

    উত্তর- এটাই তো কথা এমএসপি 100% কৃষকের জন্য চালু করতে হবে। সরকারকে আরও অধিক সংখ্যক এবং বিভিন্ন ধরনের শস্য, ফলমূল, অর্থকরী ফসল ক্রয় করতে হবে, চাষিদের কাছ থেকে। মান্ডির সংখ্যা বিপুলভাবে বাড়াতে হবে (এখন আছে মাত্র 7,000টি, যার মধ্যে শুধু হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবে আছে 4,000টি), যাতে কৃষককে অভাব বিক্রি না করতে হয়।


    সোমনাথ গুহ - এর অন্যান্য লেখা


    প্রায় আশি বছর আগে গ্যাবো-মার্সেদেস রূপকথার সূচনা।

    কোনও কিছুই আর গোপন নয় আমাদের জীবনের।

    বইটির প্রকাশনা থেকে ব্লুমসবেরির সরে যাওয়া তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে।

    হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির গণহত্যার আহ্বানে সরকার নীরব থাকলে নাৎজি জার্মানির স্মৃতি ফিরে আসতে বাধ্য।

    পরিকল্পিত আক্রমণে পুলিশ কার্যত আক্রমণকারী দুষ্কৃতীদের সঙ্গীর ভূমিকা পালন করেছিল।

    গুজরাতে ধর্ষণকারীদের মুক্তি দিয়ে বিজেপি-র স্বাধীনতার অমৃত পান

    কৃষক আন্দোলন কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested