×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • সার্থকনামা পথিকৃৎ ডেলিভারি করেন স্বপ্ন

    শুভস্মিতা কাঞ্জী | 30-08-2020

    রোল কাকুর সঙ্গে কচিকাঁচার দল।

    মিউনিসিপ্যালিটির চাকরি ছেড়ে পথিকৃৎ আজ বেসরকারি ফুড ডেলিভারি সংস্থা ডেলিভারি বয় এবং টু হুইলার যাত্রী পরিবহন সংস্থার রাইডার, শুধুমাত্র ভালবাসার খাতিরে। কী সেই ভালোবাসা যার জন্য পাকা চাকরি ছেড়ে পরিবার আত্মীয়-স্বজনের তীর্যক মন্তব্যের সামনে পড়তে হয়? 39টি বাচ্চার ভালবাসা, তাদের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছে।

     

    পথিকৃৎ সাহার স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কিন্তু বাবার ব্যবসার অবস্থা খারাপ হওয়ার ফলে তা আর হয়ে ওঠেনি। উচ্চমাধ্যমিকেই থেমে গিয়েছে পড়াশোনা। তাঁর নিজের যে স্বপ্ন বাস্তব হয়নি, তাঁর হাত ধরেই আরও কয়েকটা শিশুর সেই স্বপ্নপূরণ হোক, তারা নিজের পায়ে দাঁড়াক, এটাই তাঁর এখনকার নতুন স্বপ্ন। জীবনে সফল হয়ে তারা যেন গর্ব ভরে বলে, "রোল কাকুর জন্যই আমাদের এই সাফল্য।'

     

    রোল কাকু কেন? এমন অদ্ভুত নামের নেপথ্যে কী রয়েছে? পথিকৃৎ বলেন, ‘আমার নামের অর্থই যে পথ দেখায়, তাই বরাবরই চেয়েছি এমন কিছু করতে যাতে অন্যের উপকার হয়। কিন্তু আমাকে বেঁধে ফেলা হচ্ছিল, স্বাধীনতা পাচ্ছিলাম না মনের মতো কাজ করার জন্য, তাই মিউনিসিপ্যালিটির চাকরি ছেড়ে বেসরকারি ফুড ডেলিভারি সংস্থার ডেলিভারি বয়ের চাকরি নিই। এর ফলে অনেক কথা, বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে। এমনকী আমার পরিবারের অনেকে আমার পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেছেন। কিন্তু আমি খুশি এই কাজ আমায় নির্দ্ধিধায় মনের মতো কাজ করতে দিচ্ছে। এই কাজ করেই আমি আমার মা, বাবা, স্ত্রী ও 40টি সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারছি। যদিও এখন বেসরকারি ফুড ডেলিভারি সংস্থা অনেকটাই টাকা কমিয়ে দিয়েছে, তাই টু হুইলার যাত্রী পরিবহন সংস্থাতেও রাইডারের কাজ শুরু করেছি।' আর রোল কাকু নামের সম্বন্ধে বলেন, ‘আগে ক্রেতা খাবারের অর্ডার বাতিল করলে নিয়ম ছিল মার্চেন্টের কাছে সেই অর্ডার ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া। আমি তা করতাম না, সেই বাতিল হয়ে যাওয়া খাবার দুঃস্থ, গরিব বাচ্চাদের গিয়ে খাইয়ে আসতাম। দোকান বা রেস্তোরাঁর মালিক একই খাবারের জন্য দু’বার টাকা পাওয়ার থেকে সেই খাবার দিয়ে একজন শিশুর মুখে হাসি ফোটানো অনেক আনন্দের। তখন খুব রোলের অর্ডার ক্যান্সেল হত, আর দমদমে একটি রোলের দোকানের মালিক অনেক সাহায্য করেছেন আমায় এক সময়, সেই থেকেই নাম হয়ে যায় রোল কাকু।

     

    পথিকৃৎ-এর এই কাজের জন্য ওই বেসরকারি ফুড ডেলিভারি সংস্থাতেও তাকে অসুবিধার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর এই কাজ নিয়ে হইচই শুরু হলে সেই বেসরকারি ফুড ডেলিভারি সংস্থার মেইন ব্রাঞ্চ থেকে পথিকৃৎকে ‘এক্সট্রা স্মাইল ব্রেভারি’ সম্মানে সম্মানিত করা হয়। সে জানায়, ‘ভাল কাজ করলে তার ফল কখনও খারাপ হয় না এটা বিশ্বাস করি।

     

    2014 থেকে এই কাজে ব্রতী হন পথিকৃৎ। তিনি যে শুধুই বাতিল অর্ডারের খাবার পৌঁছে দেন এমন না, দমদম ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চল এবং প্রমোদনগর ভ্যাট অঞ্চলের 39টি বাচ্চার শিক্ষার দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। কিন্তু একা তিনি সবটা করে উঠতে পারেননি, একটা সীমিত আয়ে নিজের সংসার খরচ বহন করে বাকি সবটা করে উঠতে পারতেন না, তবুও দমে যাননি। 2019 সালে সোশাল মিডিয়ায় আবেদন জানালে কিছু সমমনস্ক মানুষ ওঁর সঙ্গে যুক্ত হন, এবং তাঁরা সবাই মিলে একটি সংগঠন তৈরি করেন, ‘হেল্প’ নামে। তাঁরা এই লকডাউনে সেই 39টি বাচ্চার এবং তাদের পরিবারের জন্য 17 বার রেশনের ব্যবস্থা করেন, সঙ্গে ওষুধ বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসেরও। আমফান পরবর্তী সময়েও ঝাঁপিয়ে পড়ে সুন্দরবনের মানুষের পাশে দাঁড়ান ওঁরা। তবে যে কারণে পথিকৃৎ-এর "রোল কাকু'নাম, সেই কাজও কিন্তু লকডাউনে থেমে থাকেনি। আজও অর্ডার বাতিল হলে সেই খাবার নিয়ে তিনি পৌঁছে যান বাচ্চাদের কাছে। পথিকৃৎ বলেন, ‘আজকাল কোথাও খাবার বেঁচে গেলে, বা থেকে গেলে আমার কাছে ফোন আসে। যাতে সেই অতিরিক্ত খাবার নষ্ট হওয়ার বদলে কিছু মানুষ তা খেতে পান। এই পরিচিতিটুকু পেয়েছি, মানুষ ভরসা করছে আমাদের উপর। ‘ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়ান ফুড শেয়ারিং অ্যালায়েন্স’ প্রজেক্টে যে 88টি সংস্থা নথিভুক্ত হতে পেরেছে, ‘হেল্প’-ও তাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এত কিছুর পরেও বিষাদের সুর এখনও লেগে "রোল কাকু'র গলায়। তিনি বলেন, ‘আমার চল্লিশটা সন্তান, একটি আমার বাড়িতে থাকে, আর বাকি 39টা দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে। ওদের এখন রোজ দু’ঘণ্টা করে পড়াই, কিন্তু এতে কী হবে? আমাদের স্থায়ী কোনও আস্তানাও নেই। যদি কেউ এই বিষয়ে সাহায্য করেন, তাহলে সুবিধা হয়। একটা স্থায়ী আস্তানা হলে ওদের অনেকটা বেশি সময় দিতে পারব।

     

    নিজের সংসার চালাতে সমস্ত বিলাসিতা ছেড়ে একই সঙ্গে দু’টো সংস্থার হয়ে কাজ করছেন পথিকৃৎ, যাতে নিজের সংসারের পাশাপাশি তাঁর বাকি 39টা সন্তানের জন্যও কিছু করতে পারেন। এই দুঃসময়ে দাঁড়িয়েও দিনবদলের স্বপ্ন দেখেন তিনি। তাঁর হাত ধরেই কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে, বা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে- এই আশাই রাখেন পথিকৃৎ।


    শুভস্মিতা কাঞ্জী - এর অন্যান্য লেখা


    মহামারীর সুযোগে কিছু কোভিড কিচেনের দৃষ্টিকটু রমরমা ব্যবসা।

    ভোটের সময় ছাড়াও অন্যান্য সময় সরকার তৎপর হলে মানুষ বাঁচে।

    সাহায্য করতে গিয়ে আগামীদিনের জন্য আরও বেশি বড় ক্ষতি করে আসছি না তো আমরা?

    সমকামিতার ইঙ্গিতপূর্ণ বিজ্ঞাপন তুলে নেবে না জানিয়ে সদর্থক বার্তা ক্যাডবেরির।

    গত বছরের শ্রমজীবী ক্যান্টিন থেকে এবারের রেড ভলেন্টিয়ার্স, মানুষের পাশে বামপন্থী তরুণ দল।

    অভিনেতা সব্যসাচী চৌধুরীর উদ্যোগে এই অস্থির সময়ে নিরন্ন মানুষের পেটে ভাত মিলছে।

    সার্থকনামা পথিকৃৎ ডেলিভারি করেন স্বপ্ন-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested