‘রঙের আমি, রঙের তুমি, রং দিয়ে যায় চেনা।'
সুকুমার রায় আজকের দিনে থাকলে নির্ঘাৎ এই কথাই লিখতেন। আজ ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ের তাদের রং। মুখ যখন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, তখন মুখোশই সই। মুখোশ, মানে করোনার বাজারে মাস্ক। এখন গেরুয়া রঙের মাস্ক পরলে তাকে বিজেপি-র সমর্থকই মনে করা হবে। একই ভাবে মাস্কের রং সবুজ বা লাল হলেই তিনি যথাক্রমে রাজ্যের বর্তমান শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস বা বাম সমর্থক হয়ে যেতে পারেন! রঙের সঙ্গে দল বা দলের সঙ্গে রং এমনভাবে মিলেমিশে যায় কী ভাবে?
ইতিহাসের অলিতে গলিতে এক এক রঙের এক এক ঠিকানা। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের একটি নির্দিষ্ট চিহ্নের সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব একটি রং আছে। সেই নির্দিষ্ট রঙের পতাকা, ফ্লেক্স, ব্যানার তো হয়ই, সেই রং দিয়ে মানুষকে দাগিয়ে দেওয়া চলছে বহুদিন ধরেই। রাজনৈতিক নেতাদের বসার ঘরের এক এক দেওয়ালেও "পার্টির রং' ব্যবহার করতে দেখা যায় কখনও কখনও। সভা-সমাবেশ হোক বা নির্বাচন জিতেই হোক, সদস্য-সমর্থকরা দলীয় রঙের আবির খেলায় মেতে ওঠেন।
রঙের কথা যখন উঠছে তখন চিত্রশিল্পীদের কথা ওঠা খুব স্বাভাবিক। রঙের মর্ম তাঁদের চেয়ে ভাল কেই বা বুঝবেন? চিত্রশিল্পী হিরণ মিত্র যেমন মনে করেন, রঙের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু ইতিহাস জড়িত থাকে। তার উপর ভিত্তি করেই পতাকার রং বা প্রতীকের রং ঠিক হয়ে এসেছে। শ্রমিক আন্দোলনে রক্তে রাঙা সাদা জামা যেমন সারা বিশ্বে লাল পতাকার চেহারা নিয়েছে। রঙের ব্যবহার রাজনৈতিক দল ভেবেচিন্তেই করে। তাঁর কথায়, "হিন্দু ধর্মের সাধু-সন্ন্যাসীদের বস্ত্রের রঙ গেরুয়া। হিন্দু ধর্মের পবিত্র রঙ হল গেরুয়া। এই পবিত্র সাধুর ভেক ধরেই ভোগের রাজনীতি শুরু করল এরা। সাধুবেশে জনসাধারণের মন জয় করা সোজা।'
শিল্পের ব্যাকরণে প্রতিটি রঙের আলাদা আলাদা অর্থ আছে।
লাল
প্রাচীন কাল থেকে লাল রং ব্যবহৃত হয় অগ্নি বোঝাতে। প্যাশন বা আবেগ, আসন্ন বিপদ, ধ্বংসের প্রতীক বা চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই রং। তাই Danger বা বিপদের সংকেত সবসময় লাল দিয়ে বোঝানো হয়। রোমানরা যুদ্ধের বা মিলিটারি ক্ষেত্রে লাল পতাকা ব্যবহার করত শরীরের অন্তঃক্ষরাগ্রন্থি (এন্ডোক্রিন গ্ল্যান্ড) জাগাতে বা স্টিমুলেট করতে। এর ফলে অ্যাড্রিনালিন হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পাওয়াতে তারা বাড়তি শক্তি অনুভব করত। গ্রীকদের যুদ্ধের দেবতা মার্স, লাল রঙের রথ ব্যবহার করতেন।
বামপন্থী দলগুলির রং লাল, কারণ এই রং সংগ্রামের প্রতীক। 1886 সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহিদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক আটঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত করেছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় 10-12 জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। সেইদিন শ্রমিকদের রক্তের রং স্মরণ করে সারা বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির রং লাল মানা হয়।
গেরুয়া
গেরুয়া রঙ তাপের প্রতীক, উন্নতির প্রতীক। তাই জ্বর হলে শরীরে মুক্তো ধারণ করা থাকলে খুলে রাখতে বলা হয়ে থাকে। কারণ, মুক্তো থেকে গেরুয়া রঙ বিচ্ছুরণ হয় যা উষ্ণতাবর্ধক। গেরুয়া রঙ ত্যাগ, শৌর্য ও সেবার প্রতীক। হিন্দু ধর্মে গেরুয়া, সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর বসনের রঙ। বিজেপির রঙ গেরুয়া।
সবুজ
সবুজ রং আশার প্রতীক, নতুন জীবনের প্রতীক। শক্তি, উর্বরতা এবং বৃদ্ধির প্রতীক। সবুজ শান্তি ও বিশ্রামের রং। এই রং ক্লান্তি দূর করে আমদের তরতাজা করে। আবার ঘন গাঢ় সবুজ হল ঈর্ষা, কুসংস্কার ও হিংসার প্রতীক। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের উৎপত্তি কংগ্রেস দলের থেকেই। উভয় দলই ভোটে জিতে সবুজ আবির মাখেন।
কলকাতার এক সমকালীন কার্টুনিস্টের মতে, লাল সৃষ্টির রং। আগুন বা বিপদের চিহ্ন হিসাবেও লাল রং ব্যবহৃত হয়। আবার যুদ্ধেরও রং লাল। কিন্তু অধিকারের লড়াইয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া হলে সেই যুদ্ধ নেগেটিভ নয়, পজিটিভ শক্তির প্রকাশ। তাই তেভাগা থেকে সারা বিশ্বজুড়ে সমস্ত শ্রমিক আন্দোলনের প্রতীক হিসাবে লাল রঙকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। একই ভাবে ভারতীয় পতাকার একটি রং গেরুয়াকে বেছে নিয়েছে বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপি। তাদের দলীয় চিহ্ন পদ্মফুলও গোলাপির বদলে গেরুয়াতে রাঙা। এর সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে জাতীয়তাবাদের যোগ রাখতেই সম্ভবত এমনটা করা হয়েছে বলে তাঁর মত। তাঁর কথায়, "আমরা দেখি তৃণমূল কংগ্রেস তেরঙা পতাকা ব্যবহার করে। তাদের প্রতীক জোড়া ফুলেও তিন রং দেখা যায়। তবে সবুজ রঙের সঙ্গেই তৃণমূলকে রিলেট করা হয়। তার কারণও রয়েছে। লাল বা গেরুয়া তারা গ্রহণ করতে পারবে না কারণ সেটা অন্য দলের সঙ্গে জড়িত। প্রতীকের মধ্যে একমাত্র সবুজ রঙই বাকি থাকে যা তাদের প্রতীক এবং পতাকায় দেখা যায়। তাই সবুজ। কংগ্রেসও একই ভাবে সবুজকে আপন করে নিয়েছে।'
সাংবাদিক রজত রায়ের মতামত একটু ভিন্ন। তাঁর মতে, রাজনৈতিক দলের শুধু নিজস্ব রঙই থাকে না, তার সঙ্গে একটা নিজস্ব চিন্তাধারা রয়েছে। লাল নিঃসন্দেহে সংগ্রামের রং। রক্তপাত, সশস্ত্র সংগ্রামের সঙ্গে লাল রং সম্পর্কিত। সবুজ লালের বৈপরীত্য করে। একই ভাবে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পতাকার ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস আছে। রাশিয়ায় জারের আমলে পতাকার রং ছিল লাল-সাদা-নীল। অক্টোবর বিপ্লবের পর তা পরিবর্তিত হয়ে কমিউনিস্টদের রঙে হয়। আবার কমিউনিস্টদের পতনের পর পতাকার রঙ সাদা-নীল-লাল হয়, যা বর্তমানে রাশিয়ার পতাকার রং। জারের স্মৃতিতে এবং তাঁর উদ্দেশ্যকে সম্মান জানাতে আবার এই রং ফিরিয়ে আনা হয়। পতাকা তো নিছক একটা রং বেছে নেওয়া নয়? পতাকা অনেক কথা বলে। বিজেপির গেরুয়া রংটা এসেছে ভগোয়া ঝান্ডার গেরুয়া রঙ থেকে। এটা হিন্দু ধর্মের প্রতীক। হিন্দু ধর্ম বা হিন্দু রাষ্ট্র মাথায় রেখে তাঁরা তাদের পতাকায় গেরুয়া রংকে জায়গা দিয়েছে।
তাঁর কথায়, "হিন্দু মহাসভা, ভারতীয় জনসংঘ, ভারতীয় জনতা পার্টি- সব দলের পতাকাই ছিল মূলত গেরুয়া। তাঁরা নিজেদের হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকার বলে ধরে রাখতে চায়। এই ঘটনা চলে আসছে ইতিহাস থেকেই। যেমন চিতোরের পতাকা ছিল সূর্য লাঞ্ছিত। অর্থাৎ তাঁরা সূর্যের বংশোদ্ভূত, তাঁদের সঙ্গে সূর্যের সরাসরি কোনও যোগাযোগ রয়েছে। বংশের গৌরব বৃদ্ধি করতেই তাঁরা এইরকম কাল্পনিক কাহিনি তৈরি করতেন। রাজতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রে রাজা বা চক্রবর্তী বোঝানোর চেষ্টা করতেন যে তিনি ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে সিংহাসনে বসেছেন, সাধারণ মানুষের দ্বারা নয়। তাই তিনি ঈশ্বরের প্রতীক। এখন এইভাবে পতাকা দিয়েই ক্ষমতা, বৈধতা, স্বীকৃতি সবই আদায় করা হয়।'
মানুষের মনে রঙের প্রভাবের কথা মাথায় রেখেই আজকাল কোনও দলই রঙের উপর দখলি স্বত্ব এক বিন্দু ছাড়ে না। দলের সেই নির্দিষ্ট রঙের পতাকা, ফ্লেক্স, ব্যানার, মঞ্চের কাপড়, টুপি, টি-শার্ট, কার্পেট এমনকী প্লাস্টিকের চেয়ার চাই-ই চায় জনসভায়। অন্য কোনও রঙের ছোঁয়া থেকে দূরে থাকার দিকেও থাকে কঠোর নজর। যেমন বিজেপির কোনও সভার আকাশ থেকে তোলা ড্রোন শট দেখলে মনে হবে মাঠ জুড়ে এক বিস্তীর্ণ গেরুয়া কার্পেট বিছানো।
আঁকা: অর্যমা দাস
রঙের আমি, রঙের তুমি, রং দিয়ে যায় চেনা।
দূরত্ববিধি মেনে চলার বিষয়টা একপ্রকার 'মিথ'ই। টলিপাড়ায় করোনা-পরিস্থিতি 'বিট' করছে কীভাবে?
জীবন গোছানোর তাগিদে তাঁর পড়াশোনাটা হয়ে ওঠেনি কখনোই
অনলাইন আদানপ্রদানের ফলে কীভাবে খরচ এবং পরিশ্রম কমানো যায়, তা বুঝেছেন অনেকেই।
বর্তমান থেমে গিয়েছে, ভবিষ্যৎ কী?? আমরা জানি না।