×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • শতবর্ষে নরসিংহ: উপেক্ষিত সংস্কারক

    বিতান ঘোষ | 02-07-2020

    বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারগুলির মধ্যে সত্যযুগের রাম কিংবা দ্বাপর যুগের কৃষ্ণকে নিয়ে জনমানসে যে পরিমাণ মাতামাতি হয়েছে, তার কিয়দংশও ত্রেতা যুগের নরসিংহকে নিয়ে হয়নি। কলি যুগেও ভারতের এতশত রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্যে কাব্যে খানিক উপেক্ষিত'ই রয়ে গেছেন দেশের দশম প্রধানমন্ত্রী পিভি. নরসিংহ রাও। অবশ্য তাঁর নামে সিংহ শব্দের অধিষ্ঠান থাকলেও, প্রশাসক হিসাবে তাঁর তর্জন-গর্জন বিশেষ শোনা যায়নি। বরং নীরব থেকেও কীভাবে চুপিসাড়ে বিপ্লব' করে ফেলতে হয়, তার এক আদ্যন্ত দৃষ্টান্ত হতে পারেন রাও।



    সাবেক তেলেগুভাষী তেলেঙ্গানার রায়লসীমায় জন্ম নরসিংহ রাও-এর। 1956 সালে নিজামের হায়দ্রাবাদ রাজ্যের সঙ্গে যখন এই তেলেঙ্গানাকে মিলিয়ে দিয়ে অন্ধপ্রদেশ রাজ্য গঠিত হল, তখন সীমান্তবর্তী অন্ধ্রের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত তেলেঙ্গানার বৈষম্যের ছবিটি স্পষ্ট হয়ে উঠল। দেখা গেল, অন্ধ্র অঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে যেখানে মাথাপিছু আয় 292 টাকা, সেখানে তেলেঙ্গানায় মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ মাত্র 188 টাকা। এই বৈষম্য ঘোচাতে নিজামের আমলে চালু হওয়া মুলকি ব্যবস্থাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হল। যেখানে বলা হল তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্র দুই অঞ্চলের মানুষেরাই সমানভাবে সরকারি সুযোগ সুবিধা পাবেন। অথচ এই মুলকি ব্যবস্থার রাশ কার হাতে থাকবে, এই নিয়ে দুই অঞ্চলের যে বিরোধ, তা প্রায় দু'দশক অন্ধ্রকে অশান্ত করে রাখল। 1971 সালে ব্রহ্মানন্দ রেড্ডিকে সরিয়ে নরসিংহ রাও-কে সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসান হল। ব্যাপকভাবে ভূমি সংস্কার ও জমিদার জোতদার শ্রেণীর ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তিনি, এই স্বল্পবাক, বিনয়ী মানুষটি তাঁর নীরব বিপ্লবের প্রথম স্বাক্ষর রাখলেন। তেলেঙ্গানার ভূমিপুত্র হওয়া সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর দু'বছরের মেয়াদকালে তিনি কখনও তেলেঙ্গানা-অন্ধ্র অভ্যন্তরীণ বিবাদে মদত জোগাননি।



    1989 সালে ভারত তখন বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। মণ্ডল-কমণ্ডলুর লড়াইয়ের একদিকে প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং এবং তাঁর জনতা দল, অপর প্রান্তে জনসংঘ ভেঙে বেরিয়ে আসা বিজেপি। এর মধ্যে কংগ্রেস কার্যত দিশাহীন অবস্থায়। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করাও তাদের পক্ষে যেমন অসুবিধার, তেমনই লালুপ্রসাদ যাদব কিংবা মুলায়ম সিং যাদবদের মতো লোহিয়াপন্থীদের চকিত উত্থানও তাদের কাছে অস্বস্তিকর। এর মধ্যে বিজেপির রথযাত্রা আর রামজন্মভূমি আন্দোলনে উত্তরোত্তর হিংসার অনুপ্রবেশ ভিপি সিং-কে অত্যন্ত বিচলিত করল। বিহারের সমস্তিপুরে আডবানীর রথকে আটকানো মাত্রই বিজেপি ভিপি সিং সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিল। আদতে মণ্ডল রাজনীতির জটিল চক্রব্যূহে পড়ে তাদের অখণ্ড হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক নষ্ট হয়ে যাক, এমনটা বিজেপি চায়নি। তাই জাতপাতের মণ্ডলকে ধামাচাপা দিতেই ধর্মের কমণ্ডলু নিয়ে হইহল্লা করা শুরু হল। ভিপি সিং সরকার পড়ে যাওয়ার পর 1991-এর অকাল ভোটের জন্য কংগ্রেসকে প্রস্তুত করতে রাজীব গান্ধী সদ্ভাবনা যাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু মাদ্রাজ থেকে প্রায় ৪৪ কিমি দূরের পেরামবুদুরে মানববোমার আঘাতে তিনি নিহত। যথাসময়ে লোকসভা ভোট সম্পন্ন হলে দেখা গেল কংগ্রেস 244টি আসনে জয়লাভ করেছে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে গোটা ত্রিশ আসন কম। নির্দলদের সহায়তায় সরকার গড়ল কংগ্রেসই। প্রধানমন্ত্রী হলেন রাজনীতির অঙ্গন থেকে প্রায় অবসর নিতে চলা, রাজীব গান্ধী মন্ত্রীসভার প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নরসিংহ রাও। দায়িত্ব গ্রহণ করেই রাও বুঝলেন তিনি কাঁটার মুকুট মাথায় চড়িয়েছেন। দেশে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ মাত্রাছাড়া জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, যা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন মূল্যের 8 শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি দুই মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ প্রায় 70 বিলিয়ন ডলার। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে রাও দ্রুত সংস্কারের পথে এগোতে চাইলেন। কিন্তু একেই তাঁর নড়বড়ে সংখ্যালঘু সরকার— বিরোধীরা পান থেকে চুন খসলেই সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনার হুমকি দেয়, তার পর নেহরুর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মডেল ভেঙে সংস্কারে হাত দিলে তাঁর দলের ভিতর থেকেই তো হইহল্লা শুরু হবে! তাই, রাও কোনও অরাজনৈতিক মুখকে সামনে রেখে এই সংস্কারে হাত দিতে চাইলেন। তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পূর্বতন গভর্নর আইজি. প্যাটেল। কিন্তু তিনি রাজি না হওয়ায় প্যাটেলের উত্তরসূরী মনমোহন সিং রাও মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী হলেন। একে একে বন্ধ করা হল লাইসেন্স রাজ, পারমিট রাজ। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ঊর্দ্ধসীমা তুলে দেওয়া হল, কমানো হল শুল্কের হারও। প্রতিরক্ষা ও নির্দিষ্ট দু-তিনটি ক্ষেত্র ছাড়া সর্বত্র বিদেশি বিনিয়োগের পথ খুলে দেওয়া হল। শরিকদের সন্তুষ্ট রেখে, ভুবনায়িত বিশ্বে ভারতের স্থবির হয়ে যাওয়া অর্থনীতির চাকাকে এভাবেই ঘোরালেন রাও-মনমোহন জুটি। 60-এর দশকে অক্সফোর্ডে অধ্যাপনা করার সময় যে মনমোহন কেন ভারতের মুক্ত অর্থনীতির পথ নেওয়া উচিত' নামক গবেষণামূলক নিবন্ধ লিখেছিলেন, সেই তিনিই রাও-এর সমর্থনে বহু বছর পর তাঁর ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটালেন।



    বিদেশনীতি প্রনয়ণেও রাও স্বকীয়তার পরিচয় দিলেন। সোভিয়েতের পতনের পর একমেরুকৃত বিশ্বের বাস্তবতাকে স্বীকার করে যুগপৎ ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেন। আসিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি আমেরিকা ও পশ্চিমের দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা কাটানোর চেষ্টা করলেন। দেশের অভ্যন্তরেও কাশ্মীর, আসাম আর পাঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন তাঁর আমলেই বন্ধ হয়। রাও অবশ্য বুক বাজিয়ে আত্মপ্রচার করে এগুলোর কৃতিত্ব নিজের কাঁধে নিতে চাননি। তাই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আলোচনায় তিনি বহুক্ষেত্রেই অনালোচিত থেকে গেছেন। দেশের রাজনীতি থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা এক বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন রাও। যোগ্য বিরোধী নেতাদেরও তিনি বিভিন্ন বড় পদে ঠাঁই দিয়েছিলেন। অধুনা বিজেপি নেতা, সুব্রহ্মনিয়াম স্বামীকে তিনি বিশেষ শ্রম কমিশনের সভাপতি করেছিলেন। তাঁর আমলেই অটলবিহারী বাজপেয়ী জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।



    আর পাঁচটা রক্ত মাংসের মানুষের মতো তাঁরও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। বিতর্কিত বাবরি মসজিদে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের করসেবা করতে যাওয়ার কর্মসূচী থেকে গণ্ডগোল পাকানো হতে পারে— চারটে গোয়েন্দা রিপোর্টে এমনটাই দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু রাও এসবের পরও উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং-এর রাজধর্ম' পালনের উপর অটল বিশ্বাস রেখেছিলেন। 1992-এর 6 ডিসেম্বর এক ধাক্কা অউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো' স্লোগানে যখন মসজিদের তৃতীয় গম্বুজটিও ভেঙে পড়ছে, তখন রাও নিজের বাসভবনেই বুকের যন্ত্রনা নিয়ে শয্যাশায়ী। প্রাজ্ঞ রাজনীতিক রাও হয়তো সেদিনই বুঝে গিয়েছিলেন, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার গম্বুজের উপর গাঁইতি-শাবল পড়ে গেছে, তাঁর নিজের তখন আর কিচ্ছু করার নেই। বিনয় সীতাপতির হাফ লায়ন: হাউ পিভি নরসিংহ রাও ট্রান্সফর্মড ইন্ডিয়া' বই থেকে আমরা জানতে পারছি, সেইসময় সাংবাদিক শেখর গুপ্তকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, "বিরোধী দলের লোক বলে আমি কল্যাণ সিং প্রশাসনের উপর আস্থা হারাতে পারি না।1996-এ কংগ্রেস শোচনীয় ফল করল। রামজন্মভূমি আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলে চমকপ্রদ ফল করল বিজেপি। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারণ নির্ণয়ে গঠিত লিবেরহান কমিশন প্রধানমন্ত্রী রাও-কে ক্লিনচিট দিলেও পরবর্তী সময়ে দু-দুটো দুর্নীতি কাণ্ডে নাম জড়িয়েছিল তাঁর।



    গান্ধী প্রজন্মের প্রথম যুগের ইয়েসম্যান হিসাবে ইন্দিরা গান্ধীর নতুন দল গঠনের সময় পাশে ছিলেন তিনি। 84 সালের শিখ দাঙ্গার সময়েও কার্যত নিষ্ক্রিয় থেকে গান্ধী পরিবারের প্রতি নিজের আনুগত্যের পরিচয় দিয়েছিলেন সেদিনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাও। তবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর রাও প্রতি মুহূর্তে সনিয়ার মুখাপেক্ষা হয়ে থাকেননি, সদ্য বিধবা এবং দুই সন্তানের জননী সোনিয়ারও রাজনীতিতে তখন ততটা আগ্রহ ছিল না সনিয়া রাজনীতিতে আসার পরেই রাজনীতির ময়দান থেকে ক্রমে হারিয়ে যেতে থাকলেন রাও। মহারাষ্ট্র আর রাজস্থানের দুই অহিসংবাদী নেতা— শরদ পাওয়ার ও রাজেশ পাইলট রাও-এর এই অন্তর্ধানে রীতিমতো প্রণোদনা জোগালেন৷ 1995 সালে সনিয়া এতদিনের রাজনৈতিক মৌন ভেঙে বললেন, "বিভেদকামী শক্তি আমাদের ঘিরে রয়েছে। ইঙ্গিতটা কি রাও-এর দিকে? জানা নেই। তবে 2004 সালে তাঁর মৃত্যুর পর কোনও এক অজানা কারণে রাও-এর মরদেহ কংগ্রেস সদর দপ্তরে ঢোকেনি। দিল্লিতে দাহকার্য সমাধা করারও অনুমতি দেওয়া হয়নি।



    সম্প্রতি তেলেঙ্গানার টিআরএস (তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি) সরকার এবং তার মুখ্যমন্ত্রী কে. চন্দ্রশেখর রাও ধুমধাম করে নরসিংহ রাও-এর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছেন। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হচ্ছে তেলেঙ্গানার ভূমিপুত্র, ভারতের বীর সন্তান'এভাবে পিভি-কে নিয়ে মাতামাতির মধ্যে সূক্ষ রাজনীতির, আরও স্পষ্টভাবে বললে তেলেগু অস্মিতাকে খুঁচিয়ে তোলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে এই প্রসঙ্গে প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী নটবর সিং একবার বলেছিলেন, "ভারতের মাটির সঙ্গে নাড়ির টান ছিল এই স্থিতধী, বহু ভাষায় পারদর্শী, প্রাজ্ঞ মানুষটির। তাই তাঁকে কোনওদিন ইন্ডিয়াকে ডিসকভার করতে হয়নি। এই কারণেই শুধুমাত্র তেলেঙ্গানার ভূমিপুত্র হিসাবে পিভি-কে তুলে ধরে তাঁর মূল্যায়ন কতটা করা যাবে, তাই নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। তবে, দেশের ইতিহাসে এক প্রহেলিকাময় চরিত্র হয়েই রয়ে যাবেন পিভি। তাঁর প্রিয় অর্থমন্ত্রী (পরে প্রধানমন্ত্রীও) মনমোহন সিং যখন 2014 সালে বললেন, "ইতিহাস হয়তো আমার প্রতি সদয় হবে’, তখন নিশ্চয়ই অদৃষ্টে হেসেছিলেন পিভি নরসিংহ রাও।

     

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    সেনাকে বুকে গুলি করার নিদান দেন যে দলের নেতারা, সেই দল উত্তর-পূর্ব ভারতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা ছাঁটতে চ

    এই কঠিন সময়ে বিরোধীরাও দেশকে সঠিক দিশা দেখাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে সঙ্কটে পড়বে ভারতই!

    বালিগঞ্জ উপনির্বাচনে বাবুল সুপ্রিয়র জয়ে প্রমাণ হল শাসক দলে ভিড়লে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হওয়া যায়!

    ইতিহাস শুধু অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, সেটা বর্তমানের পটভূমিতে অতীতকে জরিপ করে নেওয়াও বটে।

    মানবাধিকার নয়, নাগরিকত্ব প্রদানও নয়, শাসকদলের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নটাই মূলকথা।

    বন্‌ধ হরতালময় শহরে এমন দিনগুলোয় সচরাচর ছেলেরা পথে ক্রিকেট খেলে, স্থানীয় চায়ের ঠেকে আড্ডা জমে।

    শতবর্ষে নরসিংহ: উপেক্ষিত সংস্কারক-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested