×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • শহর ত্রয়ী: সত্যজিতের লেন্সে নগর জীবন দর্শন

    সৌমিক কান্তি ঘোষ | 01-05-2020

    জন অরণ্য ছবির শুটিং। ক্যামেরার পিছনে সত্যজিৎ রায় স্বয়ং।

    সত্যজিতের কাছে আধুনিকতা ছিল আলোকময়তার সমার্থক। উনিশ শতকীয় মানবতাবাদরেনেসাঁ থেকে ব্রুনি, পেত্রার্কদের হাত ধরে বিজ্ঞান চেতনা ও যুক্তির পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনে ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও সামাজিক কুসংস্কার কাটিয়ে প্রগতিবাদী চেতনা ও সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। যে অগ্রগতি ও সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাস বাংলার নবজগরণে শুরু এবং নগর সভ্যতায় লালিত, তা একদিন স্বাধীন ভারতের জীবনদর্শন, মূল্যবোধের শিক্ষা ও জ্ঞানের সংযুক্তি ঘটাবে এবং আত্মসমীক্ষা, জ্ঞান অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ নিজের স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস পরিচালকের ছিল। তাই এই অগ্রগতির রূপ তার কাছে ছিল সরল রৈখিক; আর এই অগ্রগতির প্রধান দুটি ক্ষেত্র ছিল: ১. শহর কলকাতা, ২. বিজ্ঞান চেতনা ও যুক্তিবাদ।

     

    রেনেসাঁ প্রসূত যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও রোমান্টিসিজম তাঁর ছবিতে মূল বিষয় ছিল ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। অপু ট্রিলজিতে রেনেসাঁস উদ্ভূত যে মানবকেন্দ্রিক সংবেদনশীলতা পরিলক্ষিত হয় এবং শহর কলকাতা তথা আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে অপুর তথা পরিচালকের একাত্ববোধ, যা আধুনিক বাস্তববাদের উপস্থাপনা করে, তাতে ফাটল ধরে ষাটের দশকের শেষ থেকেই। যে কলকাতা সত্যজিতের ছবিতে আধুনিকতা, অগ্রগতি ও আদর্শবাদের চিহ্ন হয়ে উঠেছিল, তাই ক্রমে আকস্মিক বাঁক নেয় বাস্তবতার অন্তরালে সময়ের অন্তর্লীন বৈপরীত্য ও জটিল সময়ের প্রেক্ষিতে, যার পটভূমিকায় মূলত ষাটের শেষ ও  সত্তরের শুরু। আর এই পথের অ্যানার্কি শুরু অরণ্যের দিনরাত্রিতে (পরিকল্পনা 1969, মুক্তি 1970)

     

    ষাটের দশকের মাঝমাঝি থেকেই রাষ্ট্র, অধিকার, আধুনিকতা, উন্নয়ন- এই সব myth গুলো ভারতের রাজনীতিতে অলীক, অবান্তর এবং অসাড় মনে হতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য সংকট দেখা দেয়, জাতীয় কংগ্রেসের ভাঙনের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বাংলা ও অন্ধ্রে র‍্যাডিক্যাল বামপন্থা বিকশিত হয়। অপরদিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতেও ঠান্ডা যুদ্ধ প্রবল রূপ ধারণ করে। 1966 সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। কলেজ স্ট্রিট নকশাল আন্দোলনের জেরে উত্তাল হয়ে ওঠে। হিংসাত্মক ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে কলকাতায়। শুরু হয় নকশালবাড়িআন্দোলন। পুলিশ ও বামপন্থীদের মধ্যে তখন যুদ্ধের বাতাবরণ, কোথাও কোথাও আন্দোলনকারীরা বলে উঠল, ‘বন্দুকের নলই শক্তির উৎস’ (মাওবাদ)। এক চূড়ান্ত অরাজকতা ও বিচ্ছিন্নতা তখন শহর জুড়ে। ফলত, যে সত্যজিৎ বাংলার রেনেসাঁর সূত্র ধরে বিশ্বাস করতেন, ‘যুক্তি ও জ্ঞানই শক্তির উৎসএবং কলকাতা যার কাছে ছিল অগ্রগতির পরিসর (হেডমাস্টারের লিভিং স্টোনের ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়তে পড়তে অজানা শিয়ালদহ স্টেশনে অপুর অবতরণ এবং হ্যারিসন রোড থেকে অনায়াসে মেসবাড়ির ছাপা খানায় পৌঁছানো। সর্বোপরি, ঘরে ঢুকে ইলেকট্রিক সুইচে হাত রাখা আসলে আধুনিকতা ও অগ্রগতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত তৈরি করে)। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার কাছেই শহর কলকাতা আত্মপ্রকাশ করল মূল্যবোধহীনএকাকীত্বের শহর হিসেবে। সঙ্গত কারণেই এই সময়ে নির্মিত হওয়া ছবিগুলিতে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী’ (1970), ‘সীমাবদ্ধ’ (1971) জন অরণ্য’ (1976) এই ত্রয়ীতে পরিলক্ষিত হল বেকারত্ব, ঘুষ, গণিকাবৃত্তি, বিশ্বাসঘাতকতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের চিহ্ন।


    প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির একটি দৃশ্য

     

    স্বাভাবিক ভাবে সত্যজিতের চরিত্রায়ন নির্ভর সাবেক হলিউডের রৈখিক ও একমুখী আখ্যান বিন্যাসে (linear narration) এল আকস্মিক বাঁক, পশ্চাদ ভ্রমণ (flashback) ও স্বপ্ন বিলাস।

     

    প্রতিদ্বন্দ্বী (1970), সীমাবদ্ধ (1971), জন অরণ্য (1976) শহর ত্রয়ী (urban trilogy)-র প্রতিটিতেই এক ধরনের 'moral centre' বা নৈতিক কেন্দ্রের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অর্থ্যাৎ 'father figure' (বাবা বা সমগোত্রীয়), যে কিনা মধ্যবিত্ত পরিবারের মূল Moral Centre, যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় পারিবারিক নৈতিক মূল্যবোধ। সত্যজিতের এই তিনটি ছবিতেই Enlightened Father Figure অনুপস্থিত বা, তারা শারীরিক ভাবে থাকলেও নৈতিক ভাবে অসহায়।

     

    প্রতিদ্বন্দ্বীছবি শুরুই হয় সিদ্ধার্থের বাবার মৃত্যু চেতনা দিয়ে। নেগেটিভ ইমেজ থেকে ক্রমে ডিজলভ করে পজিটিভ ইমেজের মধ্য দিয়ে সিদ্ধার্থের দৃষ্টিকোণে আখ্যায়িত হয় ছবির গঠন কৌশল। বাবার মৃত্যুর পর পড়া চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে বেকার হয়ে যায়। তার ভাই নকশাল হয়, যাকে একদিন সিদ্ধার্থ চে গুয়েভারার বই উপহার দিয়েছিল। বোনকে চাকরি করতে যেতে হয়। সৃষ্টি হয় বোনের bossহয়তো বা বোন তার commodityএকটা গভীর নিবিড় অশান্ত সময়ের প্রেক্ষাপট উঠে আসে ছবিতে। সিদ্ধার্থের মুখে শুনতে পাই, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় revolution হলে আমিও লড়ে যেতে পারি।‘ Flash Forward-এ আমরা দেখি সে বোনের boss-কে গুলি করে মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু রূঢ় বাস্তব ও মধ্যবিত্ত অসহায়তা তাকে গ্রাস করে। তাকে চাকরি খুঁজতে হয়। এখানেই মধ্যবিত্তের সংকটতৈরি হয়। এ ছবিতে সিদ্ধার্থ শুধু নায়কই নয়, অপর প্রতিপক্ষও বটে। শেষ কয়েক দশকে সামাজিক ও রাজনৈতিক যে দ্রুত পট পরিবর্তন, পঞ্জীভূত ক্ষোভ ও উত্তেজনার মধ্যে যে অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা, তাতে সে বিপ্লবী হতে চাইলেও বিপ্লবের অংশ হতে পারে না। পিতার মৃত্যু তাকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা থেকে বিচ্যুত করে। চাকরির ইন্টারভিউতে সিদ্ধার্থ বলে, এ শতাব্দীর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এ কথা বললে চাকরি হবে না জেনেও সে বলে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সত্তরের দশকের ক্রোধের সঙ্গে সে একাত্ম হতে পারে না। টাটা সেন্টারের উপর থেকে ‘Top Shot’-এ যখন সে প্রাতিষ্ঠানিকতা বিরোধী বিরাট জন সমাবেশ শহরের রাজপথে দেখে, তখন স্পষ্টতই বোঝা যায় ওই জন সমাবেশের সঙ্গে তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে, কারণ সে নিজে ওই জনগণের অংশ হতে পারছে না। অথচ সে বিপ্লব বিরোধী নয়, আবার বিপ্লববাহীও নয়। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে শেষে চেয়ার টেবিল উল্টে দেওয়ার মধ্য দিয়ে যে সোচ্চার প্রতিবাদ সিদ্ধার্থ করে, তা আসলে ওই সময়ের পঞ্জীভূত ক্রোধের একটা ইমেজ। কিন্তু কোনও সংগঠিত আন্দোলনে সে অংশগ্রহন করে না। তার অবস্থান হয় অপর

    আরও দেখুন

    Ray Revisited - সত্যজিৎ রায়কে TRAP-এর বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি

     

    একান্নবর্তী মধ্যবিত্তের স্থিরীকৃত আবেগ ও মূল্যবোধের সঙ্গে অর্থনৈতিক মন্দার সরাসরি সংঘাত উঠে আসে এ ছবিতে। সিদ্ধার্থ মুখোমুখি হয় অনিশ্চিয়তা ও শূন্যতার। মহানগর’-এ বাস্তববোধ ও বিবর্তিত রূপ আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ফুটে ওঠে। বেকার সমস্যার মধ্যে বাঁচার তাগিদে শুরু হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্বাস ও বিশ্বাসহীনতারও। আর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই দ্বিজবৈশিষ্ঠ স্পষ্ট হয়ে ওঠে সিদ্ধার্থের আত্ম বিক্রয়ের তাগিদে। হস্টেলের ঘরে আদিনাথকে রেড ক্রসের জন্য সংগৃহীত ফান্ড থেকে টাকা সরাতে দেখে, দুশো টাকার ইনক্রিমেন্টে বিকিয়ে যায় সুতপার মূল্যবোধ। আসলে 'Money Plexus'- এর বাইরে যাওয়ার পথগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এক অদ্ভুত ক্রান্তিকাল- যেখানে পুরনো মূল্যবোধগুলি অসাড় হয়ে আসে, কিন্তু নতুনকেও পুরোপুরি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। একটা ব্যুরোক্রেটিক সমাজ ব্যবস্থায় কনজিউমার সোসাইটির মোহ কলকাতার চেহারায় ধরা পড়ে। দেওয়ালে অস্পষ্ট হয় রাজনৈতিক স্লোগানগুলি। Mai Zetterling-এর ‘The Girls’ ছবির ব্যবহৃত অংশটিতে যেখানে আরও অন্য কিছু দেখার আশায় নড়েচড়ে বসে সিদ্ধার্থের বন্ধু।

    প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির শুটিং

     

    অন্যদিকে টুনুর সামাজিক অবস্থান একেবারেই সুতপার বিপরীতে। আবার সিদ্ধার্থ ও টুনু যে একই শ্রেণী চেতনায় তাও নয়। মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যপন্থার প্রতি তার একটা নীরব ঘৃণা চোখে পড়ে। Crisis বলতে সে Political Crisis ছাড়া কিছুই বোঝে না। সংস্কার নয়, বরং অপসারণে সে বেশি আস্থাশীল। চরম পন্থার প্রতি আনুগত্যে টুনু তাই মধ্যবিত্তের পারিবারিক দায়িত্ব সহজেই এড়িয়ে যেতে পারে। সিদ্ধার্থ তা পারে না। ভিসকান্তির রকোরমতো সিদ্ধার্থ তার কেন্দ্রচ্যুত পরিবারের প্রতি একই সাথে দায়বদ্ধ ও যন্ত্রণাবিদ্ধ। আবার শহর জুড়ে যে রাজনীতি চলছে, তার সঙ্গেও একাত্ম হতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই শরীর জুড়ে তার  উদ্দেশ্যহীনতার ক্লান্তি এবং উপায়হীন উদাসীনতা। তাই ওষুধের দোকানে লাজুক কন্ডোম ক্রেতাকে সে তাচ্ছিল্য ভরে দেখে, কিংবা সিনেমা হলে ফিল্ম ডিভিশনের তথ্যচিত্রে ইন্দিরা গান্ধীকে দেখে চোখ বোজে। বোঝা যায়, নেহেরু অধ্যায়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নাগরিকের যে ভূমিকা, তাতে সিদ্ধার্থের আর আস্থা নেই। ঠিক একই ভাবে রাস্তায় এক উদ্ভিন্ন যৌবনাকে দেখেও সিদ্ধার্থের কোনও যুবক সুলভ অনুভূতি হয় না। বরং ক্যামেরা গদারের স্টাইলে abrupt cut করে চলে যায় মেডিক্যাল কলেজের ফিজিওলজি ক্লাসে, যেখানে female breast-কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ (objectivity) থেকে বোঝানো হচ্ছে। এক ধরনের physicalবা sexual inaction তৈরি হয় সিদ্ধার্থের ব্যক্তি চেতনায়। যদিও সে জানে, বর্তমান পরিস্থিতিতে চাকরি মেনে নেওয়া মানে বুর্জোয়া শ্রেণীর অঙ্গীভূত হওয়া। তাই, শেষ পর্যন্ত ব্যুরোক্রেসির শর্তাধীনতার দিকে পিছন ফিরে সিদ্ধার্থ শহর কলকাতার ‘inferno’ থেকে বেরিয়ে যায়। অথবা নির্বাসিত হয় শহর কলকাতার অবস্থানগত চেতনা থেকে। শেষ দৃশ্যে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে freeze shot এ তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। (Trueffant- এর 400 bloows-এর শেষ দৃশ্যের মতো) ওই freeze shot-এ সিদ্ধার্থ দর্শকের সামনে একাধিক প্রশ্নচিহ্ন রেখে যায়। কোনও নৈর্ব্যক্তিক ঔদাসীন্যে নয়। এই প্রশ্ন নগর সভ্যতায় তার’ Generation-এর অস্তিত্বের সংকটের প্রশ্ন। শেষ দৃশ্যের sound track-এ এই সময় ভেসে ওঠে, ‘রাম নাম সত্য হ্যায় রাম নাম সত্য হ্যায়।অনিবার্যভাবেই শেষ লাইনে আসে, ইতি সিদ্ধার্থ। ছবির আনাচে কানাচে, পাখির ডাকের বিন্যাস আখ্যানে Human Essence-কেই Epitomised (প্রতিচ্ছবিত) করে।

     

    প্রতিদ্বন্দ্বীছবিতে কলকাতার যে প্রত্যক্ষ উপস্থিতি দেখি, ‘সীমাবদ্ধছবিতে তা কিছুটা অপ্রত্যক্ষ ভাবেই আসে। এ ছবিতে নায়ক শ্যামলেন্দু তার বাবার পেশা শিক্ষকতা ছেড়ে কলকাতায় আসে কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ হয়ে। যা ক্রমে তার নৈতিক পতনের পথ প্রশস্ত করে। তার স্ত্রীর বোন টুটুল, যে কিনা পাটনা থেকে এসছে, সে বারবার শ্যামলেন্দুর পুরনো জীবনের কথা ভেবে Nostalgic হয়ে পড়ে। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, হাতে বই, সাইকেলে চড়া শ্যামলেন্দুর সঙ্গে আজকের শ্যুটেড-বুটেড কর্পোরেট শ্যামলেন্দুকে মেলাতে পারে না একেবারেই।

    সীমাবদ্ধ ছবিতে শর্মিলা ঠাকুর এবং বরুণ চন্দ

     

    শ্রেণী বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত ভ্যালুজের প্রতি বর্তমান তরুণ প্রজন্মে অসন্তুষ্টি, ক্রোধ কিংবা অস্থিরতা, ব্যর্থতা কিংবা ভাগ্যহীনতার প্রকাশ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় এরপর সামাজিক ব্যবচ্ছেদে প্রয়াসী হলেন। তৈরি করলেন সীমাবদ্ধ’, যা এই সমাজের এক বিশেষ সিস্টেমের চরিত্র হয়ে উঠল। দেশভাগ ও স্বাধীনোত্তর বিপর্যস্ত অর্থনীতি, আশা ও আশাভঙ্গের যে ইতিহাসের মধ্যে তাঁর যে স্বপ্ন ও আদর্শগুলি লালিত হচ্ছিল, সেগুলি মূলত চাকুরিকেন্দ্রিক। টিকে থাকার তাগিদে তার অস্তিত্ব শুধুমাত্র উন্নত জীবিকা বা উন্নততর জীবিকার অবস্থানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অর্থনীতির অসম বণ্টন উদ্ভূত সামাজিক বৈষম্যে জীবনে নিরাপত্তার বিষয়টিকে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তে রূপান্তরিত করেছে। তাই শ্যামলেন্দুর মনে হয় অ্যাম্বিশন পাপ নয়, অ্যাম্বিশন না থাকলে প্রোগ্রেস হয় না।এই অ্যাম্বিশনই তাকে যান্ত্রিক করে তোলে, যেখানে জীবিকা জীবনের থেকে বড় হয়ে যায়। একই সঙ্গে তার উচ্চস্তরীয় লিভিং স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে দেয়, যার নমুনা পরিলক্ষিত হয় তার আট তলার ফ্ল্যাটে বসবাস এবং ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাবে খাওয়া দাওয়ার মধ্য দিয়ে। এই উচ্চ আকাঙ্ক্ষাই তৈরি করে স্ট্যান্ডার্ড, যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতায়নের প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টার পিছনে লুকিয়ে থাকে দুর্নীতি, বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্র। তাই, ফ্যানের বরাত বাতিল হওয়ার শোচনীয় পরিণতি থেকে বাঁচতে শ্যামলেন্দুকে ট্রেড ইউনিয়নের নেতার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতে হয়, যাতে লেবার অ্যাজিটেশন ঘটে এবং কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক এই সময় পরিচালকের ক্যামেরা আসতে আসতে প্যান করে বাথরুমের দরজায় লেখা, ‘জেন্টলম্যান’-এর উপর স্থির হয়। ছোট্ট কমেন্ট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। প্রগতির লক্ষ্যে যে অ্যাম্বিশনের কথা শ্যামলেন্দুর দর্শক শুনেছিল, সেই অ্যাম্বিশন ধরে রাখতে অচিরেই দর্শক প্রত্যক্ষ করল প্রকৃত মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার দুর্নীতিগ্রস্ত পথটি। স্বাভাবিক ভাবেই ছবিতে উঠে আসে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পিতার সঙ্গে তাঁর কৃতী সন্তানের ফর্মাল সম্পর্কটি।  মধ্যবিত্ত পারিবারিক নকশায় আরেক কর্পোরেট মার্জিত সংকট। শ্যামলেন্দুর আট তলার ফ্ল্যাটের জানালায় চোখ রেখে মহানগরের শহুরে সৌন্দর্যে আপ্লুত হয়ে টুটুল বলে ওঠে, ‘ইস। নেপথ্যে তখনই সাইরেন বেজে ওঠে। সূচিত হয় বিপদ সংকেত। যা অচিরেই সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন শ্যামলেন্দুর স্ত্রী দোলনচাঁপা পাশ থেকে বলে ওঠে, "রাত্রিবেলা ভয় করে, দূর থেকে আওয়াজ আসে, বোঝা যায় না কোনটা বোমা কোনটা বন্দুক।" সমকালীন প্রেক্ষাপটে চাকুরিকেন্দ্রিক বাস্তবতার সর্বোত্তম উন্নতিই শেষ কথা। আচার-আচরণ, পোশাক-পরিধানে নিজের স্ট্যান্ডার্ড ও ক্ষমতা 'justify' করার মধ্যে দিয়ে যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক উন্নয়ন ও উচ্চাশা তৈরি হয়, তাকেই পরিচালক এই ছবির একটি চরিত্রে রূপান্তর করেছেন। পাশাপাশি এর প্রতি সংস্কৃতিতে দৃশ্যত হয় শ্যামলেন্দুর নৈতিক মূল্যবোধের অপসারণ- চাকরির সর্বোত্তম স্তরে পৌঁছেও আট তলার ফ্ল্যাটে উঠতে গিয়ে দেখে, লিফট 'আউট অফ অর্ডার'। শরীর জুড়ে তার একরাশ ক্লান্তি। অ্যাম্বিশন আর ক্ষমতার বৈপরীত্যে তৈরি হয় Physical inaction’অথচ সময়ের সম্ভাবনায় প্রতিস্থাপিত শিক্ষিতা সুন্দরী টুটুল, জীবনের সাফল্যের সীমাবদ্ধ চতুষ্কোণ থেকে নিজেকে দ্রুত অন্তর্হিত করেছিল বাইরের ঝোড়ো হাওয়ার ডাকে।

     

    প্রতিদ্বন্দ্বীসীমাবদ্ধ’-র কয়েক বছর পর জন অরণ্য। সিদ্ধার্থর তবু কিছু ক্ষোভ, প্রতিবাদ, প্রশ্ন ছিল। শ্যামলেন্দুর ছিল মার্জিত কর্পোরেটের বহিঃপ্রকাশ। জন অরণ্যে সোমনাথ কিন্তু অসহায়, প্রতিক্রিয়াহীন ঔদাসীন্যে জারিত। আসলে এই প্রোজেক্টে পরিচালকের প্রতিবাদ হয়ে উঠেছিল দুর্বার। সত্তরের দশকের সমাজ ব্যবস্থার আপাদমস্তক দুর্নীতি ও পচনশীল মূল্যবোধকে আপসহীন ভাবে সমগ্র সমাজের কাছে প্রকাশ করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। জীবন সত্যের পিছনে লুক্কায়িত মানুষের অস্তিত্বের স্বরূপ চিনিয়ে দেওয়ার দায় থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারেননি পরিচালক।

    আরও দেখুন

    Ray Revisited - সত্যজিৎ রায়কে TRAP-এর বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি

     

    জন অরণ্য’-র মূল কাঠামোর চিন্তা ভাবনা এ দেশের শিক্ষা পদ্ধতি থেকে শুরু। পরীক্ষার হলে পিতৃসম শিক্ষকদের অগ্রাহ্য করে গণ টোকাটুকি হয়। নিষ্ক্রিয় শিক্ষককুল। আর এখানেই সংকটের জন্ম। মার্কশিট হাতে আসার পর সোমনাথের বাবা বিস্ময় প্রকাশ করেন, ‘সৎ অসৎ মুড়ি মিছরির কোনও প্রকারভেদ নেই।টেলিফোন আসে; সোমনাথের প্রেমিকা অপর্ণা দেখা করে জানায় এই তাদের শেষ দেখা। সোমনাথ সাহসী হতে পারে না। শুধু মধ্যবিত্ত মিথ্যাচারে জানায়, সামনের মাসে চাকরি পাওয়ার কথা, যা সমূলে আছড়ে পড়ে টাইপ রাইটারের ধাতব অক্ষর মালায়। চাকরির আবেদনপত্রের দৃশ্যাংশে। সোমনাথ হারিয়ে যেতে শুরু করে এক বিরাট জনগোষ্ঠীর সাধারণ সংখ্যায়। অর্থনৈতিক নৈরাজ্যে নাভিশ্বাস ওঠা মধ্যবিত্ত জীবনে যেখানে অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিযোগিতা তীব্রতম, সেখানে জীবন বিকিয়ে যায় জীবিকার পশ্চাতে। দশটা পদ, এক লাখ আবেদনপত্র। ময়দানে সোমনাথ ও সুকুমারকে দেখা যায়। ক্যামেরা "টিল্ট আপ" করে ওপরের দিকে উঠতেই ওদের মাথার উপর সৈনিক মূর্তির দুটি পা দেখা যায়। হন্যে হয়ে দুই বেকার যুবকের চাকরি খোঁজা। ভয়াবহ অনিশ্চয়তা, স্বাধীনোত্তর নতুন প্রজন্মের কাছে অর্থনৈতিক সুপার স্ট্রাকচারের ভিত্তিমূলেই যেন অঙ্গুলি নির্দেশিত হয়। চাঁদের ওজন কত?’, প্রশ্নকর্তার এ হেন প্রশ্নের উত্তর জানা নেই সোমনাথের। সে বুঝতেও পারে না, এই চাকরির সঙ্গে চাঁদের ওজনের সম্পর্কটাই বা কী? তাই আবেদনপত্রে ‘Dear Sir’-এর সামনে বারবার প্রশ্নবোধক চিহ্ন পড়ে যায়। সোমনাথ উঠে পড়ে, কিন্তু প্রশ্নবোধক চিহ্নটা থেকেই যায়।

    সীমাবদ্ধ ছবির শুটিংয়ের মাঝে অভিনেতাদের সঙ্গে সত্যজিৎ

     

    1971-এর 15ই আগস্ট সোমনাথ 24 বছর পূর্ণ করে। স্বাধীনোত্তর উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক কাঠামোয় তৈরি হতে চাওয়া ভারতের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি। যে কিনা বড়বাজারের আলোহীন আকাশ বিহীন মারোয়ারি ব্যবসাদারের কাছ থেকে শেখে "এখানেই লক্ষ্মীর বাস। এখানে লক্ষ লক্ষ টাকা হাওয়ায় উড়ছে, যে পারছে ধরে নিচ্ছে।" এক বিরাট ভোগবাদী সমাজ, পার্সেন্টেজ-কমিশনের হিসেব নিকেশ, আর কোম্পানির প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়ার মধ্যে দিয়েই অর্থনীতির কাঠামো সূচিত হয়। উৎপাদন ব্যবসায় প্রত্যক্ষ যোগ না রেখে শুধুমাত্র ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যবর্তী স্তরে অবস্থান নেয় এই স্বাধীনোত্তর তরুণ প্রজন্ম। মিডলম্যান বা দালাল। নটবরদের কাছে জানতে পারে, আসল চাবির সন্ধান পেতে হলে 'Physical Supply' করতে হবে। অর্থাৎ, Physical Supply না করলে Chemical supply-এর অনুমতি পাওয়া যায় না। নিজের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে অবস্থান ও বিশ্বাস এক মুহূর্তে চুরমার হয়ে যায় সোমনাথের। তাই গোয়েঙ্কার হোটেলে মেয়ে মানুষ পৌঁছে দেওয়ার চিন্তায় চাবুক মারে রবীন্দ্রনাথের ছায়া ঘনাইছে বনে বনেগানটি। সোমনাথের চিন্তা প্রবাহে তখন একটিই চিন্তা দালালি

     

    প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, জন অরণ্যে রাস্তা সংক্রান্ত তিনটি ভিন্ন চরিত্র তিনটি ভিন্ন মন্তব্য করেছেন। প্রথমটি, সোমনাথের অনিশ্চিত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তার বাবা বলেন "হয় নষ্ট হয়ে যাও, নয় বিপ্লব করো।ছবির মাঝখানে ব্যবসার শুরুতে বিশুদা কলকাতার পথঘাট সম্পর্কে সচেতন করে বলেন, "দেখে শুনে চলো হে, সর্বত্র পিটফল, রাস্তার তিন অবস্থা...।আরেকবার ছবির শেষাংশে (সোমনাথের ব্যবসায় সাফল্যের নিকটবর্তী অবস্থায়) গোয়েঙ্কা জানিয়ে দেয়, "রোড কানেকশন ভালো হলে ডিসটেন্স ম্যাটার করে না।" এভাবেই পরিচালক সময়ের প্রতিপাদ্যকে ব্যবহার করেছেন। সংকটেই বোঝা যায় সংলাপের লক্ষণীয় দিক (Symptomatic), যা একজন হতাশ, অসহায়, নিষ্ক্রিয় পিতার সংকটকালীন উচ্চারণ। অপর দুটি অবশ্যই উপদেশপ্রদ, যেখানে আর্থিক দুশ্চিন্তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উপযুক্ত পথগুলি দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।

     

    অশক্ত, অসহায় পিতা কেবল যন্ত্রণার সঙ্গে ছেলের ক্রমান্বয়ে নৈতিক পতনের কাহিনী অনুভব করেন। তাই পরিচালক সোমনাথের বাবার মুখে বারবার chiaroscuro (আলো-আঁধার) আলো ব্যবহার করেন, আশঙ্কা (anxiety) ও সংকটের (crisis) চিহ্ন ফুটিয়ে তোলার জন্য। এভাবেই শহর ত্রয়ীতে Father Figure-গুলো moral centre হয়ে যায়, অথচ তারা কেউ মৃত, কারও বা ছেলের সঙ্গে ফর্মাল সম্পর্ক, কেউ বা নিষ্ক্রিয়, অসহায়। আর এই নৈতিক কেন্দ্রিকতার অনুপস্থিতিই মধ্যবিত্তের শহুরে জীবনে সংকট ডেকে আনে।

    জন অরণ্য ছবির একটি দৃশ্য

     

    ফলত, সত্যজিতের ছবিতে এই প্রথম morbidity-র প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। শহর কলকাতা আর তার কাছে ব্রাহ্মমার্জিত মরালিটির Space নয়- অসাড়, অসহিষ্ণু, নৈতিক মূল্যবোধহীনতা, ও অবক্ষয়ের চিহ্ন। স্বাভাবিকভাবেই তার ক্যামেরার ভঙ্গিতেও পরিবর্তন দেখা দিল। সিদ্ধার্থ বা সোমনাথ যখন রাজপথে হাঁটত, তখন উদ্দেশ্যহীনতা "Alineation' বা বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রকাশ করতে সত্যজিতের ক্যামেরা কেন্দ্রীয় ভাগ সময় "long shot' বা "top angle shot'-এর সাহায্য নিল। এই ধরনের "দূরত্ববোধক" (একাকীত্ব তৈরি করা) ক্যামেরা ভঙ্গি কিন্তু মহানগর বা অপুর সংসারে দেখা যায় না। আসলে জনগণের মাঝে থেকেও তারা একা। এই বোধ তৈরি করতে প্রতিদ্বন্দ্বী বা জন অরণ্যে পরিচালক প্রথম বাস্তবধর্মী আখ্যানের সাহায্য নিয়ে সিদ্ধার্থ ও সোমনাথের consciousness-এ ছবিকে প্রকাশ করলেন, তারপর প্রায় documentary-র মতো করে dispassionate (নিষ্কাম) ক্যামেরা পরিচালনার দ্বারা দর্শক মনে Distanciation Effect (দূরত্ববোধক) তৈরি করলেন। এই পদ্ধতির ব্যবহার আমরা আন্তনিওনির স্টাইলে আগে লক্ষ্য করেছি। পরিচালক আন্তনিওনি বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি করতে এই ধরনের "স্থানিক বিচ্ছিন্নতার" সাহায্য নেন।

     

    সত্তরের দশকের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিসরের প্রেক্ষিতে তাই পরিচালকের ছবিতে উঠে আসে, পারিবারিক সংকট (যা মূলত অর্থনৈতিক নৈরাজ্য থেকে আসে), পিতা-পুত্রের সম্পর্কের শীতলতা, মূল্যবোধের ভাঙন, উষ্ণতা বিহীন প্রেম, আর শরীর জুড়ে ক্লান্তি। সত্যজিতের শহর ত্রয়ীর প্রত্যেকটি ছবিই আসলে একই সঞ্চারপথের উপর প্রতিস্থাপিত ভিন্ন ভিন্ন বিন্দু। আসলে পরিবর্তিত কালপটে মূল্যবোধের বিবর্তিত ব্যবচ্ছেদ- শঙ্কা বিপর্যস্ত মধ্যবিত্ত বাঙালির সমাজ জীবন, ভগ্ন অর্থনীতি ও বিচ্ছিন্ন রাজনীতি প্রভাবিত অসম সামাজিক বিবর্তনের চাপে পড়া, একটা গোটা নতুন প্রজন্মের শিকড়হীন হয়ে অবলুপ্তির পথে ভেসে যাওয়ার ইতিবৃত্ত।

     

     

    লেখক রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক


    সৌমিক কান্তি ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    এ আসলে ইতিহাস বিস্মৃত সেই অনসূয়াদের গল্প। যাদের অসূয়া নেই। দেশ নেই। একা পরিযায়ী।

    ফেলুদা মানেই সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানা। আর ফেলুদা মানে অবশ্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

    সত্যজিতের শহর ত্রয়ীর প্রত্যেকটি ছবিই আসলে একই সঞ্চারপথের উপর প্রতিস্থাপিত ভিন্ন ভিন্ন বিন্দু।

    দরিদ্র গ্রাম বাংলার দুই অসহায়, অপাংক্তেয়, অসহনীয়, বাড়তি অথচ ভাষাময় দুটি মুখ।

    শহর ত্রয়ী: সত্যজিতের লেন্সে নগর জীবন দর্শন-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested