তারা বাড়ি ফিরছিল। নিজেদের বাড়ি। পরিজনদের নিরাপদ বাহুপাশে, একান্ত আপন সবুজ গাছগাছালির ছায়ায়। অদ্ভুত নাম "পরিযায়ী শ্রমিক’, ভাবতে গিয়ে মনে হল এ আসলে ইতিহাস বিস্মৃত সেই অনসূয়াদের গল্প। যাদের অসূয়া নেই। দেশ নেই। একা পরিযায়ী। দিন আনা দিন খাওয়া শরীর সর্বস্ব জীবন যাত্রায় কোনও প্রশ্নচিহ্ন না রেখে অভ্যস্ত খেটে খাওয়া নিম্নবর্গীয় মানুষ।
এদের প্রশ্ন করতে নেই; অধিকারবোধে এরা সোচ্চার হতে পারে না। রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করার ন্যূনতম ক্ষমতারহিত একদল শ্রমিক। যাদের হাতে দেশের কাঠামো নির্মিত হয়। যাদের রক্তের টাকায় জোগান স্ফীত করে দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিকে; তারাই আজ ঔরাঙ্গাবাদের রেল লাইনে পড়ে থাকা নাম গোত্রহীন পরিযায়ী শ্রমিক। শুধু সংখ্যায় 16। কিন্তু রুটি আর আচারের বাক্স হয়তো এখনও টাটকা।
‘মেঘে ঢাকা তারা’-এর নীতার কথা ভাবুন। যেখানে নীতা প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করেছিল, অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে মেয়ে তার অথর্ব বাবা, বেকার ভাইয়ের সংসারে একমাত্র রোজগেরে সদস্য। তার টাকায় সংসার চলে। ভাইয়ের প্রয়োজন, বোনের খুশি, দাদার দাড়ি কাটার পয়সা, সবই জোগান দেয় সে। এক মধ্যবিত্ত, স্থানচ্যুত, দেশ বিতাড়িত পরিবারের অর্থাভাবের দৈনন্দিন জীবনের চালচিত্র। আর এই সম্মিলিত পারিবারিক জীবনের যাবতীয় ক্রাইসিসকে নিজের কাঁধে তুলে নেয় নীতা। পরিবারে সে স্বতন্ত্র হয়ে পড়ে। ঠিক যেভাবে আজকের শ্রমিককূল ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর থেকে স্বতন্ত্র। গৃহচ্যুত। অথচ এই মুহূর্তে রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র।
ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-এ যে ভাবে নীতা প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করে সামাজিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয় এবং যক্ষ্মা রোগের মধ্যে দিয়ে তার প্রকাশ ঘটে, একইভাবে রাষ্ট্র নির্মিত লক ডাউন ভঙ্গকারীরা যে ট্রেনে কাটা পড়ে, তা যেন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শাস্তিরই নামান্তর। তাই নীতার শরীরে যক্ষ্মা আবিষ্কারের সময় মেনকার, বিজয়ার বিলাপোক্তি শোনা যায়, "আয় গো উমা, কোলে লই।’ খুব প্রাসঙ্গিক ভাবেই উঠে আসে রবীন্দ্রনাথের, "যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ গানটি। এই গানের ব্যবহার শুধুমাত্র সাঙ্গীতিক প্রয়োজনে নয়, এই গান যেন নীতার তপস্যা সঙ্গীত রুদ্রের জন্য। ট্র্যাজেডি এখানেই। মৃত্যুর সঙ্গে নীতার মিলন যেমন শুধু সময়ের অপেক্ষা তেমনই ওই মানুষগুলোর মৃত্যুও অনিবার্য হয়ে ওঠে যে দিন তারা কাজ হারিয়েছিল, হাঁটতে শুরু করেছিল রেল লাইন ধরে বাড়ির পথে।
কিন্তু কার দোষ? কেন এই মৃত্যু? কে দায়ী? উত্তর মেলেনা, শুধু কিছু প্রশ্ন ভেসে বেড়ায় আজকের দূষণহীন বাতাসে। রবীন্দ্রনাথের গানের শেষে কান্নার শব্দ এবং চাবুকের আওয়াজ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। প্রশ্ন, পরিচালকের এই "কষাঘাত’ কার প্রতি?
দরিদ্র গ্রাম বাংলার দুই অসহায়, অপাংক্তেয়, অসহনীয়, বাড়তি অথচ ভাষাময় দুটি মুখ।
ফেলুদা মানেই সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানা। আর ফেলুদা মানে অবশ্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
এ আসলে ইতিহাস বিস্মৃত সেই অনসূয়াদের গল্প। যাদের অসূয়া নেই। দেশ নেই। একা পরিযায়ী।
সত্যজিতের শহর ত্রয়ীর প্রত্যেকটি ছবিই আসলে একই সঞ্চারপথের উপর প্রতিস্থাপিত ভিন্ন ভিন্ন বিন্দু।