বয়স একটু বেশি হয়ে যাওয়ায় ‘অপরাজিত’-র ‘অপু’ চরিত্রে মনোনীত হননি তিনি। পরবর্তীকালে অভিনয় করলেন ‘অপুর সংসার’-এ। সেই যাত্রা শুরু। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে এরপর বারে বারে ফিরে এসেছিলেন ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে। গ্রেগরি পেক, গ্যারি কুপার প্রমুখ দিকপাল অভিনেতাদের মতোই অভিনয়কে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মজ্জা থেকে রক্তে। নায়ক থেকে চরিত্রাভিনেতা, সর্বত্রই তাঁর সাবলীল অভিনয়ে ঋদ্ধ করেছিলেন চলচ্চিত্র তথা নাটক, থিয়েটারের রঙ্গমঞ্চকে। অবশ্য এ কথা অনস্বীকার্য যে, সত্যজিৎ রায়ের মতো স্রষ্টার সান্নিধ্যে এসেই শিল্পী সৌমিত্র ক্রমান্বয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব, অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধকে প্রতিফলিত ও প্রতিস্থাপিত করার শৈল্পিক পরিসর খুঁজে পেয়েছিলেন।
অপু চরিত্রের মধ্য দিয়ে শিল্পীর ফেলে আসা গ্রামীণ জীবনের স্মৃতি, নবজাগরণের আলোয় উদ্ভাসিত যুবকের নিজের জীবনের কাহিনি নিয়ে উপন্যাস লেখার ইচ্ছা, আবার নিস্তরঙ্গ বেকার জীবনে হঠাৎ করে বিবাহের মতো প্রতিষ্ঠানে মাথা গুঁজে দেবার সাহস, সর্বত্রই অভিনয়ের নিরিখে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অপুর চরিত্রে তাই অন্য কাউকে কল্পনা করাও কঠিন। ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে যে তরুণ অধ্যাপক পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রাস্তায় নেমে গাড়ি ঠেলেন, সে তো একই সঙ্গে নায়ক এবং চরিত্রাভিনেতা। জনপ্রিয় ছবির অতি-রোমান্টিক পরিসর থেকে বিচ্যুত অথচ বিশ্বাসযোগ্য, সুন্দর এবং কাঙ্খিত। ‘ঝিন্দের বন্দি’-তেও তাই ময়ূরবাহন চরিত্রের ক্রুরতা প্রতিষ্ঠিত হলেও, তাঁর হার মেনে নিতে কষ্ট হয় দর্শকদের। ‘দেখা’ ছবিতে অন্ধ শশীর চরিত্রে তিনি যখন সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ চান, তখন তাঁর অভিনয়ের কুশলতায় পুরো স্পেসটাই যেন সলিড পেলব হয়ে ওঠে। অভিনয়ের এমন বুদ্ধিদীপ্ত সাবলীলতা সৌমিত্র চট্টপাধ্যায় ছাড়া খুব কম অভিনেতার পক্ষেই সম্ভব।
তাঁর অভিনয়ের গুণে ‘অশনি সংকেত’-এ দরিদ্র ব্রাহ্মণের চরিত্রটিতে সমকালীন ভারতবর্ষের দারিদ্র, মহামারীর নিদারুণ ছবিটা ফুটে উঠেছিল। ‘চারুলতায়’ অমলের অপেরার ঢঙে ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গানের সঙ্গে যে অভিনয়, তাও বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনব ও ভিন্ন বার্তাবহ। বাংলা চলচ্চিত্র এবং সাহিত্যে অপূর্ব কুমার রায় ওরফে অপু এবং প্রদোষ মিত্র ওরফে ফেলুদা দু’টি কাল্ট চরিত্র, যা সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার নয়। বাঙালির মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ে অন্তহীন অবস্থান এই দু’টি চরিত্রের।
সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট চরিত্র ফেলুদাও শুধু মলাটের ভিতরে আবদ্ধ হয়ে থাকেনি। সেলুলয়েড জগতের হাত ধরে সে কবেই যেন আপামর বাঙালির অতি আপনজনে পরিণত হয়েছে। পুরোদস্তুর বাঙালি হয়েও ফেলুদা চরিত্রটি গৃহপালিত, মাতৃলালিত এবং পত্নীচালিত নয়। ফেলুদা সত্যানুসন্ধানকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ফেলুদা মানে কিন্তু কেবল খুন, জখম, মারামারি কিংবা অ্যাডভেঞ্চার নয়। ফেলুদা মানে সু-শিক্ষা, সু-অভ্যাস, ফেলুদা মানে জটায়ুর হাস্যরস ও তোপসের সাহচর্য। ফেলুদা মানে সিধু জ্যাঠার হাত ধরে অসীম জ্ঞান ভাণ্ডারে প্রবেশ। ফেলুদা মানে তাবড় তাবড় খলনায়কদের সঙ্গে পরিচয়। ফেলুদা মানে মগজাস্ত্রের সাহায্যে জটিল রহস্যের সমাধান আর তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। ফেলুদা মানেই সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানা। আর ফেলুদা মানে অবশ্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
ফেলুদা মানেই সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানা। আর ফেলুদা মানে অবশ্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সত্যজিতের শহর ত্রয়ীর প্রত্যেকটি ছবিই আসলে একই সঞ্চারপথের উপর প্রতিস্থাপিত ভিন্ন ভিন্ন বিন্দু।
দরিদ্র গ্রাম বাংলার দুই অসহায়, অপাংক্তেয়, অসহনীয়, বাড়তি অথচ ভাষাময় দুটি মুখ।
এ আসলে ইতিহাস বিস্মৃত সেই অনসূয়াদের গল্প। যাদের অসূয়া নেই। দেশ নেই। একা পরিযায়ী।