×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দুর্গা তো ইন্দির ঠাকরুনেরই ভাবকন্যা

    সৌমিক কান্তি ঘোষ | 26-08-2020

    পথের পাঁচালী ছবির একটি দৃশ্য।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী চলচ্চিত্রের ইতিহাস যখন চাকচিক্যহীন, প্রথাগত নায়ক-নায়িকা বর্জিত, অনামী সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাগুলিকে মেলোড্রামা রহিত প্রেক্ষাপটে চিত্রায়িত করতে শুরু করল, সেদিন থেকেই নব্যবাস্তববাদ নামক ইজিম-এর হাত ধরে নতুন ধারার চলচ্চিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যেখানে মূলত প্রতিপাদ্য হয়ে ওঠে ছবির বিষয়, কঠোর বাস্তবতা, অস্তিত্ববিহীন প্রান্তিকতা,অর্থাৎ বাস্তবতার আঙ্গিকে জীবনের পর্যবেক্ষণ।

     

    নির্বাক যুগ পেরিয়ে সবাক যুগ, তারও পরে আরও তিন-সাড়ে তিন দশক অতিক্রান্ত হলেও বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র সাদা পর্দায় তখনও সেই অর্থে সাবালকত্ব অর্জন করতে পারেনি। এহেন অবস্থায় ‘পথের পাঁচালী’র আবির্ভাব-আপামর জনসাধারণের কাছে যা ধূমকেতুর মতো। সহজাত জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মনোমোহিনীকর আলো-আঁধারির ঝাউবন পরিবেষ্টিত রোমান্টিকতা বর্জিত অথচ বিষয়বস্তুর নিষ্পৃহ বাস্তবতা, মন্তব্যহীন জীবনের খুঁটিনাটি সম্পর্ক থেকে চলচ্চিত্রের নিজস্ব আঙ্গিক খুঁজে পাওয়ার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

     

    বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর মতো স্বপ্নময় দারিদ্র নমনীয় ছবি সত্যজিৎ বাবু তৈরি করেননি, বরং দারিদ্র, বাস্তব কর্কশতা বার বার গোচরীভূত হয় দৃষ্টিভঙ্গির ভেদে। আসলে সাহিত্যের বাস্তবতার রোমান্টিক পরিসর থেকে পথের পাঁচালী উন্নীত হয় চলচ্চিত্রের কঠোর বাস্তব পরিসরে, যেখানে সবই চোখে দেখা আসলের মতো, আসল নয় আসলের পুনর্নির্মাণ (রেকনস্ট্রাশন অফ রিয়ালিটি) মাত্র। শস্য শ্যামলা সোনার বাংলা নয়, দরিদ্র বাংলার হতদরিদ্র ব্ৰাহ্মণ হরিহর; বিপন্ন সংসারের বিষণ্ণ কাণ্ডারি। অতি সাধারণ, প্রায় নিম্নবর্গীয় পরিসরে উত্তীর্ণ হয়ে সে ধুতির কোঁচা দিয়ে বগলের ঘাম মোছে, যা মোটেই দৃশ্যগত দিক থেকে নান্দনিক নয়। একইভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে ইন্দির ঠাকরুনের রোদে ঝলসানো লোলচর্ম পিঠ কিংবা কালো শীর্ণ আঙুলে বাটিতে ভাত চটকাবার দৃশ্যটি। মনে রাখতে হবে বিভূতিভূষণের সাহিত্যের ‘ফিলোসফি অফ ওয়ান্ডার’, সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’তে অনুপস্থিত। বিষয়বস্তুর বাস্তবতা এভাবেই ধরা পরে পথের পাঁচালীর চলচ্চিত্রায়নে, এভাবেই পথের পাঁচালী হয়ে ওঠে বৃহৎ, মহৎ ও প্রকট। যা সুন্দর তা সুন্দর, যা নয় তা নয়।

     

    চলচ্চিত্র আর সাহিত্যের পরস্পর বিরোধিতা কিংবা দ্বান্দ্বিক অবস্থান শুধু উপাদানগত। অর্থাৎ, দৃশ্যদানের ক্ষেত্রে, সাহিত্যে কতটা সিনেম্যাটিক এলিমেন্ট আছে, পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন সবই পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি মাধ্যম থেকে অপর একটি স্বতন্ত্র মাধ্যমে প্রতিস্থাপন জনিত। সর্বজয়া দুর্গার চুলে একটান দিয়ে বলে ‘ফের মিথ্যে কথা’, যা গ্রামবাংলার চিরাচরিত মাটির দাওয়াগুলোয় আজও দরিদ্র মা-মেয়ের সম্পর্কগুলোর কঠিন বাস্তবতাকে অবলোকন করে। শত ছিন্ন শাড়িতে রাত্রির আবছায়ায়, ‘হরি দিন তো গেল সন্ধে হল পার করো হে আমারে,’ চুনিবালার সাদা গলার গানের সঙ্গে মাটির ঘরের দেওয়ালে হালকা প্যান শটে বহু শব্দের অন্তর্ভুক্তিকে নিমেষে অর্থহীন করে।  ইন্দির ঠাকরুনের চলে যাওয়া কার্যক্ষেত্রে সময়ের বাস্তবতাকে মনে করায়। ক্রমান্বয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ঘনীভূত করে রাত্রির গভীরতাকে, বাছুর টানতে টানতে অপু প্রথম অনুভব করে কী অবলীলায় মৃত্যু গ্রাস করে পিসিকে। ঘটি গড়িয়ে যায় নদীর জলে, ভাসতে থাকে আপন ছন্দে। মুক্তির আনন্দে, হিন্দু শাস্ত্রের আত্মার মুক্তিকে এমন চিত্রকল্পে উপস্থাপন তো এই ছবিই প্রথম দেখতে শেখায়। পরে ‘অপরাজিত’ ছবিতে এই চিত্রকল্পেরই সম্প্রসারিত রূপটি প্রতিভাত হয়, গঙ্গার ঘাটে, হরিহরের মৃত্যুতে একঝাঁক পায়রার আকাশের বুকে উড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।

     

    তাই সাহিত্য ও চলচ্চিত্র পারস্পরিক সাহচর্যে নাকি পরাক্রমী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হবে সেই বিতর্কটা চলতেই থাকবেভিন্ন ভিন্ন সাহিত্য ও চলচ্চিত্র প্রেক্ষিতানুসারে তাদের আলোচনা প্রয়োজন। যেমন- ‘নষ্টনীড়’, ‘চারুলতা’ ইত্যাদি। দুর্গার মতো দিদিকে ভোলা যায় না। আসলে দুর্গাই একমাত্র দিদি, যার অপুর মতো হাজার হাজার ভাই আছে। আসলে আমরা সবাই অল্পবিস্তর অপু, যে দিদির সমস্ত কর্মকাণ্ডই বিস্ময়ের সঙ্গে অবলোকন করে। দিদির প্রতিটি অবস্থান, পদক্ষেপ, তার কাছে নতুন কিন্তু অনভিপ্রেত নয়। দিদির পদচারণার পশ্চাদচারণা তার দৈনন্দিন জীবনে একাত্ম হয়ে যায়। মায়ের রাগ পড়লে দৌড়ে দিদিকে ডাকতে যায় ভাত খাওয়ার জন্য। হৃদয়ের উৎফুল্লতা একরাশ হাসি হয়ে ফুটে ওঠে শিশুমুখে- ‘দিদি মা ডাকছে...’। অপুর আর এক নিদারুণ বিস্ময় তার পিসি ইন্দির ঠাকরুন। তার ফোকলা দাঁতের হাসি, মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে দু’দিন উধাও হয়ে যাওয়া, দিদিকে মারের হাত থেকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়া, আবার রাতের বেলায় হাঁউ মাঁউ খাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া - সব মিলিয়ে গ্রাম্য জীবনে অপুর ছেলেবেলা সাহিত্য সৃষ্টির মর্মরসের প্রাঙ্গনে চলচ্চিত্রের আঙ্গিকে প্রতিপালিত হয়ে ওঠে।

     

    পথের পাঁচালী’তে পুরুষ চরিত্রগুলির থেকে নারী চরিত্রগুলি সামাজিকতার নিরিখে বেশি স্থান দখল করে আছে। সর্বজয়া, সেজঠাকরুন, বিনির মাকে বাদ দিলে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে দুর্গা ও ইন্দির ঠাকরুন। বার বার টু কম্পোজিশন ফ্রেমে তাদের একত্রে দেখা যায়। দরিদ্র গ্রাম বাংলার দুই অসহায়, অপাংক্তেয়, অসহনীয়, বাড়তি অথচ ভাষাময় দুটি মুখ। আসলে দুর্গা ও ইন্দির ঠাকরুন তো একটা গোটা জীবনের শুরু ও শেষ। গ্রাম বাংলার দুই অবহেলিত নারীর এমন সহাবস্থান খুব কম ছবিতেই দেখা যায়। চুরি করে আনা পেয়ারা তাই তো পিসির চোখের সামনে তুলে ধরে দুর্গা। শুধু তাই নয়, দু’জনের জীবনের ওঠাপড়ায় কী অসাধারণ মিল। কারণ দু’জনেই সর্বজয়া কর্তৃক অবহেলিত, লাঞ্ছিত এবং শাসিত। পুরুষতান্ত্রিক গ্রাম্য সমাজ, অথচ দুর্গা কিংবা ইন্দির ঠাকরুন নির্দিষ্ট কোনও পুরুষের দ্বারা সরাসরি নির্যাতিতা নয়। দুর্গার চোর অপবাদ সেজঠাকরুনেরই দেওয়া। উঠোনের মধ্যে চুল ধরে মারতে মারতে টেনে নিয়ে যায় সর্বজয়াই। ‘বৌ খাচ্ছিস’, চাঁদি ফেটে যাওয়া রোদে উঠোনে দাঁড়িয়ে জলতেষ্টায় কাতর, ক্ষুধার্ত, শীর্ণ বিধবা যখন জানতে চায়, বৌ তখন ঘোমটা টেনে পিছন ফিরে দুধের বাটিতে চুমুক লাগায়। এই খানেই পথের পাঁচালীর মাহাত্ম্য- মন্তব্যহীন, নিষ্পৃহ কিন্তু চলমান।

     

    ছবিতে আমরা কখনওই সেভাবে দুর্গাকে সর্বজয়ার কাছে আদর পেতে দেখিনা। সাধারণ চোখে তার মানে এই নয় যে মা-মেয়ের বিরোধ,বরং এর অন্তর্নিহিত ভাব ও তৎকালীন (যা এখনও প্রাসঙ্গিক) প্রেক্ষিত হল, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মা-মেয়ের ক্ষয়িষ্ণু, কর্তব্যজনিত বাধ্যবাধকতায় পালিত হওয়া সম্পর্ক। বহু আলোচিত পরের বাড়ির মেয়ে হয়ে যাওয়ার ‘সোশাল ডিসকোর্স’ এবং অবশ্যই  ছেলে হয়ে জন্মানোর আকাঙ্ক্ষাগত ডিসকোর্স, যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে স্থায়িত্ব দেয়। যা দেখে থাকি অপুর ক্ষেত্রে, তা দুর্গার ক্ষেত্রে দেখি না। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে অপু স্কুলে যায়, ঠিক সেই মুহূর্তে ক্যামেরা টপ অ্যাঙ্গেল শটে লক্ষ্য করায় উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে দুর্গা। বাস্তবতা এটাই যে,বাড়ির মেয়ে উঠোন ঝাঁট দেবে, জল তুলবে, রান্না শিখবে, ক’দিন পরে বিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে... তারপর? এ কালের কণ্ঠস্বর, উত্তর দিতে গেলে কণ্ঠ কাঁপে, হৃদয় বিদীর্ণ হয়। একদিন বৈধব্য সঙ্গে করে দুর্গারা ফিরে আসে ইন্দির ঠাকরুন হয়ে, বোঝা হয় হরিহরদের মতো ভাইদের আধভাঙা সুখের সংসারে। ভাঙা বাক্স-পেঁটরা আর ছেঁড়া মাদুরকে সম্বল করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া। অথবা অনতিদূরে হরিহরের কাছে কাতর আকুতি, শতছিন্ন চাদর, শীত আসছে। হরিহরের আশ্বাস সে দেবে। ভাঙা, ক্ষয়ে যাওয়া দরজা, পোড়ো ভিটে, ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা গৃহস্থালির জিনিসের মাঝে দাঁড়িয়ে ইন্দির ঠাকরুনের ফোকলা দাঁতের একগাল হাসি সমগ্র পরিবেশকে দর্শকের কাছে বড় চেনা, বড় আপনার করে তোলে। সুন্দর-অসুন্দরের টানাপোড়েনে, সাদা কালোর কর্কশতায় চলচ্চিত্র তখন বিষয়গত বক্তব্য রহিত এক মানবতার আলেখ্য আখ্যানে গতিশীল। তাই, ভাত হাতে অপুর পিছনে ছুটে ব্যর্থ হয়েও সর্বজয়ার মুখে তৃপ্তির হাসি অথচ একটিবারের জন্যও দুর্গাকে ভাত বেড়ে দেওয়ার দৃশ্য সরাসরি ফ্রেমে আসেনা। কারণ গ্রাম্য জীবনে মেয়ের চেয়ে ছেলেরা অনেক বেশি গ্ৰহণযোগ্য এবং তা বেশ প্রকট হয়ে ধরা পড়ে এই চিত্রকল্পে। সর্বজয়ার কাছে দুর্গা অনেক আগেই ব্রাত্য ছিল। এখন অপুর জন্মের পর দুর্গা সংসারে ‘বাড়তি’ হয়ে যায়। তাই ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যু যে দুর্গার মৃত্যুর অনুষঙ্গ নিয়ে আসবে সেটাই স্বাভাবিক।

     

    বয়ঃসন্ধির প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে রানুর বিয়ে দুর্গার মনে অগাধ সাধের সৃষ্টি করে। ব্রত পালন করা, চোখে কাজল, কপালে টিপ, আয়নায় নিজের মুখ দেখা, নারী হয়ে ওঠার দুর্বার ইচ্ছায় সংযত হয় সে। তুলসীতলায় চারাগাছ পুঁতে জল দিয়ে ব্রতর ছড়া কাটে, ‘পুণ্যি পুকুর পুষ্পমালাকে পূজেরে দুপুরবেলা, আমি সতী লীলাবতী, ভায়ের বোন ভাগ্যবতী, স্বামীর কোলে পুত্র রেখে মরণ হয় গো যেন গঙ্গাজলে।’ আমরা স্তম্ভিত হই, এতো প্রাক-বৈদিক যুগের এক মাতৃতান্ত্রিকতার বিবর্তিত বিতর্কিত লুপ্তপ্রায় রিচুয়াল। একটি পূর্ণ শৈল্পিক অখণ্ড ফেমিনাইন ইমেজ,যা বহুস্তরীয়- যেখানে পরিচালক স্পষ্ট করে দিতে চান দুর্গার অমোঘ পরিণতি, শেষ বারের মতো জীবনের আয়নায় মুখ দেখে মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত হয় সে। ‘দিদি তুই রেলগাড়ি দেখেছিস?’ সেই অতি পরিচিত চিত্রকল্প, কাশফুলের রাজকীয় বৈভবের মধ্যে দিয়ে ভাই-বোনের ছুটে যাওয়া, কিন্তু ট্রেনের কাছে পৌঁছায় শুধু অপু (মনে রাখতে হবে অপু-দুর্গা কোনওদিনই একসঙ্গে ট্রেন দেখেনি)। দুর্গা পায়ে ব্যথা নিয়ে কাশবনেই বসে পড়ে। এক অনিবার্য রূপকার্থে নির্মিত এই চিত্রকল্প বুঝিয়ে দেয় দুর্গার পরিসরের ব্যাপ্তি নির্দিষ্ট, যেখানে দুর্গা কোনওদিনই তার গ্রাম্য-কিশোরী জীবন ছেড়ে, তার অনিবার্য নিয়তিকে অতিক্রম করে আধুনিকতার বাষ্পশকট চড়ে কোনও রূপকথার রানীর আসন অলঙ্কৃত করবে না। বরং, একদিনের তুমুল বৃষ্টিতে ভাই-বোনে কাকভেজা হওয়ার অনুষঙ্গে, এক চিলতে কাপড় দিয়ে নিঃশেষে ভাইকে বৃষ্টি থেকে আড়াল করবে। প্রকৃতির চূড়ান্ত পরাক্রমে আক্রান্ত নারী হয়ে শক্তির জাগরণের মধ্য দিয়ে দুর্গা তখন দিদি নয় ‘মা’, মানবী নয় দেবীতে উন্নীত আদিম মাতৃশক্তির প্রতিভূ হবে। স্বাভাবিক ভাবেই মানবী আক্রান্ত হবে প্রতিষ্ঠান বা ঈশ্বর কর্তৃক। সভ্য সমাজের চরমতম বিস্ময় মৃত্যু। এর আভাস অবশ্য পরিচালক আগেই দেন। ওই প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে দুর্গা যখন চুল ঝাপটায়, মাথা নিচু করে ক্রমান্বয়ে সামনে-পিছনে করতে থাকে, তখন এক নিমেষে আমাদের সমস্ত সত্তাকে এক গ্রামীণ ঈশ্বর প্রাপ্তির ‘রিচুয়াল’-এ সংবদ্ধ করে। আমরা একেই ‘ভগবানের ভর’ বা ঠাকুর ‘ভর’ করেছে বলে থাকি। একই সঙ্গে পরম শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, মনোস্কামনা পূরণের সহজ ঐশ্বরিক পথ অবলম্বন করি। দুর্গার মাতৃতান্ত্রিকতার ইমেজের পরিষ্কার পরিস্ফুটন ঘটে, পরিণতির অবকাশ থাকে শুধু সময়ের অপেক্ষায়।

     

    তাই দুর্গা তখন আর রক্ত মাংসের মানবী থাকে না, তার অবয়ব পরিণত হয় ‘সিলুয়েটে’ আর ওই সিলুয়েটের ফ্রেমই পরিষ্কার করে দেয় দুর্গার ‘আর্কিটাইপাল’ অবস্থান। নারীশক্তির উপর একক ক্লিষ্ট জয় সম্ভব নয় জেনেই যেন রাতের গভীরতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে প্রকৃতির ও ঈশ্বরের  যৌথ প্রয়াস। প্রচণ্ড ঝড়ের সঙ্গে দামালবৃষ্টির যুগলবন্দি, ঝড়ের ঝাপ্টা আছড়ে পড়ছে ভাঙা দরজা, নড়বড়ে খিলের উপরে। সর্বজয়ার উৎকণ্ঠার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্গার দেহের তাপ। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুতের চমক, ঘরের তাকের উপরের গণেশ মূর্তির ঝলকানি তারপর সব শেষ। স্তিমিত, নিস্তব্ধ। ক্যামেরা এবং সম্পাদনার যুগলবন্দিতে যে চিত্রকল্প তৈরি হয়, তা আজও বিশ্ব চলচ্চিত্রের আঙ্গিকে অনবদ্য। কাপড়ের খুঁট দাঁতে চেপে সর্বজয়ার মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই, ‘দুগ্গা ‘মিজ অন সিন’-এর সুষম ব্যবহার আর ক্যামেরার কৌশলে পরিচালক যে ছায়াকল্পের আর্ত হাহাকার তৈরি করে, তাতে অচিরেই দুর্গা মায়ের মেয়ে থেকে সন্তানে পরিণত হয়।

     

    আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না ইন্দির এবং দুর্গার নিজস্ব পরিসরগুলি আসলে একটাই পরিসর। গ্রাম্য জীবনের প্রতিনিয়ত ঘটমান চড়াই-উতরাই সঞ্চারপথের উপর দু’টি বিশিষ্ট বিন্দু দুর্গা এবং ইন্দির ঠাকরুন। আসলে একটি বিন্দুর উপর অপরটি প্রতিস্থাপিত। মূল গল্পে ইন্দির ঠাকরুনের একটি মেয়ে ছিল। নাম বিশ্বেশ্বরী। চলচ্চিত্রে ইন্দির ঠাকরুনের কোনও মেয়ে নেই। এখানে আছে দুর্গা,সে যতটা না সর্বজয়ার তার থেকে অনেক বেশি ‘পিসির মেয়ে’।

     

     


    সৌমিক কান্তি ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    ফেলুদা মানেই সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানা। আর ফেলুদা মানে অবশ্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

    সত্যজিতের শহর ত্রয়ীর প্রত্যেকটি ছবিই আসলে একই সঞ্চারপথের উপর প্রতিস্থাপিত ভিন্ন ভিন্ন বিন্দু।

    দরিদ্র গ্রাম বাংলার দুই অসহায়, অপাংক্তেয়, অসহনীয়, বাড়তি অথচ ভাষাময় দুটি মুখ।

    এ আসলে ইতিহাস বিস্মৃত সেই অনসূয়াদের গল্প। যাদের অসূয়া নেই। দেশ নেই। একা পরিযায়ী।

    দুর্গা তো ইন্দির ঠাকরুনেরই ভাবকন্যা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested