ভোটের আগে বিজেপি-বিরোধী পোস্টার মারার দায়ে রীতিমতো হুমকি দিয়ে কালা কানুন বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধআইন UAPA প্রয়োগের ভয় দেখাল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন রেল সুরক্ষা বাহিনী। কলকাতার কাছেই হুগলি জেলার ঘটনা। তবে ঘটনার নির্দিষ্ট স্থান, কাল, চরিত্রের নাম উহ্য রাখতে হচ্ছে, কারণ কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-তরুণরা সত্যিই রাজরোষের ভয় পাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহেই একটি রাজনৈতিক মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত কিছু তরুণ-তরুণী পূর্ব রেলের হাওড়া ডিভিশনের এক গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে পোস্টারিং করছিলেন। পোস্টারে ইংরেজি, বাংলা এবং হিন্দি— এই তিন ভাষায় বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছিল। কিন্তু কোথা থেকে রেল সুরক্ষা বাহিনীর রাজপেয়াদা এসে তাঁদের টেনে নিয়ে গেল থানায়। হিন্দিতে যৎপরোনাস্তি গালাগালও দিল। এতটুকুর মধ্যে শ্লীল-অশ্লীলের প্রশ্নটুকু বাদ দিলে অন্যায়ের কিছু ছিল না। সরকারি সম্পত্তিতে ‘বেসরকারি’ পোস্টারিং অপরাধ তো বটেই। কিন্তু অপরাধের শাস্তিটাও বেশ জমকালো!
ধৃতদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারই বিবরণ শোনাল। বাহিনীর পদস্থ কর্তা প্রথমেই ফোন কেড়ে নিলেন। পোস্টারের বয়ান দেখে চোখ কপালে তুলে ভাঙা বাংলায় বললেন, ‘নো ভোট টু বিজেপি! বিজেপির সরকার রেল চালাবে, আর তোমরা সেই রেলকে ব্যবহার করে দেশের নিন্দামন্দ করবে? এসব তো অ্যান্টি-এসট্যাবলিশমেন্ট (প্রতিষ্ঠান বিরোধী) ব্যাপার আছে। তোমদের ইউএপিএ দেওয়া হবে।' রাজপেয়াদারা রাজানুগ্রহে থাকেন, ঊর্ধ্বতনের তোষামোদেই তাদের যাবতীয় আমোদ। তাই, কাকে বলে রাষ্ট্র আর কাকে বলে দেশ, শাসক দলের বিরোধিতা যে দেশদ্রোহিতা হতে পারে না, তা তাদের বোঝানো সাধ্যাতীত।
পোস্টার মেরে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে আসাদের মধ্যে একজন জানালেন, ‘হয়তো আমরা রেলের জায়গায় পোস্টারিং করে ভুল করেছি। কিন্তু আমাদের পোস্টারের পাশেই যে আরএসএস-এর ‘ভারতমাতা পূজন’ এবং বিজেপির রাজনৈতিক দাবি সংবলিত পোস্টার আছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে রেল রক্ষী বাহিনী কোনও ব্যবস্থা নেয় না কেন?’ বাহিনীর পদস্থ এক কর্তার দাবি, ‘ওরা যখন পোস্টারিং করে, তখন হয়তো আমরা তাদের দেখতে পাই না। কিন্তু দেখতে পেলে ব্যবস্থা তো নেওয়া হবেই।'
কিন্তু তাই বলে ইউএপিএ? সামান্য পোস্টারিং করার অভিযোগে কলেজ পড়ুয়া কিছু ছেলেমেয়ের বিরুদ্ধে দেশের ঐক্য বিনষ্ট এবং সার্বভৌম ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করার গুরুতর অভিযোগ? অখণ্ড ভারতের উদগাতা শাসকের শাসন এতই ঠুনকো যে কিছু পোস্টারেই দেশের ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যাবে? কবি তো তাঁর সত্যদর্শনে দেখেছিলেন, ‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে, বলে তার শতগুণ।' বাবু যখন অশীতিপর সমাজকর্মী ভারভারা রাও কিংবা স্ট্যান স্বামীদের বিরুদ্ধে এই কালা ইউএপিএ আইনে ব্যবস্থা নিতে তৎপর, পারিষদবর্গ কিছু কচিকাঁচাকেই পাকড়াও করে বাবুর পথ অনুসরণ করছেন।
রাষ্ট্রের দাঁত-নখ যে কত প্রকারে, কত মাধ্যমে বিকশিত হচ্ছে, তা এই ছোট ঘটনাটি থেকেই বোঝা যায়। নিরাপত্তার কারণে ঘটনার চরিত্ররা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে বারণ করলেন ঠিকই, কিন্তু এই ঘটনা লেখা থাকল, ভবিষ্যতের জন্য, যে ভবিষ্যত অতীত খুঁড়ে দেখতে চাইবে, কল্যাণকামী রাষ্ট্র কীভাবে তার একনায়কতন্ত্রী মনোভাবের স্বাক্ষর রাখছিল।
আরও পড়ুন: বেনামী লাল পোস্টারে ছয়লাপ বাংলা
সম্প্রতি দেশের শীর্ষ আদালত একটি মামলার সূত্রে জানিয়েছে, ‘সরকারের সঙ্গে সুর না মেলালেই কাউকে দেশদ্রোহী বলা যায় না।' কিন্তু, বিগত কয়েক বছরে বারবার দেখা গেছে সরকারের সঙ্গে ব্যক্তির সুর না মিললেই তাকে অ-সুর বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ নিয়ে কয়েক বছরের কয়েদবাস অতিক্রম করেও সেই ব্যক্তি জানতে পারেননি, তিনি কীভাবে, কোন অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহী হলেন! ক্ষমতার গিলোটিনে মাথা কাটতে কাটতে একদিন গিলোটিনও বিদ্রোহ করে বসে, ক্ষমতার আস্ত মাথা কেটে তখন বিপ্লব আসে। যেমন 1789-এর ফ্রান্সে হয়েছিল। শাসক ইতিহাস পড়ে না, পড়তে চায় না। তাই একই ভুলের পুনারাবৃত্তি বারবার হয়।
তাঁদের খামখেয়ালিপনায় আরও অনেক মানুষকে আমাদের হারাতে হবে না তো?
ন্যুব্জ বাপুজি, আর চাকচিক্যহীন বাপুজি কেকই তো ভারতবর্ষকে মিলিয়েছে বার বার।
নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে গণতন্ত্রের চূড়ান্ত অবমাননা থেকে নিষ্কৃতির পথ কি আমেরিকার গৃহযুদ্ধ?
বাংলায় রাজনীতি করে বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিকে নিয়ে এমন সংশয় তৈরি করতে পেরেছেন আর কোন রাজনীতিক?
জীবনের সায়াহ্নে এসে পরিচিত মানুষদের শঠতা, কৃতঘ্নতায় আঘাত পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।
সৃষ্টি আর লয় হাত ধরাধরি করে চলে বর্ষায়, তবু আমরা বর্ষার জলে ভিজতে চাই, ভাসতে চাই।