×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • যিনি সুদূরবর্তী, স্পর্শ করো ওকে, ওকে জাগাও!

    4thPillars ব্যুরো | 02-04-2020

    হিন্দোল ভট্টাচার্য

    অনেকেই মনে করেন মানব সভ্যতার প্রথম সাহিত্য: গিল্গামেশ-কাব্যবাংলা ভাষায় একাধিকবার অনূদিত হয়েছে তা। সেইসব অনুবাদের মধ্যে অন্যতম গৌতম বসু’র ‘গিল্গামেশ-কাব্য’। বইটি পড়লেন হিন্দোল ভট্টাচার্য

     

    যিনি সুদূরবর্তী”, স্পর্শ করো ওকে, ওকে জাগাও!’

    হিন্দোল ভট্টাচার্য

     

    খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে উরূকবাসী যে রাজার নানা পর্যায়ের মধ্যে গিয়ে যাওয়া গৌরবগাথা দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়েছিল নিনেভের কুয়ুনজিক ঢিবির নীচে রক্ষিত সেই সময়ে নির্মিত সুবিশাল এক গ্রন্থাগারের মৃৎফলকে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় ভাষায় লেখা গিল্গামেশ কাব্যের মধ্যে, তা যে ইতিহাসের গর্ভ থেকে উঠে এসে আজ সারা বিশ্বেই মানুষকে চমকিত এবং বিস্মিত করছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অনেক ভাষায় অনুবাদ বেরিয়েছে তার। এই বাংলা ভাষাতেও গিল্গামেশ অনূদিত হয়েছে বেশ কয়েকটি। আমরা পড়েছি সুজন ভট্টাচার্যের অনুবাদও। এই সব অনুবাদগুলির মধ্যে তুলনা করা এই আলোচনার লক্ষ্য নয়। কিন্তু গৌতম বসু তাঁর ‘গিল্গামেশ’-এর অনুবাদে যে সমৃদ্ধ ভূমিকা আমাদের উপহার দিলেন, তাতে মনে হয় আমরা এই প্রাচীনতম মহাকাব্যের অনেক কাছাকাছি যেতে পারলাম।

    অন্তত পাঠক হিসেবে আমি বলতে পারি, গিল্গামেশ নিয়ে এত সমৃদ্ধ ভূমিকা আমি এর আগে পড়িনি অন্তত বাংলা ভাষায়। এর আগে অ্যান্ড্রু জর্জের অনুবাদের বইটিতে যে ভূমিকা ছিল, তা পড়া ছিল। সে ভূমিকাও গিল্গামেশকে ধরার জন্য এক অতি উন্নত মানের ভূমিকা। কিন্তু অ্যান্ড্রু জর্জের ভূমিকার সঙ্গে গৌতম বসুর ভূমিকার পার্থক্যের জায়গাটি হচ্ছে, গৌতম বসুর এই ভূমিকাটি ইতিহাসকে আশ্রয় করে যেমন রচিত, যেমন তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এখানে দেওয়া আছে, তেমন, রয়েছে, গিল্গামেশ রচনার সত্ত্বাটিকে স্পর্শ করার প্রচেষ্টাও। একজন পাঠক যদি এই সত্ত্বাটির সদর দরজা হিসেবে গৌতম বসুর এই ভূমিকাটুকু পড়েন, তাহলেই তিনি প্রবেশ করবেন পৃথিবীর ইতিহাসের এক রহস্যময় মহাকাব্যের জগতে। এই ভূমিকাটিকে গৌতম বসুর গিল্গামেশ সম্পর্কিত শুধু ঐতিহাসিক কিছু তথ্যের ভাণ্ডার বললে ভুল হবে। বরং বলা যায়, এই ভূমিকাটিতে এমন কিছু ভাবনার অবতারণা আছে, যেগুলি আমাদের ভাবনাজগতকেও বেশ খানিকটা ঝাঁকিয়ে দেয়। যেমন বলা যায়, এনহেডুয়ান্না সম্পর্কিত তাঁর ভাবনাটিতে- “এনহেডুয়ান্না লিখেছিলেন, ‘তোমার আদেশে আমি গর্ভগৃহে প্রবেশ করেছিলাম/ আমি, প্রধান পূজারিণী এনহেডুয়ান্না!/ আমি তুলে ধরলাম অর্ঘ্যথালি, গুণকীর্তন করলাম তোমার/ আর আজ, কুষ্ঠরোগীদের মাঝে আমি নির্বাসিত!’ প্রশ্ন উঠতে পারে, গিল্গামেশ-কাব্যের রচয়িতা কেন এই সুর আপন করে নিলেন না? কেন তাঁর সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম? এর একটিই কারণ আমরা অনুমান করতে পারি।

    গিল্গামেশ-কাব্যের রচয়িতা একজন এপিক-কবি, নির্লিপ্ত ও সংযমী। নিজের কথা বলার অধিকার তিনি বিসর্জন দিয়ে এসে লিখতে বসেছেন। “মহাকাব্যের অতিকঠোর সংযম ভেঙে গীতিকবিতার জন্ম হয়েছিল এ কথাই আমরা জানি। কিন্তু ‘আমরা একটি ভিন্ন ছবি দেখছি মেসোপোটেমিয়ায়, বিস্ময়ভরে লক্ষ করছি, লিরিক ও এপিক ধারা দুটি কেবল সমান্তরাল নয়, এমনও হতে পারে লিরিক এপিকের অগ্রজ। প্রসঙ্গটি অদ্যাবধি অবহেলিত এবং যতদিন-না একটি সন্তোষজনক মীমাংসাসূত্র উঠে আসছে, ততদিন পূজারিণী এনহেডুয়ান্না সুবিচারের আশায় অপেক্ষা করে থাকবেন

    গিল্গামেশ-কাব্যের রচয়িতা একজন এপিক-কবি, নির্লিপ্ত ও সংযমী। নিজের কথা বলার অধিকার তিনি বিসর্জন দিয়ে এসে লিখতে বসেছেন। “মহাকাব্যের অতিকঠোর সংযম ভেঙে গীতিকবিতার জন্ম হয়েছিল এ কথাই আমরা জানি। কিন্তু ‘আমরা একটি ভিন্ন ছবি দেখছি মেসোপোটেমিয়ায়, বিস্ময়ভরে লক্ষ করছি, লিরিক ও এপিক ধারা দুটি কেবল সমান্তরাল নয়, এমনও হতে পারে লিরিক এপিকের অগ্রজ। প্রসঙ্গটি অদ্যাবধি অবহেলিত এবং যতদিন-না একটি সন্তোষজনক মীমাংসাসূত্র উঠে আসছে, ততদিন পূজারিণী এনহেডুয়ান্না সুবিচারের আশায় অপেক্ষা করে থাকবেন

    কবি গৌতম বসু এভাবেই গত বেশ কয়েকবছর ধরে তাঁর অনুবাদ এবং গদ্যে, ভাবনায় আমাদের চিন্তাজগতে অন্য ভাবনার ছাপ রেখে যাচ্ছেন। বেশ কিছু প্রশ্ন এবং প্রসঙ্গের উত্থাপন করে যাচ্ছেন উপযুক্ত যুক্তি, ইতিহাস এবং তথ্য সহ। মনে হয়, চিন্তাজগতে এবং ইতিহাসকে নতুন করে দেখার জগতে আমাদের গৌতম বসুর এই সব ভাবনার কাছে আবার ফিরে আসতেই হবে।

    আরও পড়ুন:

    হেরো মানুষদের কথা: একরাম আলি

    আসলে গৌতম বসুর এই ভূমিকা নিয়েই পাতার পর পাতা লিখে চলা যায়। এত অসংখ্য প্রসঙ্গের অবতারণা তিনি করেছেন, তাতে যেমন গিল্গামেশ মহাকাব্য এবং তার ইতিহাস আমাদের কাছে আরও স্পষ্টভাবে ধরা দিচ্ছে, তেমন আমরা পাঠক হিসেবেও একটা প্রস্তুতি নিয়ে এই মহাকাব্যটির অনুবাদের দিকে যেতে পারছি। যেমন, রিলকের ভাবনাচিন্তার সঙ্গে গিল্গামেশের যোগসূত্রের সম্ভাবনার কথা তিনি বলেন। আমাদেরও চকিতে মনে পড়ে যায় তাঁর ডুইনো এলিজির সেই মহাবিস্ফোরক শুরুর কথা। তবে কি যে অভিযাত্রার মাধ্যমে রাজা গিল্গামেশ তাঁর ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছবার সূচনা করেন, তা জীবনানন্দ কথিত হাজার বছর ধরে পথে হেঁটে চলার সমগোত্রীয় এক অনুসন্ধান? হয়তো এই অনুসন্ধানকেই জীবনানন্দ তাঁর মহাকবিতার ভাবনায় ধরার কথা বলেছিলেন। এই মহাকবিতাকেই ধরেছেন রিলকে তাঁর ডুইনো এলিজিতে।

    এই ছোট আলোচনায় তো ইংরিজি অনুবাদ থেকে বাংলায় রূপান্তরের তুলনামূলক আলোচনা করা সম্ভব নয়, আর আমি তা করতেও চাই না, কারণ প্রাচীন ব্যাবিলনীয় ভাষা সম্পর্কে আমরা কেউই প্রায় কিছুই জানি না। তাই আমাদের বিভিন্ন অনুবাদের সূত্রের উপরেই নির্ভর করে থাকতে হবে। যেহেতু ভাগ্যক্রমে আমি অ্যান্ড্রু জর্জের ইংরিজি অনুবাদ পড়েছি, তাই বলতে পারি, অ্যান্ড্রু জর্জের অনুবাদে যেটি নেই, তা গৌতম বসুর অনুবাদে রয়েছে। আর তা হল একটি মহাকাব্যিক আবহ। ভাষার মহাকাব্যিক ব্যবহারের বিস্তারের মধ্যেই এই পার্থক্যের জায়গাটি রয়েছে। আর গিল্গামেশ পাঠ করার পর মনে হয় প্রাচীন ব্যাবিলনীয় ভাষায় এই মহাকাব্যিক বিস্তারটি ছিল। জর্জ সেটিকে অনেক কেজো ভাবে অনুবাদ করেছেন ইংরিজিতে। কিন্তু এখানে গৌতম বসু তাঁর অনুবাদের ভাষায় এক রহস্যঘন আবহ বজায় রেখেছেন, যার ফলে, গিল্গামেশ পড়তে গিয়ে ছিটকে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে না, গোলকধাঁধাঁর মধ্যে হারিয়ে যেতেও হচ্ছে না, বরং অনেক বেশি ভাবে গিল্গামেশ পড়ে যেতে হচ্ছে। কাব্যের সৌরভ অটুট থাকার ফলেই এটি সম্ভব হচ্ছে। অথচ তাঁর ডিটেলিং দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি মূল জায়গা থেকে কখনও সরে যাচ্ছেন না।

    আসলে গৌতম বসুর এই ভূমিকা নিয়েই পাতার পর পাতা লিখে চলা যায়। এত অসংখ্য প্রসঙ্গের অবতারণা তিনি করেছেন, তাতে যেমন গিল্গামেশ মহাকাব্য এবং তার ইতিহাস আমাদের কাছে আরও স্পষ্টভাবে ধরা দিচ্ছে, তেমন আমরা পাঠক হিসেবেও একটা প্রস্তুতি নিয়ে এই মহাকাব্যটির অনুবাদের দিকে যেতে পারছি। যেমন, রিলকের ভাবনাচিন্তার সঙ্গে গিল্গামেশের যোগসূত্রের সম্ভাবনার কথা তিনি বলেন। আমাদেরও চকিতে মনে পড়ে যায় তাঁর ডুইনো এলিজির সেই মহাবিস্ফোরক শুরুর কথা। তবে কি যে অভিযাত্রার মাধ্যমে রাজা গিল্গামেশ তাঁর ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছবার সূচনা করেন, তা জীবনানন্দ কথিত হাজার বছর ধরে পথে হেঁটে চলার সমগোত্রীয় এক অনুসন্ধান? হয়তো এই অনুসন্ধানকেই জীবনানন্দ তাঁর মহাকবিতার ভাবনায় ধরার কথা বলেছিলেন। এই মহাকবিতাকেই ধরেছেন রিলকে তাঁর ডুইনো এলিজিতে।

    এই আলোচনায় এই অনুবাদের থেকে একটিও উদ্ধৃতি যে আমি দিলাম না, তার অন্যতম কারণ হল, আমি পাঠক হিসেবে এই ধ্রুপদী মূর্ছনার থেকে একটি অংশও আলাদা করে তুলে আনতে অক্ষম। যা বেজে চলেছে এক মনাস্ট্রির ঘণ্টাধ্বনির মতো, তার শব্দকে কীভাবে তার পরিবেশ থেকে, তার গৃহ থেকে আলাদা করে তুলে আনব? তুলে আনলে কি তার ধ্বনির আবহকে সত্যিই বোঝানো সম্ভব? কারণ গৌতম বসুর ‘গিল্গামেশ’ অনুবাদ এক ‘ক্রিটিক প্রুফ’ কাব্যবিস্তার। একমাত্র রসিক পাঠক, ইতিহাসসন্ধানী পাঠক এবং কাব্যসন্ধানী পাঠক, তার কাছে হাঁটুমুড়ে বসতে পারেন মাত্র। কিন্তু এই অনুবাদের সমালোচনার অধিকার পেতে হলে, তাকে পালটা এক অনুবাদের টেক্সট-এর মাধ্যমেই আসতে হবে।

     

    • গ্রন্থ- গিল্গামেশ-কাব্য। বঙ্গানুবাদ ও সম্পাদনা-  গৌতম বসু। প্রকাশক- ভাষালিপি। প্রচ্ছদপট ও গ্রন্থচিত্রণ- সঞ্জীব চৌধুরী।

     


    4thpillars ব্যুরো - এর অন্যান্য লেখা


    যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং সাংবিধানিক সৌজন্যকে প্রতিনিয়ত পদদলিত করছেন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল।

    মানুষের জীবনদায়ী টিকা কি শেষ পর্যন্ত নিলামে বিক্রি হবে?

    ধর্ষণের অপরাধ কি বিয়েতে মকুব হয়ে যায়?

    আজ অষ্টম পর্বে গায়িকা সোমলতা আচার্য্য চৌধুরী-র মুখেই শুনুন তাঁর গৃহবন্দি জীবনের কথা।

    এঁদের কঠোর পরিশ্রম আপনারাও উপভোগ করবেন, এই ভিডিওতে।

    পশ্চিমবঙ্গে এবারের ভোটে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন।

    যিনি সুদূরবর্তী, স্পর্শ করো ওকে, ওকে জাগাও!-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested