×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • শিল্প ও শাস্ত্র উভয়ই বলছে পরিযায়ী শ্রমিক মা দুর্গা হতেই পারেন

    বিতান ঘোষ | 22-10-2020

    সৃষ্টির ছন্দে জীবনের জয়গান।

    "কে বেশি পাগল, কবি না কবিতা?' এই প্রশ্ন এখন জনমানসে কতটা ওঠে জানা নেই। তবে, "কে বেশি বিধর্মী, শিল্প না শিল্পী?' এই নিয়ে এক মস্ত বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে পণ্ডিতপ্রবরদের তর্কযুদ্ধ নয়, স্রেফ শিল্পীর তুলির আঁচড়েই আস্ত শাস্ত্রটার একেবারে দফারফা হয়ে গেছে। দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজো কমিটি এবারের পুজোয় চলতি মহামারী এবং কাজ হারিয়ে ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনের সংকটকে তাদের মণ্ডপ এবং প্রতিমার মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে। তাদের প্রতিমা রক্তমাংসের মানবী রূপে তার একরত্তি সন্তানকে কোলে করে পথ চলছে। সেই মানবীর ত্রিনয়ন বুঝিয়ে দিচ্ছে, তিনিই আদিশক্তি মহামায়া। পরিস্থিতির ফেরে তিনি যতই নিঃসহায় হোন, তিনি তাঁর সন্তানদের যত্নে কোনও ত্রুটি রাখেননি

    এই অস্থির সময়ে এমন সামাজিক বার্তা দেওয়া পুজোকে বন্ধ করার কথা কেন বলছেন "শাস্ত্রজ্ঞ'রা? সোশাল মিডিয়া ঢুঁড়ে দেখা গেল, অনেকেই এই প্রতিমা দেখে বিশেষ কুপিত হয়েছেন, কেননা চিরায়ত অসুরদলনী দুর্গার কোনও ছাপ নাকি এই প্রতিমায় পাওয়া যায়নি। মানে যে দুর্গা অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো "ওয়ারিয়র' নন, তাকে মা ডাকতে এঁদের যথেষ্ট আপত্তি আছে। কিন্তু, অধুনা যে সকল স্বঘোষিত হিন্দু "শাস্ত্রবিদ' কারণে অকারণে স্বামী বিবেকানন্দর শরণ নেন, তারা কি ভুলে গেলেন বীর সন্ন্যাসীর তোলা অবিস্মরণীয় সেই প্রশ্নটির কথা; "বহুরূপে সম্মুখে তোমা ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?' কবিও তো তাঁর আরাধ্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলছেন, "তাই তোমার আনন্দ আমার পর, তুমি তাই এসেছ নীচে'এই সময়ে কবি এসব বললে নিশ্চয়ই তাকেও শাস্ত্রভঙ্গের দায়ে "বয়কট' হতে হত

    কিন্তু যে শাস্ত্র নিয়ে এত স্পর্শকাতরতা, সেই শাস্ত্রের বিধিবিধান কী বলে? বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজের সংস্কৃতের অধ্যাপিকা অদিতি ভট্টাচার্য এই রকম মূর্তি বানিয়ে পুজো করায় বিশেষ আপত্তির কিছু দেখছেন না। তাঁর কথায়, "থিম পুজোয় থিমের প্রয়োজনে অনেক রকম প্রতিমা বানানো হয়। কিন্তু প্রতিমার একটা ছোট রেপ্লিকা অন্যত্র রেখে পুজো করা হয়। পুরোহিত সেই প্রতিমার মধ্যেই ধ্যানমন্ত্রের মাধ্যমে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা পালন করা গেলে থিমের প্রতিমা যে আদলেই তৈরি হোক, অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।' অনেকে আবার মনে করছেন শাস্ত্রবিধি নিয়ে প্রশ্ন তোলার নেপথ্যে একটা রাজনৈতিক খেলাও রয়েছে। যেহেতু প্রতিমাটি এক পরিযায়ী শ্রমিকের আদলে তৈরি আর বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে এই পরিযায়ী শ্রমিক ইস্যুতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে, তাই তাদের সমর্থকরাই এই পুজো বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন। শিল্পকীর্তি নিয়ে যখন এত প্রশ্ন, তখন তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে ফোর্থ পিলার্সের তরফে যোগাযোগ করা হয় চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁর বক্তব্য, "শিল্পীর একটা নিজস্বতা আছে, যেখানে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সমকালীন নানা সংকটের ছাপ শিল্পীর কাজে ফুটে উঠবে— সেটাই তো অভিপ্রেত।' তাঁর প্রশ্ন, "যারা সোশাল মিডিয়ায় শাস্ত্র নিয়ে এত মাথাব্যথা তারা এই দুর্দিনে ক'জন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন?' যোগেনবাবু এও মনে করিয়ে দিলেন, প্রতিমাটি চিত্রশিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্যের "দর্পময়ী' ছবিটির আদলে নির্মিত হয়েছে, যেখানে জীবনে একলা বাঁচা, সন্তানকে নিয়ে একলাই লড়ে যাওয়া মায়ের মধ্যে শিল্পী দেবীকে খুঁজেছেন

    চিত্রকর এবং প্রতিমা শিল্পী সনাতন দিন্দা অবশ্য পুরো বিষয়টায় বিরক্ত৷ তাঁর কথায়, "প্রতিমা তো আসলে আমাদের অন্তরে বিরাজ করা মায়েরই প্রতিচ্ছবি। সেখানে প্রতিমা শিল্পীর চোখে কীভাবে ধরা দেবেন সেটা সংশ্লিষ্ট শিল্পীর ওপরই ছাড়া উচিত। ব্যক্তিগত ভাবে আমার তৈরি প্রতিমাকে আমি অস্ত্র দিয়ে সাজাই না। ঘরের মেয়ের হাতে অস্ত্র দিতে ভাল লাগে না। এবারে যেমন আমার তৈরি করা একটা প্রতিমায় হাথরসের নির্যাতিতাকে খুঁজে পাবেন।' তাঁর খেদোক্তি, "গত 6 মাস ধরে মানুষের কাজ নেই, পেটে খাবার নেই। এই পরিস্থিতিতে প্রতিমা যদি মায়ের বেশে ধরা দেন মন্দ কী! আসলে শিল্পীর কষ্ট কেউ বোঝে না।'

    দুর্গাপুজোয় পুরোহিত মৃন্ময়ী দুর্গাকে চিন্ময়ী রূপে আবাহন করেন। অথচ বাঙালির ঘরের উমা যে আটপৌরে শাড়ি পরে, জীবনযুদ্ধে লড়ে যেতে পারে, সমাজের শত শত দুর্গা যে এভাবেই বাঁচে, এভাবেই লড়ে এটা স্বীকার করতে আমাদের অনেকেই এখনও দ্বিধাহীন নন। সিংহাসনের দেবতা যদি জনস্রোতে না নেমে আসেন, হৃদয়পুর মাঝে ভিন্ন ভিন্ন সাজে ধরা না দেন তাহলে আর কীসের মায়া প্রপঞ্চময়! আমরা কি এই জায়গাতেও বড্ড বেশি একদেশদর্শী হয়ে পড়ছি না?


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চিন সীমান্ত দ্বৈরথ কেন এমন রক্তক্ষয়ী মল্লযুদ্ধের চেহারা নিল, তার ময়নাতদন্তে..

    তাঁর মুখে আমরা 'শুনে' চমকে গেল লোকে, করোনা কাল কেটে গেলেও কি থাকবে এই বিনয়?

    সমাজের প্রান্তিক মানুষদের অধিকার রক্ষায় পার্থ সারথি বরাবরই সরব।

    লকডাউনে ছাত্রছাত্রীদের কাছে পাঠ্যবস্তু পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর সমান চিন্তা ছিল

    ‘সব খেলার সেরা’ আছে কিনা জানা নেই, তবে ফুটবলটাই আর বাঙালির নেই!

    পুরুষ সদস্যের মুখাপেক্ষী না থেকে, আর্থসামাজিক স্বাবলম্বনকে বুঝি 'ভিক্ষাবৃত্তি' বলে?

    শিল্প ও শাস্ত্র উভয়ই বলছে পরিযায়ী শ্রমিক মা দুর্গা হতেই পারেন-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested