সফরসঙ্গী
এবারে মর্ত্যে এসে রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেন দুর্গা। তাঁর নিজের নামের সঙ্গে কোনও অনাচারীর নামের মিল থাকলে বড়ই রাগ হয় তাঁর। এমনিতে অবশ্য দুর্গতিনাশিনী সহ তাঁর অগণিত অভিধা, তাঁর অনুরাগী মর্ত্যবাসীগণ তাদের কন্যাদের সেইসব নামে অভিহিত করে পরম পরিতৃপ্তি লাভ করে। দুর্গার তাতে আপত্তি নেই, এমনকি সেসব বালিকার গাত্রবর্ণ, মুখশ্রী, হাত-পায়ের গড়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর মতো না হলেও তিনি বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নেন। কিন্তু তিনি যদি দেখেন তাঁর বা দেবকুলের কারও নামধারী কোনও ব্যক্তি মানবজাতির ওপর অত্যাচার করছে, তবে ক্রোধ সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে তাঁর পক্ষে। একেবারে ত্রিশূলবিদ্ধ না করলেও তিনি তখন মনে মনে তাদের নামকরণের আয়ুধে আহত করতে থাকেন। যেমন মর্ত্যের এক গণপ্রধান তাঁর গণ এবং দেশের মানুষজনকে ক্রমাগত নাটকীয় মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিয়ে রাখেন। তিনি মাঝেমধ্যেই গগনবাণীতে ‘হৃদমাঝারে’ নামের অনুষ্ঠানে নিম্নস্তরের কৌতুকনাট্য পরিবেশন করেন। তাঁর আমলে গণ দেশীয় পণ্যোৎপাদন প্রতিবেশী দুর্বল জনপদগুলির চেয়েও নিম্নগামী হয়েছে, জাতীয় অস্মিতা বিলুপ্তির পথে। দুর্গা বুকের ছাতি প্রদর্শনকারী বলদর্পী এই ছলনায়কের নাম দিয়েছেন নরাসুর আমোদী। বা সংক্ষেপে নদো। এই গণপ্রধানের এক চক্রী সেনানায়কের অভিধা হয়েছে দুর্নীত শোণিতবাহ। তার বংশজের আকস্মিক ধনবৃদ্ধি এবং গুর্জর দেশে হত্যালীলার প্রতি ইঙ্গিত করেই এই নামকরণ বলে অনেকের ধারণা। এবং উত্তরদেশীয় এক ভণ্ড সন্ন্যাসী কূটনীতিকের নাম দিয়েছেন ভোগী দুর্বৃত্তনাথ।
দুর্গা বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছেন মর্ত্যের একটি গোষ্ঠী বেশ কিছু দেবদেবীর নামের অপব্যবহার করে মানবজাতিকে বিপথে চালনা করবার চেষ্টা করছে। তারা আসলে অসুর শ্রেণীর লোক, ছলেবলে কৌশলে বিভিন্ন রাজ্য দখল করাই তাদের মূল লক্ষ্য এবং সেখানে শাসন কায়েম করে পরধর্মের মানুষের নিপীড়ন এবং ভোগের স্রোতে নিজেদের ভাসিয়ে দেওয়াই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। যে ধর্মের নাম করে তারা তাদের কূটনীতির বিস্তার করছে, সেই ধর্মের ত্যাগ-তিতিক্ষা থেকে সহস্র যোজন দূরে তাদের অবস্থান। এমনকি তাঁর প্রতিনামে যে নারীবাহিনী তারা গঠন করেছে, তাদের কাজ হল দাঙ্গা হাঙ্গামায় পুরুষদের মদত দেওয়া এবং সুযোগ বুঝে অন্যের দোকানপত্র লুট করে নিজের ঘর সাজানো। এসব খবর দুর্গা অনেক আগেই তাঁর গুপ্তচর বাহিনীর কাছে পেয়েছেন, নন্দী-ভৃঙ্গী এবং জয়া-বিজয়া মর্ত্যদর্শন যন্ত্রের নিয়মিত দর্শক বলে জম্বুদ্বীপের অনেক গুরুতর খবরাখবর রাখে, তাদের কাছ থেকেই এসমস্ত সংবাদ দুর্গা পেয়ে থাকেন।
ত্যাগ তিতিক্ষার কথা বলবার অধিকার দুর্গার যথেষ্ট রয়েছে। কারণ যখন তিনি অপর্ণা নামে উপবাস করেছিলেন, কোনও প্রকার পিষ্টক-মন্ডিত কুক্কুট মাংস কিংবা মোদকাদি তো দূরস্থান, শুধুমাত্র প্রাণধারণ করবার নিমিত্ত একটি মাত্র হরিৎপত্র বিনা অন্যকিছু মুখে ছোঁয়াননি। বর্তমানে মর্ত্যবাসীর অনশনের নানাবিধ রূপ দেখে তিনি বিচলিত বোধ করেন। তার মনে হয় মানবজাতি ক্ষমতালিপ্সা নামক প্রবৃত্তির নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যার থেকে তাদের বোধহয় আর নিস্তার নেই।
দুর্গার পুত্র-কন্যারাও জম্বুদ্বীপের (যাকে মর্ত্যবাসী বর্তমানে ভারতবর্ষ বলে জানে) কার্যকলাপে বড়ই ক্ষুব্ধ। সেদিন সরস্বতী নিতান্তই দুঃখপ্রকাশ করে বলছিল যে, তার আশঙ্কা মর্ত্যে তার পুজো শিগগিরি বন্ধ হয়ে যাবে, কারণ সেখানকার বেশ কিছু জনপ্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পর্যন্ত পেরোয়নি। তারা এমনকি প্রকাশ্যে ঘোষণযন্ত্রে আকথা-কুকথাও বলে থাকে। তাদের বিদ্যালাভের প্রমাণ চাইলে সন্দেহজনক নথিপত্র পেশ করে।
এরাই যদি বাকিদের অনুসরণযোগ্য হয় তাহলে আর বিদ্যার কী মূল্য থাকে! গণেশের পূজাধাম বিদর্ভ প্রদেশে মহাদেবের ভক্তকুলের সঙ্গে রামভক্তদের রাজ্যদখল নিয়ে সংঘাত বেঁধেছে। গণেশের বক্তব্য, কেউ কেউ লক্ষ্মীর অন্যায় সহায়তা লাভ করে জনপ্রতিনিধিদের খরিদ করে নেওয়ার চেষ্টায় আছে।
একথা শুনে লক্ষ্মী নিতান্তই চঞ্চল হয়ে তার কার্যকলাপের কিছু ব্যাখ্যা দিতে গিয়েছিল, কিন্তু আর সকলের মতো দুর্গাও যেহেতু এ বাবদে তার সিদ্ধান্তহীনতার সঙ্গে পরিচিত, তাই লক্ষ্মীর কোনও যুক্তি ধোপে টেকেনি। উল্টে সরস্বতী এই বিষয়ে গণেশকে সমর্থন করায় লক্ষ্মী রেগে গিয়ে বলেছে, সরস্বতীকে যবে থেকে এক বর্ষীয়ান চিত্রকর সানি লিওনে না কী একটা বানিয়ে ছবি এঁকেছে, তবে থেকেই মর্ত্যে অনাচারের শুরু। দুর্গা একথার অর্থ অনুধাবন করতে পারেননি, পরে জয়ার কাছে জেনে নেবেন বলে ঠিক করেছেন।
কার্তিকেয়ও যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ। যখন তখন, বিভিন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে জম্বুদ্বীপে প্রতিবেশী দেশসমূহের বিরুদ্ধে রণদুন্দুভি বেজে উঠছে, এর ফলে তার মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে।
এই বছর মর্ত্যে সবকিছুই অন্যরকম। মণ্ডপে মণ্ডপে মৃন্ময়ী দুর্গা সপরিবারে বিরাজমানা হলেও হুজুগবিহ্বল ভক্তের সংখ্যা কম। কোনও এক বিচারসভা থেকে এমনই আদেশ দেওয়া হয়েছে বলে জেনেছেন দুর্গা। কারণও সঙ্গত। মানবসঙ্গলিপ্সু এক বর্তুলাকার কন্টকাসুর সমগ্র মর্ত্যভূমিকে ছারেখারে করে দিচ্ছে, তাই এই দূরত্ব বজায়ের প্রচেষ্টা।
চারটি দিন কোনওক্রমে পিতৃগৃহে অতিবাহিত করলেন দুর্গা। এবারে প্রায় বিনা আড়ম্বরেই তাঁকে ফিরে যেতে হল। বিসর্জনের আগে কার্তিকেয়র ভাষায় ‘স্যালুটেশন প্রোগ্রাম’ নেই। নানা কারণে খুবই বিষণ্ণচিত্তে যেতে যেতে তাঁর চোখে পড়ল একটি সরাইখানার সামনে ভিড় জমেছে। জয়া বলল, ‘মা, এখানে তোমার সেই শোণিতবাহ এসেছে গো। আর ওই যে বিবৃতি ঘনঘনস্বর, ওই যে কৈশব নব্যবর্গী, ওই ললন্তিকা দেবী, ওই তোমার গবাদিদোষ, হিহি, গলায় গ্যাঁদাফুলের মালা ঝুলিয়েছে দেখো, গরুতে না মুড়িয়ে খায়! ওদের বোধহয় এখেনে আজ শত্তুরমেধ যজ্ঞ আছে, দেখছ না কপালে কেমন লাল টিকে লাগিয়েছে!’
দুর্গা দেখলেন কিছু উচ্ছিষ্টভোগী মানুষও জমা হয়েছে সেখানে। এরা সেই দলের লোক, যারা ক্ষমতাবানের আসঙ্গলিপ্সু, তাদের পদলেহন করে বেঁচে থাকাই এদের একমাত্র জীবিকা। ক্ষমতালাভের এক কাল্পনিক আশায় তারা এইসব বলদর্পীর আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। এমন মানুষজনের সংখ্যা কি ক্রমশ বেড়ে চলেছে, দুর্গা মনে মনে ভাবলেন।
হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল কিছু নারী অস্বাভাবিক সাজপোশাক পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঠিক তাঁর পূজার সময় মেয়েরা যেমন সাজগোজ করে তেমনটি নয়, অনেকটা স্বর্গের নিম্নবর্গের অপ্সরাদের মতো তাদের বহিরঙ্গ। জয়া বলল, ‘হাঁ করে দেখছ কী, এরা তো তোমার নামের বাহিনী গো, যজ্ঞ শেষ হলে অধিনায়কদের ঘরে যাবে তাদের কেলানতি দূর করতে!’
দুর্গা ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে হতচকিত হলেন। তারপর তাঁর চোখ ক্রোধে রক্তবর্ণ হল। তিনি মনশ্চক্ষে দেখতে লাগলেন তাঁরই অন্যরূপা ব্রহ্মাণী, কমণ্ডলু থেকে জল ছিটিয়ে অসুরদের বীর্যহীন ও ওজঃশূন্য করছেন।
সূত্র: শ্রীশ্রীচণ্ডী:অষ্টম অধ্যায়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্টের গর্ভপাত বিরোধী রায় দক্ষিণপন্থী দেশগুলিতে নারীদের উদ্বেগের কারণ
চিড়া খাইতে পারুম না ... কী ZE কয় !
দুর্গা বুকের ছাতি প্রদর্শনকারী বলদর্পী এই ছলনায়কের নাম দিয়েছেন নরাসুর আমোদী। বা সংক্ষেপে নদো।
বশিষ্ঠ রামের হাতে মিষ্টি (প্রসাদ?) দিলেন দারাকে দেওয়ার জন্য
সত্যি এবারে চৈত্র বড়ই অবহেলায় গেল।
আমাদের ছোটবেলায় জন্মদিনে বই দেওয়ার প্রথা ছিল