সম্ভবত ভোরবেলার স্বপ্ন নয়। শেষ রাত্তিরের কি? আধা সত্যি হয়েছে, আরও আধা বাকি। কিন্তু, ভোরের স্বপ্ন হলেই যে সত্যি হবে, তারই বা কী মানে আছে!
যা হোক অসীম সৌভাগ্যশালী রাজপুত্র, ‘শাহজাদা ই বুলন্দ ইকবাল’ দারাশিকো একদিন তাঁর স্বপ্নে দেখতে পেলেন, মহাঋষি বশিষ্ঠ এবং তাঁর তরুণ ছাত্র রামচন্দ্রকে। ঘটনাচক্রে দারা সে সময় যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণের একটি ফারসি অনুবাদ পড়ছিলেন। তিনি দেখলেন, ঋষি বশিষ্ঠ রামচন্দ্রকে বলছেন, “এই শিষ্যটি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, একে আলিঙ্গন করো রামচন্দ্র।“ রাম তৎক্ষণাৎ পরম স্নেহে দারাকে জড়িয়ে ধরলেন। বশিষ্ঠ রামের হাতে মিষ্টি (প্রসাদ?) দিলেন দারাকে দেওয়ার জন্য। রামও ভালবেসে সে মিষ্টি দারাকে খাওয়ালেন।
এ পর্যন্ত পড়ে যেসব একেলে বস্তুবাদী আগ্রহ হারাচ্ছেন, তাঁদের আর একটু অপেক্ষা করতে বলব।
তারাপদ লাহিড়ী নামে এক স্বনামধন্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত তাঁর ‘মার্কসীয় দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের ভূমিকা’ গ্রন্থে লিখেছেন, “অন্যান্য দেশের মতো ভারতবর্ষেও বহু প্রাচীন কাল থেকে অধ্যাত্মবাদের পাশাপাশি বস্তুবাদী চিন্তাধারাও তুল্যভাবে প্রবাহমান ছিল। প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের উক্তি থেকে এবং তাঁদের উক্তির ব্যাখ্যাতাগণের লেখা থেকে এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।“ এই প্রসঙ্গে শ্রী লাহিড়ী কঠোপনিষদের নচিকেতার উদাহরণ দিয়েছেন, যে নচিকেতা যমের দেওয়া শতায়ু পুত্র পৌত্র, চিরজীবিত্ব, ধনরত্ন, রথ, অশ্ব এমনকি সুন্দরী নারীর প্রলোভন পর্যন্ত জয় করে জীবন-রহস্য জানতে চেয়েছিলেন। জিজ্ঞাসাই সকল দর্শনের মূলে।
আরও পড়ুন: |
শাহজাদা দারাশিকো অবশ্য বস্তুবাদী দর্শন নয়, আধ্যাত্মবাদী দর্শনের সন্ধানে ছিলেন, কিন্তু সে সন্ধানের মূলে দারার সুফিবাদ এবং একেশ্বরবাদ বা ‘তৌহিদ’-এর প্রতি আকর্ষণ যেমন ছিল, তেমনই ছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলনাকাঙ্ক্ষা। তাঁর এই কামনাই পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের হাতে হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাঁকে হত্যা করবার অজুহাত হিসেবে। অথচ দারা তো একা নন, তাঁর পরদাদা বা প্রপিতামহ আকবর বাদশার আমল থেকেই তো ফারসিতে রামায়ণ, মহাভারতের এমনকি কথাসরিৎসাগরের অনুবাদ পর্যন্ত শুরু হয়ে গিয়েছিল রাজানুগ্রহে। চলেছিল বাদশা জাহাঙ্গীরের সময়েও। মহাভারতের তর্জমা ‘রজমনামা’(সমরকাহিনী) নামে জনপ্রিয়ও হয়েছিল ফারসিনবীশ মহলে, দেশে বিদেশে। ফারসিতে অনূদিত হয়েছিল অভিনন্দ কর্তৃক সংক্ষিপ্ত ‘লঘু যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ’ও। একটি অনুবাদ ছিল নিজাম-অল-দিন পানিপতির। এই রামায়ণ লিখেছিলেন স্বয়ং বাল্মীকি, যার মূল বিষয়বস্তু একেশ্বরবাদ এবং অদ্বৈতবাদ।
তরুণ রামচন্দ্রের জীবন সম্পর্কিত নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ঋষি বশিষ্ঠ। গ্রন্থটির কাব্যগুণ অসামান্য। এই রামায়ণের পদগুলি গাওয়া হত আলাদা আলাদা রাগে, শ্রোতার উপলব্ধি এবং মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। এ প্রসঙ্গে একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ না করে পারছি না: নবীনবয়সী, মোক্ষলাভে আগ্রহী রাম সংসারধর্ম পালনে অনীহা প্রকাশ করলে বশিষ্ঠ তাঁকে বলেন- “গৃহকার্যে থাকিলেও (যেরূপ) দুশ্চরিত্রা নারীর হৃদয়ে পরপুরুষ সংসর্গরসের প্রকাশ থাকে, (সেইরূপ) তত্ত্বজ্ঞানীর অন্তঃকরণ কর্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেও সতত ব্রহ্ম-আনন্দ রসাস্বাদন করে।“ -উপমাটি আমার মতোই অনেক নারীর পছন্দ না হলেও, এক্ষেত্রে বাল্মীকির রসবোধ সম্পর্কে সত্যিই সংশয় থাকে না!
শাহজাদা দারা, যাঁর অন্তঃকরণটিও ছিল তত্ত্বজ্ঞানীর মতোই নির্মল, বিষয়াসক্তিহীন, তিনি যখন সুফিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন, যে ধারার সন্তদের সমাধিস্থল সম্পর্কে পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন লিখছেন, “ভক্তিতে প্রেমে সেই তীর্থ ভরপুর। শাস্ত্রের বিধিনিষেধ বা শুষ্ক বাহ্যাচার হতে সেখানকার পবিত্র তীর্থ অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থিত”, সেই সুফিবাদ তাঁকে শেখাল প্রেমধর্মের কথা। ইসলাম অনুযায়ী তৌহিদ বা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী শাহজাদার জীবনবোধে যোগ হল সুফিবাদের ভালবাসা ও করুণার ধর্ম। ‘কাদিরি’ নামক ধারার অঙ্গীভূত হলেন দারা, কবি হিসেবে ছদ্মনাম বা তখল্লুসও নিলেন ‘কাদিরি’। লিখলেন:
রাজত্ব তো সহজ বস্তু
বরং ফকিরি শেখো ভাই,
জলবিন্দু সাগর বনুক
মুকুতা হয়ে লাভটি নাই!
(সল্ তনৎ সহল অস্ ত খুদ রা আশনাই ফক্ র কুন / কতরহ্ ই না দরিয়া তওয়ানদ শুদ চুরা গওহর শওয়াদ)
(Dara shikoh with three sages with inscription, source-Wikimedia commons)
এহেন সাধক, সাহিত্যিক রাজপুত্র যে একাদিক্রমে তাঁর আগ্রহের বিষয়ে নানা গ্রন্থ লিখতে থাকবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি! এভাবেই একদিন তাঁর হাতে এল পূর্বে বর্ণিত যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণের অনুবাদখানি। কালান্তরে সেখানে মিলিত হয়েছে বেদান্ত, যোগ, সাংখ্য, শৈব সিদ্ধান্ত এবং জৈন ও মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম। অর্থাৎ, তৎকালীন ভারতের তাবৎ জীবনদর্শন, যা একজন একেশ্বরবাদী দার্শনিকের প্রয়োজন হতে পারে। দারা তাঁর প্রাপ্ত তর্জমায় সন্তুষ্ট না হয়ে তাঁরই এক দরবারীকে ভার দিলেন সরল ফারসিতে এই রামায়ণের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের। দুর্ভাগ্যক্রমে সে অনুবাদকের নাম জানা যায়নি, সময়টা 1656 সাল নাগাদ। অনুবাদ হাতে পাওয়ার পর অবশ্য তিনি মেলালেন। মিলিয়ে দেখালেন, ভারতবর্ষের প্রাচীন দর্শনের সঙ্গে ইসলামের কোথায় কোথায় মিল। মিল স্বর্গ-নরকের ধারণায়, সাদৃশ্য পরমেশ্বরের চিন্তায়। এমনই আরও বেশ কিছু।
শুরু করলেন বিসমিল্লাহ করেই, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে। এটি তাঁর লেখা পঞ্চম গ্রন্থ, ভাষা ফারসি। নাম দিলেন ‘মাজমা উল বহরেঁ’। অস্যার্থ সাগর সঙ্গম। তবে দারা জানতেন, তাঁর এই কাজ দুই ধর্মের রক্ষণশীলদেরই চক্ষুশূল হবে, তাই লিখেছিলেন, “আমি এই গ্রন্থ আমার পরিবারের জন্য লিখেছি, দুই ধর্মেরই সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।“ তারপর একে একে অনুবাদ করলেন উপনিষদ, ভগবদগীতা। তাঁর আগ্রহে লেখা হতে লাগল আরও অনেক গ্রন্থ। হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের ক্ষেত্রে দারা পরমনির্ভরশীল ছিলেন বাবা লাল বা লাল দয়াল নামে এক ক্ষত্রিয় ভক্তের ওপরে।
আরও পড়ুন: |
ওদিকে রণাঙ্গনে ঘনিয়ে এসেছিল মেঘ। বাদশা শাহজাহানের প্রিয়তম পুত্র, শাহজাদী জাহানারার প্রিয় অনুজ, মমতাজ মহলের অপার সৌন্দর্যের উত্তরাধিকারী, উদার মানুষজনের ভরসা শাহজাদা দারাশিকোর বিরুদ্ধে আগ্রার অদূরে জমায়েত হল তিন ঈর্ষাপরায়ণ ভ্রাতা সুজা, মুরাদ এবং ঔরংজীবের ফৌজ। ইতিহাস বলছে, সেদিন সাত রমজান, 1068 হিজরি সাল। তারপর যথাযথ সংগ্রামের পরেও সপুত্র পরাজিত হলেন দারা। শাহজাহান বন্দি হলেন। 1658 সালে নিজেকে বাদশাহ আলমগীর বা বিশ্বজয়ী ঘোষণা করলেন ঔরংজীব।
উলেমাদের বিচার প্রক্রিয়ায় ‘ইসলাম ত্যাগের’ নামে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল ধর্মনিরপেক্ষ কবি, লেখক শাহজাদা দারাশিকো-কে। সেটা 1659 সাল, এমনই সজল বর্ষাকাল তখন।
দারাশিকো ভারতবর্ষের সম্রাট হলে হয়তো সামগ্রিক চিত্র অনেক বদলে যেত। অসাধারণ সব মিলনের নজির দেখা যেত দেশব্যাপী। সাহিত্যে, শিল্পকলায়। আজও সেক্যুলারিজমের স্বপ্ন দেখেন এদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ।
তাই বলছিলাম ভোরের স্বপ্ন হলে হয়তো...
সহায়ক গ্রন্থ:
১. Majma Ul Bahrain or
The Mingling of The Two Oceans
By Prince Muhammad Dara Shikoh
Edited by M Mahfuz Ul Haque
২. মার্কসীয় দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের ভূমিকা
৩. ভারতের সংস্কৃতি - ক্ষিতিমোহন সেন
কৃতজ্ঞতা: শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। সলিম রিজভী
বুলডোজার চালিয়ে দুষ্কৃতী দমনের কথা বলে ভোটে জিতলেন উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ।
বশিষ্ঠ রামের হাতে মিষ্টি (প্রসাদ?) দিলেন দারাকে দেওয়ার জন্য
পেশোয়ারী খানদান আর অভিনয় দক্ষতার বৈচিত্রে তিনিই যেন মিনি ভারতবর্ষ।
অমৃতসরের এম এ ও (মহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল) কলেজের এক লাজুক মুখচোরা অধ্যাপক ছিলেন আপনি ফয়েজ।
বাংলার ভোটে সংযুক্ত মোর্চার হার মানেই তার রাজনৈতিক প্রয়োজনের অবসান নয়।
আমাদের ছোটবেলায় জন্মদিনে বই দেওয়ার প্রথা ছিল