×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ইতিহাস মানে এখন শুধুই প্রশ্নহীন বন্দনা

    সোমনাথ গুহ | 23-06-2021

    প্রতীকী ছবি।

    ইতিহাসের সিলেবাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আমরা এতদিন জেনে এসেছি যে ঐতিহাসিকের কাজ হচ্ছে আতস কাঁচ দিয়ে তথ্য যাচাই করে ইতিহাস নির্মাণ করা, যা চিরকালীন কোনও ধ্রুব সত্য নয় বর যা নতুন আবিষ্কৃত তথ্যের ভিত্তিতে সজীব এবং সর্বদা পরিবর্তনশীল। স্নাতক স্তরে ছাত্রছাত্রীরা এখন মাইথোলজি বা পৌরাণিক আখ্যান এবং হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ আরও বেশি পড়বে, এবং ইতিহাস বলে এতদিন আমরা যা জেনে এসেছি তা কম গুরুত্ব পাবে। যেমন ধরা যাক এখন বৈদিক সময়ের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, শাস্ত্র বেশিপড়ানো হবে, মুসলিম রাজত্বের সময়কার ঘটনাবলী কম পড়ানো হবে। এর ফলে ইতিহাস পাঠের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেওয়া হবে। প্রথমত ইতিহাস কী, এবং কীভাবে সেটার অবিরত মূল্যায়ন ও নবনির্মাণ হয় সেটা পাল্টে যাবে। দ্বিতীয়ত ইতিহাস, বিশেষ করে পৌরাণিক ইতিহাস এবং হিন্দু রাজারাজড়াদের সময়কার ঘটনাবলী পবিত্র ও শাশ্বত সত্য হিসাবে পাঠ করানো হবে। তৃতীয়ত ইতিহাস উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে যাবে, ধর্মের নিক্তিতে ওজন করে কোন বিষয় কতটা গুরুত্ব পাবে তা বিচার করা হবে

     

     

    দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকস্তরে সাম্মানিক পর্যায়ের প্রথম পত্রে যে পরিবর্তনগুলো ভাবা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। এখন ছাত্রছাত্রীদের পাঠ করতে হয় প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস এবং প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের প্রথম পর্ব। নতুন সিলেবাসে ‘চিরায়ত ভারতবর্ষ’ বা ‘আইডিয়া অফ ভারত’ আনা হচ্ছে। এতে স্মৃতি, শাস্ত্র, পুরাণ, বেদ, উপনিষদ সব থাকবে এবং সেগুলির অসমালোচনামূলক এবং নি:সন্দিগ্ধ পাঠ দেওয়া হবে অর্থাৎ, মূলত স্তুতি ও বন্দনা হবে, নিন্দনীয় কোনওভাবেই নয়, নিদেন পক্ষে সমালোচনামূলকও নয়। উপরোক্ত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে যা যা আগের সিলেবাস থেকে বাদ পড়বে, তা হল- কৌটিল্যর ‘অর্থশাস্ত্র’, চরকের ‘চরক সংহিতা’, কালিদাসের কাব্য ইত্যাদি। তৃতীয় পত্রে প্রাচীন সময় থেকে 550 খ্রিস্টাব্দ অবধি ‘সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা’ নামক একটি ধারণার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সরস্বতী আমরা জানি একটি অদৃশ্য, অন্তঃসলিলা মিথিক্যাল নদী যেটার অস্তিত্বের সপক্ষে ঐতিহাসিক কোনও প্রমাণ নেই। সংঘ পরিবার বিশ্বাস করে সরস্বতীই হচ্ছে সেই পবিত্র নদী, যা হরপ্পার সঙ্গে পরবর্তকালের হিন্দু যুগের সংযোগ স্থাপন করে। এটা করে আর্যদের ভারতে আগমনের তত্ত্বকে তারা নস্যাৎ করতে চায়। তারা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর পরিবর্তে একটা আষাঢ়ে সরস্বতী সভ্যতার ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। দ্বাদশ পত্রে রামায়ণ মহাভারত পাঠ এবং সারস্বত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আগেও মহাকাব্যগুলির পাঠ ছিল, কিন্তু এখন এটা আরও বিস্তারিত করা হয়েছে এবং পুরোটাই দ্বিধাহীন ভাবে বন্দনামলক করা হয়েছে। 1300 থেকে 1800 শতাব্দীর মুসলিম যুগ আগে তিনটি সেমেস্টারে পড়ান হত, এখন সেটাকে কাটছাঁট করে শুধুমাত্র একটি পত্রে পড়ান হবে। বাবর এবং অন্যান্য মুসলিম শাসকদের হানাদার আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যেটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষেত্রেও বলা হয়নি। সংঘপন্থীদের বক্তব্য পরিষ্কার- অতীতে মুসলিম যুগকে অহেতুক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এখন সেটাকে সংশোধন করতে হবে।  

     

    আরও পড়ুন: অমৃতার ‘ন হন্যতে’ হয়ে ওঠা

     

    ইতিহাসের এই গিকীকরণ করতে গিয়ে তারা মার্ক্সবাদী বা বামপন্থী ঐতিহাসিকদের ওপর খড়্গহস্ত প্রাচীন ভারতের ওপর রামশরণ শর্মার বা মধ্যযুগের ওপর ইরফান হাবিবের বিদগ্ধ পুস্তকগুলি এখন থেকে বাতিল। তাঁদের পরিবর্তে অনাম ঐতিহাসিকদের বই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাঁরা প্রায় সবাই সংঘ-ঘনিষ্ঠ। আধুনিক যুগের ইতিহাসে আগে দলিত রাজনীতি ছিল, এখন তা বাতিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ওড়িশার পাইক বিদ্রোহ কিংবা তামিলনাড়ুরপলিগার বিদ্রোহ, যেগুলি আগে পাঠ্যক্রমে ছিল, সেগুলি বাদ দেওয়া হয়েছে। 1905-এর বঙ্গভঙ্গ বাদ পড়েছে, এবং এই ঘটনা যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সহ বিপুল সংখ্যক মানুষ বিরোধিতায় মুখর হয়েছিল, বলাই বাহুল্য সেটাও বাদ। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতার আন্দোলন তো তাদের মুছে দিতেই হবে না হলে 1947- বাংলা ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গ স্থাপন করার কৃতিত্ব তারা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে দেবেন কী ভাবে? বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান সম্পর্কে প্রায় কোনও উল্লেখ নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, আম্বেদকরের ভূমিকা খাটো করে দেখানো হয়েছে; আম্বেদকরকে শুধুমাত্র দয়ানন্দ সরস্বতীর মতো একজন হিন্দু সংস্কারক আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে সর্বোত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে ভূষিত করা হয়েছে।  

     

     

    শুধু স্নাতক স্তরে নয়, কোভিডের কারণ দেখিয়ে এবং মহামারর সময় ছাত্রছাত্রীদের পড়ার বোঝা কমানোর অজুহাতে CBSE-র সিলেবাস থেকে ‘ডেমোক্রেসি এন্ড ডাইভারসিটি’, ‘জেন্ডার, রিলিজিয়ান এন্ড কাস্ট’, ‘সিটিজেনশিপ’, ‘সেক্যুলারিজম’ ইত্যাদি অধ্যায় আসন্ন পরীক্ষার জন্য বাদ দেওয়া হয়েছিল িটিজেনশিপ’ বাদ দেওয়াটা লক্ষণী, এমন একটা সময়ে যখন দেশ জুড়ে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। 2017 সালে NCERT দ্বাদশ শ্রেনীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটা অধ্যায়ের শিরোনাম ‘অ্যান্টি মুসলিম রায়টস ইন গুজরাট’ পাল্টে শুধু গুজরাট রায়টস’ করে দেওয়া হয়ক্লাস নাইনের পাঠ্যপুস্তকে কৃষকদের ওপর পুঁজিবাদের প্রভাব অধ্যায়টিতে কাটছাঁট করা হয়েছিল। কেন্দ্রকে অনুসরণ করে রাজস্থানেও যে যার খেয়ালখুশি মতো ইতিহাসের ব্যাখ্যা চলছে। আকবরের মহানুভবতাকে হেয় করা হয়েছে, রানাপ্রতাপকে মহাপরাক্রমশালী নায়ক করে দেওয়া হয়েছে। রানাপ্রতাপ অবশ্যই বিরাট বীর ছিলেন, কিন্তু তা বলে তো হলদিঘাটির যুদ্ধে জোর করে তাঁকে বিজয়ী করে দেওয়া যায় না। 

     

    আরও পড়ুন: বাংলা ভেঙে ছোট রাজ্য?

     

    একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে এত সব সংশোধন, পরিবর্তন আরএসএস-বিজেপির রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই করা হচ্ছে। তাদের হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা একটি অভিন্ন, অবিচ্ছেদ্য, একমেবাদ্বিতীয়ম সুপ্রাচীন হিন্দু অতীত বা ‘চিরায়ত ভারতবর্ষের’ আইডিয়া তুলে ধরতে চায়। কিন্তু সুদূর অতীতে ভারতবর্ষ বলে কোনও দেশ বা রাষ্ট্র ছিল না; যা ছিল তা হচ্ছে বিভিন্ন জনপদ, নগর-রাজ্য- মগধ, উজ্জয়ন, মিথিলা, গান্ধার ইত্যাদি। 2014 সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে ইতিহাসের গিকীকরণ শুরু হয়। ওই সময় আরএসএস ‘ভারতীয় শিক্ষা নীতি আয়োগ’ গঠন করে। এর দায়িত্বে ছিলেন দননাথ বাত্রা, যিনি ততদিনে ওয়েন্ডি ডোনিগারের ‘দ্য হিন্দুস: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি’ বইটি নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়ে শিরোনামে চলে এসেছিলেন। তিনি চাপ দিয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম থেকে একে রামানুজানের ‘থ্রি হান্ড্রেড রামায়জ’ ছেঁটে ফেলতে বাধ্য করেন কারণ সংঘ পরিবারের মতে রামায়ণ একটিই এবং অবশ্যই সেটি তাদের দ্বারা স্বীকৃত। দননাথ বাত্রার বিখ্যাত / কুখ্যাত বই হচ্ছে, ‘দ্য এনিমিজ অফ ইন্ডিয়ানাইজেশন- দ্য চিল্ড্রেন অফ মার্ক্স, ম্যাকলে এন্ড মাদ্রাসা’। এতে তিনি বর্তমানে যে ইতিহাস পড়ান হয়, তাতে 41টি ভুল খুঁজে পেয়েছেন। চারটি প্রধান ভুল হল- (1) আর্যরা বাইরে থেকে এসেছে এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রটনা, কারণ হিন্দুরাই হচ্ছে এখানকার ভূমিপুত্র। (2) মহাকাব্যগুলিতে যে চমৎকার, তথাকথিত অলৌকিক ঘটনাগুলি বর্ণিত হয়েছে সেগুলি বাস্তব। এই ব্যাখ্যা থেকেই বলা হচ্ছে যে, ইতিহাস আর মাইথোলজি মূলত একই বিষয় (3) মুসলমানদের আক্রমণ ভারতের ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়। (4) স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধী এবং নেহরুকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে

     

     

    আমাদের পরবর্ত প্রজন্মের শিক্ষাদীক্ষা এখন এঁদের হাতে। যোগী আদিত্যনাথ, রামদেব এখন মরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে দশর্নের ছাত্রদের যোগ পড়াবেন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে নতা আম্বানির অতিথি অধ্যাপক হওয়ার কথা ছিল, নেহাত ছাত্রছাত্রীরা বিদ্রোহ করে বসায় সেটা আর হয়ে উঠল না। সমের এক বিধায়ক কিন্তু বলে যাচ্ছেন যে, গোমূত্র ও গোবরে কোভিড সেরে যাবে। ‘মেরা ভারত মহান’ এখন ছাত্রছাত্রীদের বলতেই হবে, হোক না সেটা শুধু হিন্দুত্ববাদীদের ভারত


    সোমনাথ গুহ - এর অন্যান্য লেখা


    প্রায় আশি বছর আগে গ্যাবো-মার্সেদেস রূপকথার সূচনা।

    গুজরাতে ধর্ষণকারীদের মুক্তি দিয়ে বিজেপি-র স্বাধীনতার অমৃত পান

    পীড়নকারী, হত্যাকারী পুলিশের শাস্তি হয়নি কোনও আমলেই।

    শেষ পর্যন্ত এবারের ভোটে মুসলিম ভোট বাংলায় মমতার ঝুলিতেই যাবে।

    সরকারের থেকে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা কৃষকের অন্যায্য দাবি নয়, হকের পাওনা

    জনজীবনকে ধ্বংস করে উন্নয়নের মোড়কে দেউচা পাঁচামিকে পুঁজিপতিদের মুক্তাঞ্চল করতে চাইছে তৃণমূল সরকার।

    ইতিহাস মানে এখন শুধুই প্রশ্নহীন বন্দনা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested