×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • মার্কেজ-মের্সেদেস: এক অনন্ত প্রেমের রূপকথা

    সোমনাথ গুহ | 02-09-2020

    মার্কেজ-মের্সেদেস

    বিশ্ববিখ্যাত মানুষদের সহধর্মিনীদের মৃত্যুর কদাচিৎ খবর হয়। কিন্তু সদ্যপ্রয়াত (15.08.2020) মের্সেদেস বার্চা পার্দো তো প্রবাদপ্রতিম কথাসাহিত্যিক, যাদু-বাস্তবতার অন্যতম কারিগর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের (তামাম লাতিন আমেরিকায় তিনি গ্যাবো নামেই পরিচিত) শুধুমাত্র সহধর্মিনী ছিলেন না; তিনি ছিলেন তাঁর সাহিত্যের প্রেরণাদাত্রী, যিনি তাঁর দীপ্ত বুদ্ধি এবং প্রখর রসবোধের কারণে তাঁর স্বামীর চারপাশের নক্ষত্র সমাবেশের মধ্যেও নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতি অনায়াসে জানান দিতেনতিনি ছিলেন সেই নারী, যাঁর বিচক্ষণতা মার্কেজের অবাধ, বেপরোয়া, হুল্লোড় জীবনের রাশ টেনে ধরেছিল লেখকের যৌবনের যাবতীয় দুষ্টুমিকে যিনি সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করেছিলেন। তাঁকে স্থিতিশীল করেছিলেন। তিনি ছিলেন সেই অবলম্বন যাঁর নিরাপদ আশ্রয়ে মার্কেজ একাগ্র চিত্তে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। মের্সেদেসওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিচুড-এ বুয়েন্দিয়া পরিবারের গৃহকর্ত্রী উরসুলার মতো একটা বটগাছ যিনি সমস্ত সংসারটাকে আগলে রাখেন, দৈনন্দিন খুঁটিনাটি সামলান, সমস্ত সংকটের নিরাসন করেন; এমন সব সংকট, যেগুলো সম্পর্কে লেখক জানতেও পারেন না। উপরোক্ত উপন্যাসটি রচনার সময় দীর্ঘ দেড় বছর প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যেও কীভাবে তিনি সংসার সামলেছিলেন, বাড়িওয়ালার তাগাদা ঠেকিয়ে রেখেছিলেন তা তো লোকগাঁথা হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি শুধু তাঁর গৃহিণী ছিলেন না, তাঁর সেরা পাঠক ছিলেন, ছিলেন তাঁর নির্ভরযোগ্য উপদেষ্টা। তাই তাঁর মৃত্যু বিশ্বের যাবতীয় মিডিয়ায় উল্লেখিত হয়, গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং পরিচিতরা মার্কেজের জীবনে তাঁর নির্ণায়ক ভূমিকার কথা সশ্রদ্ধ ভাবে স্মরণ করেন।

     

    প্রায় আশি বছর আগে গ্যাবো-মার্সেদেস রূপকথার সূচনা। গ্যাবো বলেন তিনি তাঁর হবু স্ত্রীকে প্রথম দেখেছিলেন যখন তাঁর বয়স মাত্র নয়, তাঁর সৌন্দর্য যেন নীল নদের নাগিনীর মতো গোপন ও রহস্যাবৃত ছিলএক পরিচিত জানান, মের্সেদেস হাঁসের ছবি আঁকা একটা আংরাখা পরেছিলেন এবং তিনি নিজে বলেছেন যে, তাঁর প্রায় কিছুই মনে নেই খালি এতটুকু খেয়াল আছে যে, তিনি তখন খুব ছোট ছিলেন। কিছুদিন বাদে গ্যাবো জানতে পারেন মেয়েটি তাঁর বাবার বন্ধু'র জ্যেষ্ঠকন্যা। তাঁর পিতামহ সুদূর মিশরের মানুষ যিনি তাঁকে ছোটবেলায় তার উরুর ওপর দোল খাওয়াতেন এবং আরবিক ভাষায় গান শোনাতেন গার্সিয়া মার্কেজের জীবনীকার জেরাল্ড মার্টিনকে তাঁর এক বাল্যবন্ধু জানিয়েছেন যে, “মের্সেদেস সব সময় অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত, তার সুন্দর চেহারা ছিল, লম্বা এবং ছিপছিপেসেই বয়স থেকেই তিনি নিজের সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং তাঁর ব্যক্তিত্বে একটা নীরব কর্তৃত্ব ছিল। গ্যাবো তাঁর বাবার ফার্মাসির সামনে ঘুরঘুর করতেন এবং মের্সেদেস সব সময়ই বলেছেন, তিনি সেই বিমোহিত অনুরাগী উপস্থিতি সম্পর্কে একেবারেই অবগত ছিলেন না, আদপে তাঁকে কোনও আমলই দিতেন না। ছেলেটি তাঁর বাবার সঙ্গে এত নিবিষ্ট মনে কথা বলতেন যে, তিনি ভাবতেন যে গ্যাবিটো তাঁর পিতার প্রেমে পড়েছে!

     

    এরপর দীর্ঘ সময় ধরে তাঁদের প্রেমপর্ব, যদিও সেটার আনুষ্ঠানিক সূচনা তখন বহু দূর, যেন একটা লুকোচুরি খেলা। 16 ডিসেম্বর, 1950 সালে একটি পত্রিকার লেখায় তাঁদের দুজনের সম্পর্কে উল্লেখ দেখা যায়। মার্কেজ তখন সাংবাদিক হিসাবে নাম করছেন, দু'চারটে ছোট গল্পও বেরিয়েছে তাঁরলেখাটিতে মের্সেদেসকে মার্কেজের বন্ধু বলা হচ্ছে, যাঁর চেহারায় প্রাচ্যের আদল, ধনুকাকৃতি চোখ, তমসাবৃত ত্বক এবং যাঁর আচরণ আন্তরিক এবং স্বস্তিদায়ক। মার্কেজ তখন লাজুক। তিনি নিজে স্বীকার করেছেন যে, তিনি ছিলেন একজনস্ট্রিট কর্নার ম্যান’, সারাদিন অধীর আগ্রহে পায়চারি করতেন কখন দেখা পাওয়া যাবে সেই ভাবলেশহীন, অহঙ্কারী যুবতীর। সেই বছরের খ্রিস্টমাসে অলৌকিক ভাবে গ্যাবো মের্সেদেসকে একটি হোটেলে নিয়ে যায়। এইডা গার্সিয়া মার্কেজ, যিনি দুজনেরই বন্ধু ছিলেন তিনি মার্টিনকে বলেন, "আমরা প্রাদোতে একসাথে নাচতে যেতাম। আমি আমার বাবার সাথে নাচতাম যাতে গ্যাবো মের্সেদেসের সাথে সময় কাটাতে পারে।'

     

    মার্কেজের মতে তাঁদের দুটি পরিবার যখন সুক্রে নামক এক শহরে বাস করত তখনই তিনি বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র আঠেরো, কন্যার তেরোবেশ কিছু সরকারবিরোধী লেখালেখির জন্য যখন তাঁর দেশ ছেড়ে ইউরোপ চলে যাওয়া নিশ্চিত, তখন তিনি তাঁর বাল্যবন্ধুর সঙ্গে তাঁদের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবেন। কারণ প্রবাসে দীর্ঘ অনুপস্থিতির ফলে সময়ের মহাতরঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক যে ভেসে যাবে না সেটার কী নিশ্চয়তা আছে? তুমি কি আমার বাগদত্তা? এই জরুরি প্রশ্নটা গ্যাবিটো জিজ্ঞাসা করতে চায়, কিন্তু কোথা দিয়ে যেন সময় বয়ে যায়। ইউরোপ যাওয়ার আগে এই শেষ সাক্ষাতে কী যে কথা হয়েছিল তা নিয়ে দুজনে কখন মুখ খোলেননি। পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে এটা বোঝা যায় যে, একটাসমঝোতাহয়েছিল। মার্কেজ জেনেভা পৌঁছেই বান্ধবীর চিঠি পান। তিনি উল্লসিত হন এটা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে যে, ইউরোপে তাঁকে যে ভাবে হোক সফল হতে হবে। এরপর তিনি যখন প্যারিসে তখন সপ্তাহে দুবার, তিনবার চিঠি আসতে থাকে। মার্কেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্লিনিও মেন্ডোসা লিখছেন, "সরবোনের ঘড়িতে যখন ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজত, মার্কেজ ডেস্কে বসে তাঁর বাগদত্তা যাঁকে সে খুব অল্পই চিনত, তাঁকে চিঠি লিখত। ডেস্কের ওপর একটা ছোট ফ্রেমে বাঁধানো মের্সেদেসের ছবি তাঁর দিকে চেয়ে থাকত।' প্লিনিও যখন লম্বা চুলওয়ালা, সুশ্রী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকত, মার্কেজ বলতেন, "ইনি হচ্ছেন খাঁটি মকর!'

     

    এরপর বিবাহ তো ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। মের্সেদেস কিন্তু গ্যাবিটো তাঁর বাড়িতে প্রবেশের আগে বিবাহের পোশাক পড়েননি। এমনটা নয় যে তিনি তাঁর প্রেমিককে অবিশ্বাস করতেন; কিন্তু সে যে কতটা উড়নচণ্ডী এটা তো তাঁর মতো আর কেউ জানত না। এমনই একটি রূপকথার সায়াহ্নে এসে মার্কেজ মার্টিনকে বলেন, "কখনও বলেনি যে আমাকে ভালবাসে' মের্সেদেস অর্থবহ ভাবে স্বীকার করেন, ‘গ্যাবো একেবারে অন্য ধরণের মানুষ, একেবারে অন্য

     

     

    তথ্যসূত্রঃ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজঃ আ লাইফ: জেরাল্ড মার্টিন

            

     


    সোমনাথ গুহ - এর অন্যান্য লেখা


    বিচারব্যবস্থার সরকারের অনুগত হয়ে পড়াটাই ভয়ঙ্কর বিপদ

    বইটির প্রকাশনা থেকে ব্লুমসবেরির সরে যাওয়া তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে।

    গুজরাতে ধর্ষণকারীদের মুক্তি দিয়ে বিজেপি-র স্বাধীনতার অমৃত পান

    দেশের নানা প্রান্তে সংখ্যালঘু পীড়ন দেখে যাঁরা চুপ থাকেন, তাঁরা করবেন বিজেপি-সংঘের বিরোধিতা?

    রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী এখন রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

    সরকারের থেকে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা কৃষকের অন্যায্য দাবি নয়, হকের পাওনা

    মার্কেজ-মের্সেদেস: এক অনন্ত প্রেমের রূপকথা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested