শহরে জাঁকিয়ে শীত, মহামারীর ভ্রূকুটিকে দূরে সরিয়ে বর্ষশেষের (Year End) উন্মাদনায় মেতেছে শহর। নিত্যনতুন জিঙ্গলের সঙ্গে মনোহারী সব কেকের বিজ্ঞাপনে চোখে ধাঁধাঁ লাগার অবস্থা। কোনটা ছেড়ে কোনটা যে কিনি! কত বিচিত্র সব নাম, কত বিচিত্র স্বাদ ও মোড়ক। সব স্বাদ যে চেখে দেখেছি এমন নয়, কিন্তু মোড়কে সেই সব বিদেশি স্বাদকে চারকোণা কেকে হাজির করানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাকে দেখেছি।
আমার মফঃস্বল এলাকায় এমন কিছু দোকান থাকে, যেগুলো বিভিন্ন মরসুমে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে। মানে দীপাবলিতে যে দোকানে আতসবাজি কিংবা মিনিয়েচার আলো বিক্রি হল, সেই দোকানেই ডিসেম্বর শেষে সান্তা টুপি এবং রংবেরঙের কেক বিক্রি হয়। ফিরতি পথে চলে বিকিকিনি।
এই সব কেকের আস্বাদ সকলের নেওয়া হয় না। বাতানুকূল কেকের দোকানে সান্তা সেজেগুজে বসে অভিবাদন জানাচ্ছে। কাচঘেরা দোকানের এ পারে জুলজুল চোখে তাকিয়ে কিছু মলিন হয়ে যাওয়া মুখ। কাচের ওপারে থাকা মানুষদের মধ্যে গুঞ্জন, কেকটা কি এগলেস, অর্থাৎ ডিম ছাড়াই কি কেকটা তৈরি হয়েছে? কেউ বা কৌতূহলী এটা জানতে যে কেক প্রস্তুতকারকদের কেউ ইসলাম ধর্মাবলম্বী কিনা! কাচের বাইরের ভুবন এ সব গুঞ্জন শুনতে পায় না, বড় সাধ হয় তবু কেক খেতে।
দ্য লাস্ট সাপারে যিশু তাঁর আস্থাভাজনদের সঙ্গে খাবার খেয়ে কলকাতার রাজপথে নেমে আসেন। কাচের বাইরের দুনিয়ার কাচের বয়ামে বাপুজি কেক থরে থরে সাজানো। কিছু কচি আঙুল ময়লা কয়েন নিয়ে কাতর প্রতীক্ষায়, কখন দোকানি ব্যস্ততায় লাগাম পরিয়ে বিরক্ত মুখে কেকটা হাতে তুলে দেয়। এই কেকের আলাদা কোনও বিজ্ঞাপন নেই, মোড়কের গায়ে লেখা নেই বিশেষ কোনও ফ্লেভারের কথা। তবু মুখে দিলে তৃপ্তি আসে, এখনও সামান্য কটা কয়েনের বিনিময়ে কতশত পেটকে তৃপ্ত করে এই কেক।
আরও পড়ুন: মরণ রে তুঁহু মম পুঁজিবাদ সমান!
উৎসব, আয়োজনে নয়, এই বাপুজি কেক চিরকালীন। ব্র্যান্ডের নামখানা সার্থক— বাপুজি (Bapuji Cake)। ভারতের সমাজে, রাষ্ট্রব্যবস্থায় অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো যে ভাবে গান্ধীবাদী ভাবাদর্শ বয়ে চলে, তাঁর নামাঙ্কিত বাপুজি কেক-ও থেকে যায় এমনই অপরিহার্যতা নিয়ে। বাপুজি কেকে কোন ভোজ্য তেল ব্যবহৃত হয়, তা হিন্দু বানায় না মুসলিম জানার অবসর মেলে না, তবু তা হয়ে ওঠে সাধারণের, কাচের এপারে থাকা ভারতবর্ষের।
ভুবনায়ন, দক্ষিণপন্থার দাক্ষিণ্য কিংবা নব্য পুঁজিবাদের জয়জয়কারে ভারতবর্ষ যতই আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত হয়ে যাক, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বাপুজি-রা দাঁড়িয়ে থাকে সৌভ্রাতৃত্বের দোদুল্যমান সাঁকোটাকে শক্ত করে বাঁধার জন্য, কাচের বাতায়নের বাইরে থাকা মানুষদের সহায় হওয়ার জন্য। অভুক্ত মানুষ মাত্রেই জানেন, ভুখা পেট নিয়ে বড়দিন হয় না, হৃদয়ের আকাশটাকেও বড় করা যায় না।
সংখ্যাগুরুর জন্য,তাঁদেরই দ্বারা শাসিত ভারতবর্ষের একজন নাগরিক হিসাবে খুরশিদের কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী
আমেরিকা আবারও দেখিয়ে দিল এই দেশটা যেমন জর্জ ওয়াশিংটনের, তেমনই জর্জ ফ্লয়েডেরও
অহোম জাতীয়তাবাদে ভর করে আজ হিমন্তরা উচ্চপদে, আর কত মানুষ অসমের অ-সম রাজনীতির বলি হবে?
ক্ষমতা প্রয়োগ করে মহামারীর মোকাবিলার সঙ্গে আইনগত এবং নৈতিক দায়িত্বও পালন করাও উচিত কেন্দ্রের।
ছিন্নমূলের দেশ নেই, সমাজ নেই, আছে জেদ আর কল্যাণকামী রাষ্ট্রের তাচ্ছিল্য ও করুণা।
যারা ছিন্নমূল তাদের ভালবেসে ফেরানো হোক, হিংসার প্ররোচনায় আরও মানুষকে গৃহান্তরী করা শাসকের কাজ নয়।