‘আমার ছেলে এত অল্প বয়সে মাতৃহারা হল। আমি আমার সারা জীবনের বন্ধুকে হারালাম। আমার আর কী রইল বলবেন?’ কথাগুলো বলতে বলতে বছর পঞ্চাশের রাজেশ মন্ডলের গলা ধরে আসছিল। ফোনের ওপারে কাঁদছিলেন তিনি। কোভিডে মৃত্যু মানুষ মেনে নিতে শিখেছে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তির পর অবহেলায়, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু মানা কঠিন।
আরও পড়ুন: ত্রাসের দেশ উত্তরপ্রদেশ
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি রাজেশ বাবু করোনা আক্রান্ত হয়ে যাদবপুরের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। তার তিন দিনের মাথায় তাঁর স্ত্রী পুত্রও যে করোনা পজিটিভ, তা জানা যায়। পরবর্তীকালে তাঁর স্ত্রীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমলে একই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এরপরই রাজেশ বাবুর পরিবারের কাছে উঠে আসতে থাকে একের পর এক ভয়ঙ্কর সব তথ্য। তাঁর স্ত্রী সমানে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বারংবার আত্মীয়দের জানাতে থাকেন তিনি যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না। ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। অক্সিজেনের মাত্রা মেপে দেখা তো হচ্ছেই না, অক্সিজেনও দিচ্ছে না। তিনি তাঁর পুত্র এবং বোনকে ভিডিও করে দেখান তাঁর হাতের স্যালাইনের চ্যানেল থেকে বীভৎস রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অথচ ডাক্তার-নার্সদের দেখা নেই। অবশেষে অন্য আর এক রোগী গিয়ে তাঁদের ডেকে আনলে তবে তাঁরা রোগীকে দেখতে আসেন। বেড প্যান চাইলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় ‘বেড প্যান নেই, বিছানাতেই বাথরুম করতে হবে বাথরুমে যেতে না পারলে।' অসহায় অবস্থায় তিনি তাই করেন। এবং সেই নোংরা, ভিজে জামা কাপড়েই বাকি রাত কাটাতে এক প্রকার বাধ্য হন। ঘেন্নায় গা’টা গুলিয়ে উঠল? তাহলে ভাবুন তো, সেই পরিস্থিতিতে যে ছিল তার কী অবস্থা হয়েছিল! এভাবেই নোংরা অবস্থার মধ্যে রোগীদের রাখা হচ্ছে ওই হাসপতালে।
রাজেশ বাবু নিজেও একই হাসপাতালে ছিলেন, তাঁর অভিজ্ঞতাও মারাত্মক। তিনি জানান, ‘রোজ চোখের সামনে দু’তিন জনকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখতাম। চিৎকার করতে করতে এক সময় তাদের চিৎকার থেমে যেত। তারপর আমাদের সামনেই সেই মৃত রোগীদেরকে কোনও রকম রাখঢাক ছাড়াই সমস্ত পোশাক ছাড়িয়ে স্প্রে করা হত। প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকতাম। বাথরুমে তো যাওয়াই যেত না এত নোংরা, জল নেই কিচ্ছু না। যে ক’দিন হাসপাতালে ছিলাম তাকে বোধহয় একমাত্র নরকের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। আর বাড়ি এসে শুনলাম আমার প্রিয় মানুষটি আর নেই। জানেন আমার স্ত্রীকে শেষে আমাদের না জানিয়ে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে দেওয়া হয়, যেখানে আইসিইউ নেই। আর ওর ভেন্টিলেটর দরকার ছিল যেখানে, সেখানে অক্সিজেনটুকু দেওয়া হল না। অক্সিজেনের অভাবে আমার ছেলে তার মাকে হারাল। কী দোষ বলুন তো বাচ্চাটার?’
আরও পড়ুন: শব বাহিনী গঙ্গা অজস্র রোগ ছড়াবে
সত্যি কী দোষ জানা নেই। উত্তরও দিতে পারিনি রাজেশ বাবুকে শুধু চুপ করে সেই নারকীয় অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে গেছি।
একই রকম বক্তব্য অর্ণব ভৌমিকের। তাঁর বাবা ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন, হঠাৎ অক্সিজেনের মাত্রা কমে শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় অন্য কোথাও বেড না পেয়ে পার্ক সার্কাসের একটি হাসপাতালে ভর্তি করান। তিনি জানান, ‘হাসপাতালটি দেখে এতটুকু ভাল লাগেনি, কিন্তু অক্সিজেন সাপোর্ট দিতেই হবে তাই বাধ্য হয়েই ভর্তি করাই বাবাকে। ভেবেছিলাম অন্য কোথাও বেড পেলেই সরিয়ে নেব। কিন্তু কী করে জানব সেটাই জীবনের বড় ভুল হবে!’ চিকিৎসা পেতে যাওয়া ভুল! হ্যাঁ, আমাদেরই এক সহনাগরিক তাঁর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কারণে এমনটাই মনে করছেন। তাহলে বলুন তো মানুষ কাদের উপর আস্থা রাখবে যদি চিকিৎসক, নার্সরাই মানুষের ভয়ের কারণ হয়! অর্ণব জানান, ‘বাবা ডায়াবেটিক রোগী, সব ওষুধ সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু তাঁকে সেসব কিছু দেওয়া হয়নি। উল্টে করোনারও চিকিৎসা করায়নি। আরসিপিটিআর টেস্ট, সিটি স্ক্যান কিছু না। আমাদের কোনও ডকুমেন্ট দেওয়া হয়নি। তাহলে কীসের ভিত্তিতে ওরা চিকিৎসা করছিল? কিছু জানতে চাইলে, কাগজপত্র দেখতে চাইলে বলা হয়েছে নেই, পাবেন না কিছু। আচ্ছা এমনটা হয়, ম্যাডাম?’
না, এই উত্তরও আমি জানি না অর্ণব। আমি নিরুত্তর প্রতিটা ক্ষেত্রেই। শুধু ঘটনাগুলো শুনে স্তম্ভিত ও আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া আমার কাছে কোনও উত্তর নেই।
অর্ণব আরও জানান, রাজ্য স্বাস্থ্য কমিশনের দ্বারা ইতিমধ্যেই কালো তালিকাভুক্ত ওই হাসপাতালে নন-কোভিড রোগীদের কোভিড রোগীদের সঙ্গেই রাখা হচ্ছিল। ডাক্তার-নার্স সহ কেউই পিপিই কিট পরতেন না। এমনকি রোগীর বাড়ির লোককে সেখানে যেতে দেওয়া হত কোনও রকম প্রোটেকশন ছাড়াই। যেখানে এদিকে দেশের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে, সেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমন আচরণ ভাবনার বাইরে। এ তো যেন জেনে বুঝে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া।
এমন অনেক ঘটনাই সম্প্রতি পিবিটি, অর্থাৎ পিপল ফর বেটার ট্রিটমেন্টের একটি আলোচনা সভায় উঠে এল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কম বেশি অনেকেরই মুখে একই ঘটনা শোনা গেল। সবাই কোনও না কোনওভাবে হয় প্রতারিত হয়েছেন, নইলে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। ডক্টর কুণাল সাহা সহ পিবিটির অন্য সদস্যরা তাঁদের সেই ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য তাঁদের পাশে থেকে আইনি লড়াই লড়ছেন, পথ দেখাচ্ছেন কীভাবে সঠিক বিচার পাওয়া যেতে পারে। রাজেশবাবুর বক্তব্য, যাঁরা তাঁর স্ত্রীকে ‘খুন’ করেছে, তাঁদের বিচার চাই। বিচারের প্রক্রিয়া দীর্ঘ, খরচসাপেক্ষ এবং প্রচুর উদ্যম প্রয়োজন হয়। আপাতত সন্তানকে নিয়ে রাজেশবাবুর সেই লড়াইয়ের সঙ্গী পিবিটি।
নিয়তি আজ সময়ের কাছে, অর্থের কাছে, ক্ষমতার কাছে অসহায়। সে শুধু ধ্বংস খেলা দেখে চলেছে।
রিখটার স্কেলে 9.4-9.6 মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে বলে গবেষকরা দাবি করছেন।
মৃত্যুর পর কি সব আত্মাই মুক্তি পেয়ে যায় জাগতিক সমস্ত বন্ধন থেকে?
নেপথ্যে থেকে কাজ করে দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে রসদ জুগিয়েছিলেন চন্দননগরের মতিলাল এবং মনীন্দ্রনাথ।
জীবনে সফল হয়ে তারা যেন গর্ব ভরে বলে, 'রোল কাকুর জন্যই আমাদের এই সফলতা।'
কোভিড হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, নরক যন্ত্রণা ভোগ ও কার্যত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু।