অনেকেরই আক্ষেপ যে পশ্চিমবঙ্গে কৃষক আন্দোলনের কোনও প্রভাব নেই। সংযুক্ত কিসান মোর্চার নেতারা নির্বাচনের আগে এই রাজ্যে প্রচারে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা কৃষকদের বোঝাবেন যে তিন ‘কালা’ কৃষি আইন বাংলার চাষিদের পক্ষে একইরকম ভাবে ক্ষতিকর। তাঁরা দাবি করবেন, এখানে আরও অনেক কিসান মান্ডি চাই এবং শস্যের অভাবী বিক্রি বন্ধ করার জন্য অবশ্যই ফসলের লাভজনক মূল্য চাই। সর্বোপরি তাঁরা প্রমাণ করবেন যে, এই আন্দোলন শুধু কৃষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, এটাকে সর্বাত্মক ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে হবে। তাঁরা 294টি বিধানসভা কেন্দ্রে যাবেন এবং নির্দিষ্টভাবে বিজেপিকে একটিও ভোট না দেওয়ার জন্য প্রচার করবেন। কৃষক নেতাদের এই সিদ্ধান্ত একটি মাইলফলক, কারণ প্রায় 100 দিন পূর্ণ হওয়া এই আন্দোলন এই প্রথম বিজেপির সঙ্গে সরাসরি নিজেদের মঞ্চ থেকে নির্বাচনী টক্করে লিপ্ত হল।
এর আগে কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত ও তাঁর দাদা নরেশ টিকায়েতের নেতৃত্বে জাঠরা উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে জিততে সাহায্য করেছিলেন। তখন তাঁরা বিজেপির পক্ষে ছিলেন এবং অন্তরালে থেকে তাদের সাহায্য করেছিলেন। 28 জানুয়ারি রাতে গাজিপুরে বিশাল পুলিশ বাহিনী যখন বলপূর্বক কৃষকদের উচ্ছেদ করতে উদ্যত, তখন আবেগতাড়িত রাকেশ স্বীকার করেছিলেন যে, ওই নির্বাচনগুলিতে তাঁরা বিজেপিকে সাহায্য করে ভুল করেছিলেন। তারপর গত এক মাস ধরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন জেলায় অন্তত 200টি মহাপঞ্চায়েত ও খাপের সভা হয়েছে। ইতিমধ্যে তাঁরা 18 ফেব্রুয়ারি দেশ জুড়ে দুপুর বারোটা থেকে চারটে অবধি ‘রেল রোকো’ করেছেন। 23 ফেব্রুয়ারি ‘পাগড়ি সামাল দিবস’ পালন করেছেন এবং চাচা অজিত সিং এবং স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। 24 তারিখ সমস্ত রকম দমনপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষকরা ‘দমন বিরোধী দিবস’ পালন করেন। 26 তারিখ তাঁরা ‘যুব কিসান দিবস’ এবং পরের দিন ‘মজদুর কিসান একতা দিবস’ পালন করেন। সংযুক্ত কিসান মোর্চার নেতারা ঘোষণা করেছেন যে 2 অক্টোবর অবধি আন্দোলন চলবে। কেন 2 অক্টোবর? চার মাস বাদে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। কৃষি আইন প্রত্যাহার না করলে যোগী আদিত্যনাথের সরকারকে তাঁরা নির্ঘাৎ উল্টে দেবেন। হরিয়ানায় জিন্দ মহাপঞ্চায়েতে নেতারা বলেছেন শুধু ‘বিল ওয়াপসি’ নয়, এখন আমরা ‘গদি ওয়াপসি’ও বলব। বাংলায় বিজেপি যাতে কোনওভাবেই ক্ষমতায় না আসতে পারে, সেটা তাঁরা নিশ্চিত করবেন।
সরকার এতদিন কৃষকদের খলিস্তানি, নকশাল, সন্ত্রাসবাদী ইত্যাদি বলে বদনাম করার চেষ্টা করেছে। দেখল তাতে কোনও লাভ হল না। এখন বলছে এরা আন্দোলনজীবী, আন্দোলন করে খায়, পরজীবী! ফল হচ্ছে উল্টো, আন্দোলন আরও বিস্তার লাভ করছে। দক্ষিণ ভারতের মানুষও বিভিন্নভাবে যুক্ত হচ্ছেন আন্দোলনের সঙ্গে। আর সাড়া উত্তর ভারত জুড়ে মহাপঞ্চায়েত আর খাপ- পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ জুড়ে কৃষকরা প্রবল উৎসাহের সঙ্গে মহাপঞ্চায়েতে যাচ্ছেন, খাপের ডাকা সমাবেশে হাজির হচ্ছেন।
আরও পড়ুন: সিঙ্ঘু-টিকরিতে আজকের গোয়েবলস
মহাপঞ্চায়েত বা খাপ এই কথাগুলো আমাদের বাংলায় প্রচলিত নয়। পঞ্চায়েত আমরা জানি ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের একটি সংগঠন। সব ধর্ম, জাত নিয়ে এই সংগঠন। জাঠ, ঠাকুর, গুর্জর, মুসলমান, দলিত সবাই এতে আছেন। অনেকগুলো পঞ্চায়েত নিয়ে যখন সভা হয় তখন সেটা হয় মহাপঞ্চায়েত। সারা উত্তর ভারত, মহারাষ্ট্র, গুজরাত জুড়ে বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনে এঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। খাপ একটি বিশেষ জাতের গ্রামভিত্তিক সংগঠন, যা সেই জাতের প্রবীণদের দ্বারা পরিচালিত হয়। খাপ সরকার স্বীকৃত নয়। নারী স্বাধীনতা এবং নিজেদের জাতের শুদ্ধতা রক্ষার ক্ষেত্রে এঁরা গোঁড়া। কিন্তু কৃষকদের ইজ্জত, দাবিদাওয়ার প্রশ্নে এঁরা এককাট্টা। তখন তাঁরা কোনও জাত, ধর্ম এইসবের পরোয়া না করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
28 জানুয়ারি রাতে বিশাল পুলিশ বাহিনী গাজিপুরে যখন কৃষকদের উৎখাত করার চেষ্টা করে, তখন ভিডিওতে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। মুজফফরনগর জেলায় টিকায়েতের গ্রাম সিসৌলিতে উত্তরপ্রদেশের শামলি, বাগপত, সাহারানপুর ইত্যাদি স্থান থেকে কৃষকরা দলে দলে এসে জমায়েত হন। নরেশ টিকায়েত সেখানে ভাষণ দেন। উত্তেজিত জনতা সেই রাতেই গাজিপুর রওনা দেন। কৃষকদের রণংদেহী মূর্তি দেখে পুলিশ পিছু হটে। এরপর দিকে দিকে মহাপঞ্চায়েত শুরু হয়ে যায়- উত্তরপ্রদেশে মথুরা, বাগপত, বিজনৌর, হরিয়ানায় জিন্দ, পাঞ্জাবের জগরাঁও, রাজস্থানের মেওয়াত, সিকার অঞ্চল প্রভৃতি। এই সভাগুলির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা দরকার।
(1) হিন্দু জাঠ নেতারা স্বীকার করেন যে, 2013 সালে মুজফফরনগর দাঙ্গায় বিজেপি নেতাদের দ্বারা তাঁরা ব্যবহৃত হয়েছিলেন। তাঁরা অনুতাপ করেন যে, মুসলমানদের আক্রমণ করা তাঁদের উচিত হয়নি। আশার কথা হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছিল, তা গত দুই তিন বছর ধরে মেরামত করার প্রচেষ্টা চলছে। এই কৃষক সংগ্রামে হিন্দু ও মুসলমান জাঠ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছেন। ইতিমধ্যেই এটা একটা বড় প্রাপ্তি।
(2) বিপুল সংখ্যক মহিলা মহাপঞ্চায়েতগুলিতে অংশগ্রহণ করছেন। হরিয়ানার জাঠ অধ্যুষিত অঞ্চলে এবং রাজস্থানে এঁদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। হরিয়ানার চারখি দাদরিতে টিকায়েত বলেন, এটা কৃষকদের স্বাধীনতার লড়াই, কোনও বিশেষ জাত বা ধর্মের লড়াই নয়।
(3) রাজস্থানের মেওয়াত অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মুসলমান উপস্থিত ছিলেন। এঁরা মায়ো মুসলিম হিসাবে খ্যাত। খাপ ও ধর্মীয় নেতারা ভাষণ দেন। 1988 সালে নরেশ ও রাকেশের বাবা, মহেন্দ্র সিং টিকায়েত দিল্লিতে কৃষকদের এক বিশাল জমায়েত করে জনজীবন স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন। বাবা টিকায়েতের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন গুলাম মহম্মদ জোলা। মুজফফরপুর দাঙ্গার কারণে টিকায়েতদের সঙ্গে মাঝে তাঁর সম্পর্কে চিড় ধরেছিল। কিন্তু আবার তিনি অত্যন্ত সক্রিয়। আরও অনেক সভার মতো এখানেও তিনি ছিলেন প্রধান বক্তা।
তাই পশ্চিমবাংলায় প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচারের সিদ্ধান্ত আকস্মিক কোনও ঘটনা নয়। নানা উপায়ে নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে কৃষক নেতারা এটা উপলব্ধি করছেন যে, কেন্দ্রের শাসক দলকে রাজনৈতিক ভাবে নির্বাচনী যুদ্ধেও পরাজিত করা জরুরি। বিরোধী দলগুলির শক্তি বৃদ্ধিও প্রয়োজন, যাতে সংসদ ও বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে শাসকের মোকাবিলা করা যায়। আসন্ন নির্বাচনে এই রাজ্যে কৃষক নেতাদের প্রচার সন্দেহাতীত ভাবে ভোটযুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
পড়ে থাকে ছড়ানো ছিটানো কিছু শুকনো রুটি, বিশ্বের দরবারে যা ভারতের মানুষের ক্ষুধার বীভৎস চিত্র।
দেশের গরিব মানুষের খাবার নেই, দুর্বলের অবস্থা আরও খারাপ, সেই খবর প্রকাশেও বাধা
দ্রৌপদীরা নগ্ন হয়ে প্রতিবাদী হলে পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভয় পায়, নিজেদের কৃতকর্ম ঢাকা দিতে চায়।
গুজরাতে ধর্ষণকারীদের মুক্তি দিয়ে বিজেপি-র স্বাধীনতার অমৃত পান
প্রায় আশি বছর আগে গ্যাবো-মার্সেদেস রূপকথার সূচনা।
কোনও কিছুই আর গোপন নয় আমাদের জীবনের।