‘ষাট-ষাট-ষাট...এই একষট্টি-বাষট্টি-তেষট্টি...’— সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’-র একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় দৃশ্য, যেখানে শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে আর উধো অকারণেই নিলাম ডাকছে এবং কথককেও বলছে নিলাম ডাকতে। নিলামের এমন হাস্যকৌতুক মাখা দৃশ্য দেখার বা পড়ার সুযোগ হয়তো তারা পাননি, তবে এই নিলামের তত্ত্বের জন্যই অর্থনীতিতে এবার নোবেল পুরস্কার পেলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রবার্ট উইলসন এবং তার শিষ্য পল মিলোগ্রাম। উইলসনকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি নিলাম থেকে কখনও কিছু কিনেছেন কিনা, তিনিও তেমন কিছু মনে করতে পারেননি। পরে, তাঁর স্ত্রী বলেন, তিনি ই-বে থেকে নিলামে স্নো-বুট কিনেছিলেন সস্তায়। এখান থেকেই প্রশ্ন জাগে, নিলাম সংক্রান্ত তত্ত্ব সাধারণ মানুষের জীবনে কী কাজে লাগতে পারে?
নিলাম কীরকম হয়, তা সাধারণ মানুষ আইপিএলের ক্রিকেটারদের নিলামের সময়ই দেখেছেন। কিন্তু, এই ধরনের নিলাম পদ্ধতি অত্যন্ত প্রাচীন বা সনাতনী নিলাম পদ্ধতি, যা মূলত নিলামঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মাঝে-মাঝে কোনও কোনও বিষয়ের নিলাম খবরের পাতায় জায়গা করে নেয়। যেমন, গান্ধিজীর চশমা, পিকাসো বা ভ্যান গঘের ছবি ইত্যাদি। কিন্তু এইসবের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ, আমরা রোজ যে চা খাই বা কফি খাই, সেগুলোও কিন্তু বাজারজাত হয় নিলামকুঠিতে নিলাম হওয়ার পরেই। এই চা-এর নিলাম এখন যদিও অনলাইনেই হয়ে থাকে, প্রধানত দুর্নীতি কমানোর জন্যই। সারা বিশ্বে কফি, তেল, কয়লা, এমনকি, কোনও কলকারখানা কতটা দূষণ করতে পারবে তা-ও নির্ধারিত হয় নিলামের মাধ্যমেই। আবার, বেশ কিছু পশ্চিমের দেশে বিদ্যুতের দামও নির্ধারিত হয় নিলামের মাধ্যমে। এরফলে, প্রতিদিনই হেরফের হয় বিদ্যুতের দামের। মোবাইল ফোনের সংযোগ কোন কোম্পানি কী দরে দিতে পারবে তা নির্ভর করে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির নিলামের ওপরেই। এই নিলাম করে থাকে দেশের সরকার। সরকারি ঋণ নেওয়ার সময়ে ঋণপত্র খোলা বাজারে ছাড়া হয় নিলামের সাহায্যেই।
এবার আসা যাক নিলামের পদ্ধতি আর বিন্যাসে। সাধারণত নিলাম দু'ভাবে হয়ে থাকে। একটি হয় ব্রিটিশ বন্দোবস্তে, অপরটি হয় ডাচ ব্যবস্থায়। নিলামের আগে নিলামের নিয়ম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যেমন, নিলামের দর চিৎকার করে হাঁকা যাবে নাকি মুখবন্ধ খামে দরপত্র জমা দিতে হবে? একটি নিলামে একজন কতবার দাম হাঁকতে পারবে? যদি কোনও নিলামে অংশগ্রহণকারীকে কেউ হারাতে না পারে তা হলে শেষে কী দামে সেই জিনিসটি তিনি কিনবেন? ইত্যাদি।
বিভিন্ন নিলাম সংস্থায় যে ব্যবস্থা প্রচলিত তা এক কথায় ব্রিটিশ বন্দোবস্ত। অর্থাৎ, সব জিনিসেরই কম দাম থেকে শুরু করে সবচেয়ে বেশি দামে যে কিনতে প্রস্তুত, তাকে বিক্রি করা হয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামে। ষাটের দশক থেকে এই পদ্ধতি উইলিয়াম ভিকরের নামে খ্যাত। উনবিংশ শতাব্দীতে ডাকটিকিটের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, তারা এই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। অন্যদিকে, ডাচ পদ্ধতিতে অত্যন্ত বেশি দামে নিলাম শুরু হয় এবং যখন সেই দামে কেউ তা কিনতে চায় না, তখন আস্তে আস্তে দাম কমতে থাকে। ব্রিটিশ বা ইংলিশ নিলাম ব্যবস্থায় একটি জিনিসের দাম তার যথার্থ মূল্যের চেয়ে একটু কমই ঘোষিত হয়। আর ডাচ ব্যবস্থায় জিনিসের দাম কমতিই থাকে। ক্রেতারা সবাই অপেক্ষা করে থাকে, কিন্তু প্রকৃত মূল্যের নতুন তথ্য জানার আগেই কেউ সেই দ্রব্য কিনে ফেলে।
এবার আরও একটি প্রশ্ন উঠে আসে এবং সেটি হল, নিলামের সর্বোচ্চ দাম কত উঠবে এবং কেউ কেন সেই দ্রব্য কিনতে চাইবে? এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ভেবলেনের তত্ত্বের উল্লেখ করা যায়। কোনও জাঁকজমক সম্পন্ন দ্রব্যের দাম যত বেশি হয়, সেই দ্রব্য কেনার তাগিদ তত বেশি হয়। অর্থাৎ, সেই দ্রব্যের চাহিদার পরিমাণ তত বাড়ে। অর্থনীতিতে একে ‘ভেবলেন প্রভাব’ বলা হয়। অর্থাৎ, ভ্যানগঘ বা পিকাসোর আঁকা কোনও ছবি যদি কোনও ব্যক্তি তার বসার ঘরে টাঙিয়ে রাখেন, তাহলে তিনি তার বাড়িতে আসা অতিথিদের কাছ থেকে প্রশংসা পাবেন। আর সেই প্রশংসার লোভেই অংশগ্রহণকারী অনেক বেশি দর হাঁকবেন। আবার, কোনও দ্রব্যের নিলামের টাকা বন্যা দুর্গতদের দান করা হবে ঘোষণা করা হলে, দু'রকম ক্রেতা দু'রকম দাম হাঁকতে পারেন। এটা সম্পূর্ণ ক্রেতার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। আবার, বেশকিছু ক্ষেত্রে যারা নিলামে অংশগ্রহণ করছেন, তারা সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে কম দাম হেঁকে বিক্রেতাকে বিপদেও ফেলতে পারেন। ভারতে চায়ের ব্যবসায় এরকম বিষয় ঘটেছিল। অনলাইনে নিলাম শুরু হওয়ায় এই সমস্যা অনেকাংশেই মিটে গেছে। কারণ, সবাই গোপনে একসঙ্গেই দর ঘোষণা করছে। তা ছাড়া অনেক ক্রেতা যারা এর সঙ্গে যুক্ত নন, তারাও এতে অংশ নিতে পারেন।
মিলগ্রোম-উইলসনের নিলাম তত্ত্বটি আগের তত্ত্বের থেকে অনেকটা উন্নত। এই তত্ত্বের মূল অবদান হল সরকারি মালিকানাধীন সম্পদের বণ্টনে নৈপুণ্যের সঙ্গে কোষাগারের রোজগার বৃদ্ধির। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের কল্যাণ-সাধন করা। সরকারকে যদি বিশাল দাম দিয়ে কোনও জায়গা কিনতে হয়, বেসরকারি সংস্থাগুলি সাধারণ মানুষের কাছেও বেশি দাম চাইবে; যা অর্থনীতির ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করবে। এই ভারসাম্য রক্ষা করা অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যেমন, সরকারের রাজস্ব পরিকাঠামো খাতে খরচ হলে নিলাম করা পরিষেবার দামের ভার জনসাধারণের উপর অতটা চেপে বসে না। তাই আমরা তত্ত্ব বুঝি বা না বুঝি, নিলামে কোনও সম্পদের সঠিক দাম নির্ধারণের সঙ্গে আমাদের নিজেদের আর্থিক স্বার্থ খুব ঘনিষ্ঠভাবেই জড়িত।
যে দেশের শিশু অপুষ্ট রুগ্ন তার নেতাদের মুখে শক্তিশালী ভারতের কথা মানায় না।
সাধারণত নিলাম দু'ভাবে হয়ে থাকে। একটি হয় ব্রিটিশ বন্দোবস্তে, অপরটি হয় ডাচ ব্যবস্থায়।
পরিযায়ী শ্রমিক মা ক্ষুধা-তৃষ্ণার সঙ্গে লড়াইটা মুলতুবি রেখেই তার একরত্তি সন্তানকে ছেড়ে চলে গেল।
এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথিবীর যেসব দেশে ক্ষুধা একটি ভয়াবহ সমস্যার আকার ধারণ করছে, ভারত তাদের অন্যতম