‘অনাহারে নাহি খেদ,
বেশী খেলে বাড়ে মেদ।‘
একবিংশ শতাব্দীর যে সময়ে আমরা বাস করছি, যেখানে স্বেচ্ছাকৃত অনাহারে থাকা মেদবিহীন শরীরের এক অদ্ভুত চাহিদা আছে। তাই, সেলুলয়েডের নায়ক-নায়িকা থেকে শুরু করে পাড়ার কাকিমা-মাসিমা সবারই চাই নির্মেদ চেহারা। এরজন্য কতশত শক্ত শক্ত নামের ডায়েট রুটিন মেনে চলেন তারা। উৎসবের মরশুমের আগে তো এই ডায়েট করে নির্মেদ চেহারা পাওয়ার ইচ্ছা আরও বাড়ে। এই উৎসবের মরশুমের শুরুতেই প্রকাশিত হল 'World Hunger Report', যা আরও একবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিল যে না খাওয়ার অন্য একটা দিকও আছে – খেতে না পাওয়া। এই রিপোর্ট থেকেই বোঝা যায়, কোন দেশের মানুষ কত বেশি ক্ষুধার্ত। Global Hunger Index বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক দিয়েই এটা প্রকাশ করা হয়। ক্ষুধা সূচকের তিনটি নির্ধারক আছে—
1. দেশের মোট জনসংখ্যা এবং অপুষ্টিতে ভোগা জনসংখ্যার অনুপাত (শতাংশে প্রকাশ করা হয়)।
2. পাঁচ বছরের কম বয়সী অপুষ্টির শিকার শিশুর অনুপাত।
3. পাঁচ বছরের থেকে কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার।
এই তিনটি তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশকে নম্বর দেওয়া হয় 100-র মধ্যে— এক্ষেত্রে শূন্য পাওয়া মানে দেশে ক্ষুধা নেই এবং 100 পাওয়া মানে দেশের মানুষ ভীষণরকমের ক্ষুধার্ত। এ বছরের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত দেশ হল আফ্রিকার চাদ। এই রিপোর্টে প্রথম স্থান (অর্থাৎ খিদের প্রয়োজন মেটাতে পেরেছে এমন অবস্থা) অর্জন করেছে সতেরো'টি দেশ। এই দেশগুলির মধ্যে কিউবা, কুয়েত, বেলারুশ, ইউক্রেন, তুরস্ক, চিন উল্লেখযোগ্য। এই বছর 107টি দেশকে নিয়ে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। ভারতের স্থান সেখানে 94। আমাদের দেশের শতকরা 17 ভাগ মানুষ রোজ ক্ষুধার্ত থাকেন। অর্থাৎ, প্রতি 100 জনে 17 জন মানুষ যথেষ্ট খেতে পান না। আমাদের সমস্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্রই আমাদের থেকে ভাল অবস্থায় রয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথিবীর যেসব দেশে ক্ষুধা একটি ভয়াবহ সমস্যার আকার ধারণ করছে, ভারত তার মধ্যে অন্যতম। এই দেশের শতকরা 14 ভাগ মানুষ অপুষ্টির শিকার। ভারতে শতকরা প্রায় 38 শতাংশ শিশু খর্বতার শিকার এবং গুরুতরভাবে অপুষ্ট।
ভারতের এ হেন অবস্থার কারণ পর্যালোচনা করতে গেলে দেখা যায় যে, এই দেশের ক্রেতার দামসূচক (Consumers' Price Index) বেড়ে হয়েছে প্রায় 157। এর অর্থ হচ্ছে, ভিত্তি বছরের তুলনায় চলতি বছরে জিনিসের দাম বেড়েছে প্রায় 57 শতাংশ। খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে দামবৃদ্ধি পেয়েছে সর্বাধিক। তাই, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায়, তারা তাদের দরকারি খাবার পাচ্ছে না এবং অপুষ্টিতে ভুগছে। আমাদের দেশের একটি বড় অংশ নিরামিষভোজী— তাই, প্রাণীজ প্রোটিন তারা খান না। এমনকী, বেশকিছু স্কুলের মিড-ডে মিলেও ডিম বাদ দেওয়া হয়। তাই, খাদ্যাভ্যাসের ধরণের কারণেও ছোটোবেলা থেকেই অপুষ্টির শিকার হয় এদেশের বহু মানুষ।
এই দেশে নিরামিষভোজীদের পুষ্টির একটি বড় অংশ হল ডাল। অথচ, করোনা পরবর্তী সময়ে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ডালের মতো পণ্য। আর করোনা এবং লকডাউনের সময় থেকেই বৃদ্ধি পেয়েছে ডালের দাম (প্রায় 20 শতাংশ)। এই পরিস্থিতিতে পুষ্টির প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয়নি।
এই অপুষ্টি এবং খাদ্যের চাহিদা বা খিদের প্রতিফলন পড়ছে রোজকার জীবনেও। তাই, এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী দেশগুলির মধ্যে ভারত অন্যতম। যে সমস্ত নির্ধারকের ভিত্তিতে সুখের সূচক নির্ধারিত হয়, তার মধ্যে স্বাস্থ্য অন্যতম একটি নির্ধারক। যে দেশের 14 শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার, সেই দেশ যে বিশ্বের অসুখী দেশগুলির মধ্যেই থাকবে, তা আশ্চর্যের কিছু নয়। পৃথিবীর 156 টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান সেখানে 144 নম্বরে! World Happiness Report এবং World Hunger Report পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, যে সকল দেশের মানুষ যত বেশি ক্ষুধার্ত, সেই সকল দেশ তত বেশি অসুখী।
রোগময় এক ক্ষুধার্ত পৃথিবীতে, পেটের শান্তি আনতেই, নোবেল শান্তি পুরষ্কার পায় World Food Programme-এর মতো সংস্থা। যার কাজ হল, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খাবার দিয়ে সাহায্য করা। একদিকে বাড়তে থাকা ক্ষুধা আর অন্যদিকে মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্ত করার মতো কর্মে ব্রতী হওয়া সংস্থার নোবেল পাওয়া— জঠর জ্বালা মেটানোর মতো শান্তি হয়তো আর কিছুতে হয় না।
যে দেশের শিশু অপুষ্ট রুগ্ন তার নেতাদের মুখে শক্তিশালী ভারতের কথা মানায় না।
এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথিবীর যেসব দেশে ক্ষুধা একটি ভয়াবহ সমস্যার আকার ধারণ করছে, ভারত তাদের অন্যতম
সাধারণত নিলাম দু'ভাবে হয়ে থাকে। একটি হয় ব্রিটিশ বন্দোবস্তে, অপরটি হয় ডাচ ব্যবস্থায়।
পরিযায়ী শ্রমিক মা ক্ষুধা-তৃষ্ণার সঙ্গে লড়াইটা মুলতুবি রেখেই তার একরত্তি সন্তানকে ছেড়ে চলে গেল।