"হাতুড়ি-শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়, পাহাড়-কাটা সে পথের দু'ধারে পড়িয়া তাদের হাড়...।' সেই হাড়ের মালিকদের রাষ্ট্র আর গুনে দেখে না। পাছে তাদের পরিবার-পরিজন, ভাবীকালের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। এর থেকে গোনা হয়নি বলে যদি এই দায় কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায়, তাতেই মঙ্গল।
দৃশ্যপট 1: স্থান মুজফ্ফরপুর স্টেশন। একটি শিশু স্টেশনে বসে কাঁদছে। পাশে তার মা শুয়ে আছে। তার মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা। সন্তান বারবার তাকে ডাকছে। তবু মা উঠছে না সেই ডাক শুনে। তারপর দেখা গেল সেই মা চিরনিদ্রায় ডুবে গিয়েছে। শিশুটির অজ্ঞাতেই তার মা চিরঘুমের দেশে চলে গেছে। সেই মা আর ছেলে দু'জনেই যাত্রা করছিল ট্রেনে; গুজরাট-মুজফ্ফরপুর এক্সপ্রেসে (শ্রমিক-স্পেশাল)। পরিযায়ী শ্রমিক মা ক্ষুধা-তৃষ্ণার সঙ্গে লড়াইটা মুলতুবি রেখেই তার একরত্তি সন্তানকে ছেড়ে চলে গেল।
দৃশ্যপট 2: স্থান ঔরঙ্গাবাদ, মহারাষ্ট্র। রেললাইন ধরে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছে ট্রেন। ট্রেনটি চলে যাওয়ার পর দেখা গেল এক জায়গায় কিছু জমাট বাঁধা রক্ত, মাংস-পিণ্ড আর কিছু শুকনো রুটি পড়ে আছে। দেশজুড়ে হঠাৎ ঘোষণা করা লকডাউনের পর মাইলের পর মাইল হেঁটে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার দৃশ্যগুলো এখনও দেশের মানুষ ভোলেনি। সেই পরিযায়ী শ্রমিকদেরই কয়েকজন পথের ক্লান্তি দূর করতে রেললাইনেই শুয়ে পড়েছিলেন একটু জিরিয়ে নিতে। তারপর বাকিটা...
দৃশ্যপট 3: স্থান দেশের সংসদ। বাদল অধিবেশনের প্রথম দিন। নেই কোনও জিরো আওয়ার। মহামারী কিংবা চিনা আগ্রাসন— অপ্রিয় প্রশ্ন শুনতে নারাজ সরকারপক্ষ। তারই মধ্যে দেশের শ্রমমন্ত্রীকে লিখিত প্রশ্ন করে এক সাংসদ জিজ্ঞেস করেন, দেশে কতজন পরিযায়ী শ্রমিক মারা গেছেন? তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে কীভাবে? এর উত্তরে মন্ত্রী মহোদয়ের অকপট স্বীকারোক্তি, দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু সংক্রান্ত কোনও তথ্যই তাঁর কাছে নেই। সুতরাং, কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
উপরের তিনটি দৃশ্যের প্রত্যেকটিরই সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। প্রথম দুটি দৃশ্য সোশাল মিডিয়া থেকে খবরের কাগজ সব জায়গাতেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সরকার বাহাদুরের মনে সেগুলো দাগ কাটতে সক্ষম হয়নি, তা বোঝা গেল তিন নম্বর দৃশ্যে; সংসদে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর জবাবি বক্তব্যে। অবলীলাক্রমে, শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, এই সংক্রান্ত কোনও তথ্যই সরকারের কাছে নেই। এমনকী, এই অতিমারীতে কত শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন সেটাও নাকি সরকার জানে না!
করোনাকালে লকডাউনের সময় প্রথমে ঘোষণা করা হল, "One Nation, One Ration Card Scheme।' অর্থাৎ, কোনও পরিযায়ী শ্রমিকের কাছে যদি অন্য কোনও জায়গার রেশন কার্ড থেকে থাকে, তবে সেই রেশন কার্ড দেখিয়ে সে সেই অঞ্চল থেকেও বিনামূল্যে রেশন পাবে। এমনকী, রেশন-কার্ড না থাকলেও সে রেশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না। কিন্তু যদি শ্রমমন্ত্রকের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে সঠিক তথ্যই না থাকে, তবে এই খাদ্যদ্রব্য কতজন মানুষের জন্য বরাদ্দ হবে? সেই বরাদ্দ খাদ্যদ্রব্য তাদের জন্য পর্যাপ্ত কিনা, সেটাই বা জানা যাবে কীভাবে? "প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরও জানা।'
করোনা আবহে "শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন' চালু করার সময় কেন্দ্রের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছিল যে, সমস্ত ট্রেনের টিকিটের ভাড়ার 85 শতাংশ বহন করবে কেন্দ্রীয় সরকার। সুপ্রিম কোর্ট সলিসিটর জেনারেলের কাছে এই সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করেছিলেন। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, কেন্দ্রীয় সরকার ট্রেনের টিকিটে যে 85 শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলেছিল সেটা তো দেয়ইনি, উপরন্তু করোনা আবহে ট্রেন চালানোর জন্য পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত 50 টাকা ভাড়াও নিয়েছে। এর ফলে নিঃস্ব, অসহায় শ্রমিকদের উপর বাড়তি চাপের সৃষ্টি হয়। যদিও, বিভিন্ন রাজ্য এগিয়ে এসে এই ভাড়া মিটিয়ে দিতে রাজি হয়। কিন্তু রাজ্যগুলির এই উদ্যোগও কেন্দ্রের পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি উদাসীনতাকে ঢাকতে পারেনি। মোদ্দা ব্যাপার, এই যে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দু'দফা আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হল, সেটা কারা পাবেন, ক'জন পাবেন সেটারও কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে নেই। আবার অর্থমন্ত্রককে এই সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর আসতেই পারে যে সবকিছুই "ভগবান' পাবেন। যা কিছু বিড়ম্বনার উদ্রেক ঘটায়, সেসব কিছু বিস্মৃতির অতলে ফেলে দেওয়াই ভাল। সরকার বাহাদুর ঠিক সেই সহজ কাজটিই করেছেন। যারা ভোটার নন, যারা শাসকের সভায় ভিড় বাড়ায় না, তাদের দু'-পাঁচজন টেঁসে গেলেও সরকারের ভ্রূক্ষেপ হওয়া উচিত নয়। সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে কবির সেই অমোঘ উক্তির কথা মনে পড়ে যায়, "মানুষ বড় সস্তা, কেটে ছড়িয়ে দিলে পারত।'
সাধারণত নিলাম দু'ভাবে হয়ে থাকে। একটি হয় ব্রিটিশ বন্দোবস্তে, অপরটি হয় ডাচ ব্যবস্থায়।
এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথিবীর যেসব দেশে ক্ষুধা একটি ভয়াবহ সমস্যার আকার ধারণ করছে, ভারত তাদের অন্যতম
যে দেশের শিশু অপুষ্ট রুগ্ন তার নেতাদের মুখে শক্তিশালী ভারতের কথা মানায় না।
পরিযায়ী শ্রমিক মা ক্ষুধা-তৃষ্ণার সঙ্গে লড়াইটা মুলতুবি রেখেই তার একরত্তি সন্তানকে ছেড়ে চলে গেল।