16 অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস। তার ঠিক দিন-তিনেক আগে প্রকাশিত হল বিশ্ব ক্ষুধাসূচক (World hunger Index) এবং তার তালিকা। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) কর্তৃক প্রকাশিত এই রিপোর্টে ভারত আগে 107টি দেশের মধ্যে 94তম স্থানে ছিল এবং সকল প্রতিবেশী দেশই ক্রমতালিকায় ভারতের থেকে এগিয়ে ছিল। এই বছরে প্রকাশিত রিপোর্টেও এই ছবির খুব বেশি বদল নজরে আসেনি। এই বছর ভারত আরও সাত ধাপ নিচে নেমে এসে 116টি দেশের মধ্যে 101তম স্থানে ঠাঁই পেয়েছে। বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, এমনকি তালিবানিহামলায় বিধ্বস্ত আফগানিস্তানও তালিকায় ভারতের থেকে এগিয়ে রয়েছে।
UNDP ভারতের অবস্থাকে অতি বিপজ্জনক আখ্যা দিয়েছে। ভারতের পিছনে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু দেশ। এই দেশের প্রায় 17.3 শতাংশ শিশু চরম অপুষ্টির শিকার। অর্থাৎ, প্রতি একশো শিশুর মধ্যে অন্তত 17টি শিশু চরম অপুষ্টিতে ভোগে। এই তালিকাতে চিন, কিউবা, ব্রাজিল সহ পনেরোটি দেশ উঠে এসেছে প্রথম স্থানে।
যদিও, এদেশের নারী ও শিশু কল্যাণ উন্নয়ন মন্ত্রক দোষ চাপিয়েছে ক্ষুধা-সূচক নির্ধারণের পদ্ধতির ওপর- পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে যেমন পড়ুয়ারা অভিযোগ করে থাকে শিক্ষক নম্বর দেননি বা প্রশ্ন শক্ত হয়েছে, তেমনই ব্যাপার আর কী! নারী ও শিশু কল্যাণ উন্নয়ন মন্ত্রীর দাবি, প্রত্যক্ষভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি এই সূচক নির্ধারণের সময়; অর্থাৎ, ফোন করে বা অনলাইনে কিংবা, SMS-এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। যা বিশেষ নির্ভরযোগ্য নয় বলেই দাবি করছেন তিনি।
কিন্তু, তাই বলে ক্রমবর্দ্ধমান খাদ্যদ্রব্যের দাম এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন অন্ন সংস্থানের লড়াইটাকে অস্বীকার করা যায় কি? তার উপর রয়েছে আকাশ ছোঁয়াজ্বালানীর দাম- রান্নার গ্যাসের দাম হাজার টাকা ছুঁইছুঁই। পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতাও পরোক্ষভাবে বাড়িয়ে তুলছে খাদ্যদ্রব্যের দাম। এর মধ্যে আবার এসে জুটেছে কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি পাওয়াও। শুধুমাত্র জ্বালানি তেলেই ক্ষান্ত নয়, এই তালিকায় জ্বালানি তেলের দোসর হয়েছে ভোজ্য তেলও- সরষের তেল থেকে সাদা তেল সবাই দাম বাড়ার প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছে। সাধারণ মানুষ যদিও বা অন্নের সংস্থান করতে পারেন, সেই অন্ন রাঁধতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে তার।
এদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের ধরনও অপুষ্টির অন্যতম কারণ। আমাদের দেশের বেশ কিছু মানুষই নিরামিশাষী এবং তাঁরা যথাযথ প্রোটিন জাতীয় খাদ্য পান না। যার ফলে তাঁরা অপুষ্টির স্বীকার হন। এই সমস্ত মানুষ ডাল এবং সোয়াবিনের মাধ্যমে প্রোটিনের অভাব মেটাতে চান। কিন্তু অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে ডাল ও সোয়াবিন সেই তালিকা থেকে বাদ যাওয়ায় সেগুলোর দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
আরও পড়ুন: মোদীর Bad Bank ভাই-ভাই পুঁজিবাদের নতুন কৌশল
করোনা-কালে স্কুল বন্ধ থাকলেও সময়ে সময়ে মিড-ডে মিলের সামগ্রী পাওয়া গেলেও, দেশের বেশিরভাগ জায়গাতেই সেই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ডিম। কালেভদ্রে ডিম সেই তালিকায় থাকলেও, তা ভাগ হয়ে যাচ্ছে পরিবারের বাকি সদস্যদের মধ্যে। যার ফলে, একটি গোটা ডিমের পুষ্টি সকলে পাচ্ছে না।
প্রতি বছর বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে অর্থবরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে। সরকারের মাথারা দেশবাসীকে বিলিয়ন ডলার অর্থনীতির স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। স্বাধীনতার 75 বছরে দেশপ্রেমের ধারাস্রোতে দেশবাসীকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে সরকারের তরফে মস্ত আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু দেশের সম্ভাবনাময় মানবসম্পদ পুষ্টির অভাবে ধুঁকছে। কাজী নজরুল বহুকাল আগেই সখেদে লিখেছিলেন,
‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দু'টো ভাত, একটু নুন,
বেলা বয়ে যায়, খায়নি ক' বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।'
অপুষ্টির জ্বালায় ভোগা এই 101 নম্বরি দেশটাকে দেখে উপরিউক্ত লাইনগুলো ভারী অমোঘ মনে হয়!
সাধারণত নিলাম দু'ভাবে হয়ে থাকে। একটি হয় ব্রিটিশ বন্দোবস্তে, অপরটি হয় ডাচ ব্যবস্থায়।
এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথিবীর যেসব দেশে ক্ষুধা একটি ভয়াবহ সমস্যার আকার ধারণ করছে, ভারত তাদের অন্যতম
পরিযায়ী শ্রমিক মা ক্ষুধা-তৃষ্ণার সঙ্গে লড়াইটা মুলতুবি রেখেই তার একরত্তি সন্তানকে ছেড়ে চলে গেল।
যে দেশের শিশু অপুষ্ট রুগ্ন তার নেতাদের মুখে শক্তিশালী ভারতের কথা মানায় না।