×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • জাতের অঙ্কে মন্ত্রিত্ব বণ্টনে বাংলায় ফল মিলবে কি?

    বিতান ঘোষ | 15-07-2021

    বাংলার নতুন চার কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী।

    কাজে-অকাজে চাণক্যকে স্মরণ করা বিজেপি চাণক্যের একটি উপদেশকে বাংলায় অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চাইছে দেখা যাচ্ছে। চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে বলেছিলেন, ‘গরম খিচুড়ির চারধারটা খাওয়ার পর যেমন উত্তপ্ত মধ্যাঞ্চলে যেতে হয়, তেমনই শক্তিশালী প্রতিপক্ষের চারদিকে ভাঙন ধরানোই প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত।' বাংলার ইনক্লুসিভসত্তার মধ্যে তাই এক্সক্লুসিভআইডেন্টিটি বা পরিচিতিসত্তা খুঁজে তাদের আলাদা খাতিরযত্ন করে ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে লালন করাই বিজেপির আশু লক্ষ্যকেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পুনর্গঠনে এই রাজ্য থেকে বিজেপির মন্ত্রী নির্বাচনের মধ্যেই এই রাজনীতি স্পষ্ট। আগের দুই মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এবং দেবশ্রী চৌধুরী এই যাত্রায় বাদ পড়েছেন, এসেছেন নতুন চারজন প্রতিমন্ত্রী— যাঁদের প্রত্যেকেই প্রথমবার লোকসভায় নির্বাচিত। 

     

     

    রাজ্যে বিজেপির প্রায় দেড় ডজন সাংসদ থাকা সত্ত্বেও বেছে বেছে এই চারজনকেই বেছে নেওয়া হল কেন? নানা জল্পনাকল্পনার মধ্যে যে বিষয়ের দিকে পাল্লা ভারী, সেটা হল কাস্ট পলিটিক্স অর্থাৎ জাতপাতের রাজনীতি। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এবং বিধানসভা নির্বাচনে দলের শোচনীয় পরাজয়ের কথা স্মরণে রেখেই বিজেপি থিঙ্কট্যাঙ্ক জাতি এবং গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতিতে শান দিতে চাইছে

     

     

    উত্তরবঙ্গে রাজবংশী ভোট একটা বড় ফ্যাক্টর। গত লোকসভা নির্বাচনে প্রবল তৃণমূল ঝড়েও রাজবংশী ভোটের সিংহভাগ বিজেপির অনুকূলে গেছে। যার ফলে রাজবংশী অধ্যুষিত কোচবিহার, জলপাইগুড়িতে বিজেপি যথেষ্ট ভাল ফল করেছে। রাজবংশীদের এই সমর্থন ধরে রাখতেই বিজেপির বাজি কোচবিহার লোকসভার তরুণ সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক— যাঁর মা কোচ রাজবংশী, বাবা তফশিলি জাতিভুক্ত। অতএব নিশীথকে কেন্দ্রে মন্ত্রী করে দু'টো জনগোষ্ঠীর প্রতিই সদর্থক বার্তা দিতে চাইল বিজেপি। নিশীথকে দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র এবং ক্রীড়া ও যুবকল্যাণের দায়িত্ব। রাজ্যের উত্তরপ্রান্ত থেকে একজনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে তৃণমূল সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নেওয়া হল কিনা, সেটা স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে

     

    আরও পড়ুন: বিজেপির একাংশের রাজ্য ভাগের দাবিতে যুক্তি ও দূরদৃষ্টি নেই

     

    আলিপুরদুয়ারের অর্থনীতি মূলত চা-বাগান কেন্দ্রিক। সেখানে আদিবাসী চা শ্রমিকরাই ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করেন। তাই আলিপুরদুয়ারের আদিবাসী সন্তান, সেখানকার সাংসদ জন বার্লাকে সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়েছে বিজেপি। বার্লা নিজেও চা-শ্রমিক পরিবারের সন্তান। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে তিনি বাম যুব সংগঠন করতেন। তখন চা বাগানগুলিতে বাম শ্রমিক সংগঠনগুলির ভাল প্রভাব ছিল। পরে বার্লা আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় এবং এই অঞ্চলে বিমল গুরুং-এর গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সম্প্রসারণ রুখতে আদিবাসী বিকাশ পরিষদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। কিন্তু এই সংগঠনের অন্য নেতৃবৃন্দ 2016-র বিধানসভায় তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতা করায়, বার্লা আদিবাসী বিকাশ পরিষদ ছাড়েন এবং 2017 সালে বিজেপিতে যোগ দেন। আদিবাসীদের মধ্যে বার্লার প্রতি জনসমর্থন যে এখনও অটুট, তার প্রমাণ মিলেছে বিধানসভা ভোটেই। আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের 7টি আসনের মধ্যে 5টিতে জয়লাভ করেছে বিজেপিএই সমর্থন অটুট রাখতেই বার্লাকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হল

     

     

    উত্তর 24 পরগণা, নদীয়া, দুই দিনাজপুর, হাওড়া সহ প্রায় পাঁচটি জেলার বহু বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থীদের জয় পরাজয় নির্ভর করে মতুয়া ভোটের ওপর। মতুয়ারা হলেন দেশভাগের আগে পূর্ব বাংলা থেকে আসা পিছিয়ে পড়া হিন্দু নমঃশূদ্র সম্প্রদায়, এপার বঙ্গে যাদের প্রধান ধর্মকেন্দ্র  উত্তর 24 পরগণার ঠাকুরনগর। উত্তর 24 পরগণা ও নদীয়া জেলার প্রায় 32টি আসনের ফলাফল সরাসরি মতুয়া ভোটের ওপর নির্ভরশীল। তাই মতুয়াদের উপেক্ষা করতে পারে না কোনও রাজনৈতিক দলই। বাম শাসনের অবসানের পর মতুয়া ভোট একচেটিয়া ভাবে তৃণমূল পেয়ে এলেও গত লোকসভা ভোটে এই ভোটের সিংহভাগ বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছিল। মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন মতুয়াদের পবিত্র ধর্মস্থান ঠাকুরনগরের ঠাকুর পরিবারের সন্তান, শান্ত্বনু ঠাকুর। সেই শান্ত্বনু এবার জাহাজ মন্ত্রকের দায়িত্ব পেলেন। রাজনৈতিক কারবারিরা মনে করছেন, মতুয়াদের দীর্ঘদিনের দাবি শর্তহীন নাগরিকত্ব নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও, কার্যক্ষেত্রে তার রূপায়ণ ঘটেনি। এতে মতুয়াদের একটা অংশ ক্ষুব্ধ। এই ক্ষতে প্রলেপ দিতেই হয়তো মতুয়া সম্প্রদায়ের শান্ত্বনু ঠাকুরকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়া হল। পাশাপাশি জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের প্রতি সদর্থক বার্তা দিতে মন্ত্রী হলেন, দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সামাজিক শাখার সঙ্গে যুক্ত, বাঁকুড়ার সাংসদ সুভাষ সরকার

     

    অঙ্ক বড় জটিল, এত সহজে কী মিলবে?

    মতুয়া ভোট গত লোকসভায় বিজেপির সঙ্গে থাকলেও গত বিধানসভার ফলাফল ফলছে, সেই ভোটে বড় রকমের ভাগ বসিয়েছে তৃণমূল। নয়া নাগরিকত্ব আইন (CAA) নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শুকনো আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারছে না তারা। আবার অসমে NRC-তে বহু হিন্দুর নাম বাদ যাওয়ায় আশঙ্কায় ভুগছেন মতুয়ারা। তাদের একাংশ প্রশ্ন তুলছেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়ের কেউ যদি দেশের সাংসদ হতে পারে, তবে আমাদের কেন নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে ভিক্ষা চাইতে হবে। আমরা কি এদেশের নাগরিক নই?’ মতুয়াদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী ভাবনার এই চোরাস্রোতের প্রতিফলন ভোটের ফলেই স্পষ্ট। মতুয়া অধ্যুষিত 32টি বিধানসভা কেন্দ্রের 20টি গেছে তৃণমূলের অনুকূলে, আর 12টি গেছে বিজেপির অনুকূলে। কিন্তু শান্ত্বনু ঠাকুরকে মন্ত্রী করেই কি মতুয়া-ক্ষতে প্রলেপ দিতে পারবে বিজেপি? হিসাব অত সহজ নয়। ঠাকুরবাড়ির অন্তর্দ্বন্দ্ব, দুর্নীতিতে অনেক মতুয়া তিতিবিরক্ত। ক্ষমতার অন্যান্য বলয় তৈরি হচ্ছে, যাকে মদত জোগাচ্ছে তৃণমূল। তাছাড়া মতুয়া ব্যতীত অন্য নমঃশূদ্র সম্প্রদায়গুলি মতুয়াদের নিয়ে এই মাতামাতিতে বিরক্ত। তাই এই অংশের একটা বড় ভোটও এবার তৃণমূলের ঝুলিতে গেছে

     

    আরও পড়ুন: তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি

     

    তফশিলি জাতি (SC), উপজাতিদের (ST) মধ্যেও বিজেপির প্রতি সেই সমর্থন নেই, যা গত লোকসভায় ছিল। তফশিলিদের স্বাধীন ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ, কেন্দ্রীয় সরকারের জনজাতি বিরোধী আইন, তৃণমূল সরকারের তরফে জনজাতিদের মন জয়ের চেষ্টা— এই সবকিছুর সম্মিলনে তফশিলিদের একটা বড় অংশ এই বিধানসভায় বিজেপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। গত লোকসভা ভোটের ফলাফল বলছে তফশিলিদের জন্য সংরক্ষিত রাজ্যের 84টি বিধানসভা আসনের মধ্যে বিজেপি 46টি, তৃণমূল 37টি এবং কংগ্রেস 1টি আসনে এগিয়ে ছিল। সেখানে এই বিধানসভা নির্বাচনে এই 84টি আসনের মধ্যে তৃণমূলের ঝুলিতে গেছে 45টি আসন এবং বিজেপির ঝুলিতে গেছে 39টি আসন। এর মধ্যে তফশিলি উপজাতি (ST) অধ্যুষিত আসনগুলিতে বিজেপির ফলাফল আরও শোচনীয়। এরকম 16টি আসনের 9টিতে তৃণমূল এবার জয় পেয়েছে, গত লোকসভায় তারা মাত্র 3টি আসনে এগিয়ে ছিল

     

     

    একমাত্র রাজবংশী ভোটব্যাঙ্কই বিজেপির পক্ষে মোটের ওপর অবিকৃত থেকেছে এবারও। রাজবংশী সমাজে অনন্ত মহারাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনেও অনন্ত মহারাজের সমর্থন বিজেপির পক্ষে ছিল। কিন্তু, অধুনা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে তিনি শাসক তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন। সেক্ষেত্রে রাজবংশী ভোট কতটা ধরে রাখা যাবে, তাই নিয়ে চিন্তিত বিজেপির স্থানীয় নেতৃত্ব। আলিপুরদুয়ারের তফশিলি ভোটও বাকি অঞ্চলের থেকে পরিবেশ, সংস্কৃতিতে আলাদা হওয়ার দরুণ কোনও বিচ্ছিন্নতাবোধেই সম্ভবত, বিজেপির সঙ্গে থেকেছে। কিন্তু জঙ্গলমহলের তফশিলি ভোটের গতিপ্রকৃতি কিন্তু সেই কথা বলছে না। মতুয়ারাও আর এককাট্টা হয়ে কোনও একটা পক্ষে আনুগত্য দেখাচ্ছেন না। CAA কার্যকর করা হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, সেটা অবশ্য জানা যাবে না এখনই। উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত— এমন রাজনৈতিক প্রচারের আবহে সেই অঞ্চল থেকে দু' দু'জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়— এতে বিজেপি কতটা রাজনৈতিক ফসল তুলতে পারবে সেটাও অবশ্যই দেখার। কিন্তু জাতপাতের সমীকরণেই যদি মন্ত্রক বিতরণ হয়ে থাকে, তবে সেই সমীকরণ সহজে মেলার নয়। বিশেষত বাংলার মাটিতে।


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    সৃষ্টি আর লয় হাত ধরাধরি করে চলে বর্ষায়, তবু আমরা বর্ষার জলে ভিজতে চাই, ভাসতে চাই।

    উগ্র জাতীয়তাবাদের ভয়ঙ্কর স্বরূপ অনেক আগেই বুঝেছিলেন দুই সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ

    বেঙ্গল প্যাক্টে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শাসনক্ষমতা দেওয়ার কথা বললেন চিত্তরঞ্জন।

    শাসক গ্যাস চেম্বারে সময়কে মারতে পারেনি, আমরা তাকে সবসময় আগলে রেখেছি।

    নারী সুরক্ষায় বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত মোটেই মডেল নয়।

    পদক জিতলে দেশের গর্ব, না হলে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বাঁচতে হয় উত্তর-পূর্ব ভারতকে।

    জাতের অঙ্কে মন্ত্রিত্ব বণ্টনে বাংলায় ফল মিলবে কি?-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested