সভ্যতার ইতিহাসে শাসক যখনই হন্তারক হয়েছে, তখনই মানুষ কিছু যোগ বিয়োগের সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রায় দীর্ঘ তিন দশক নাৎসিদের অত্যাচারে প্রাণ হারিয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই ইহুদি। বর্ণবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদে দীর্ণ আরকের এই বিশ্বায়িত বিশ্বে গত 27 জানুয়ারি নামকুলহীন মৃত ইহুদিদের স্মরণ করা হল। স্মরণ করা হল 60 লক্ষ ইহুদিদের (Jews), যাঁরা নাৎসি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। 1956-য় জাতিসংঘের (United Nations) তরফে এই বিশেষ দিনটিকে আন্তর্জাতিক হলোকস্ট স্মরণ দিবস (Holocaust Memorial Day) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় হলোকস্ট সম্পর্কিত সংগ্ৰহশালা তৈরি করা হয় যার প্রধান কারণ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হলোকস্টের (Holocaust) বীভৎসতা তুলে ধরা। অধুনা দিকে দিকে কল্পিত জাতিগত বিশুদ্ধতার ধুয়ো তোলা শাসকের সংখ্যালঘুদের প্রতি মনোভাবের প্রেক্ষিতে সেদিনের হলোকস্ট আজও আপাত পপুলিস্ট শাসকের ভয়ঙ্কর স্বরূপকে তুলে ধরে। যুগ ও কাল ভেদে হিটলাররা গণতন্ত্রের পথ ধরেই তো তাদের দাঁতনখ বার করে থাকেন। প্রায় 70 বছর পর হলোকস্টের ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই বহন করে চলেছে।
নাৎসি জার্মানির ইহুদি-নিধন যজ্ঞের পর কেটে গিয়েছে সাতটি দশক। তবে হলোকস্টের প্রবণতা বিশ্বজুড়ে এখনও রয়ে গিয়েছে। ধর্মীয় উগ্ৰতা, জাতি বিদ্বেষ, ইহুদি বিদ্বেষ এখনও জার্মানিতে দেখা যায়, কারণ সিরিয়া থেকে আগত উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। বস্তুত, উদ্বাস্তু সমস্যা প্রায় সব দেশেই দেখা যায়। বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের নথিপত্র বলে যে 70 শতাংশের বেশি উদ্বাস্তু তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পারেনি। কারণ নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার মতো প্রয়োজনীয় প্রমাণ তাদের ছিল না। ফলত, তারা থেকে যায় ইউরোপের কোনও কোনও দেশে।
জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে নব্য নাৎসিবাদের যে চেহারা আমরা দেখতে পাই, ভারতে তা অন্য নামে পরিচিত। তবে ইহুদি নয় এই বাহিনীর শিকার প্রধানত ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) ও নাৎসি বাহিনীর মধ্যে শুধু প্রতীক স্বস্তিকাতেই নয়, বহু দিক থেকেই সাদৃশ্য রয়েছে। উগ্ৰ জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় উগ্ৰতা, জাতি বিদ্বেষের নিরিখে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নাৎসিদের ঐতিহ্য বহন করে। বিগত কয়েক বছর ধরে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বাস্তু, অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি বহু শব্দ সংঘ সচেতন ভাবে ব্যবহার করে এসেছে। ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি এতে আরও সঙ্কটাপন্ন হয়েছে। যেই সঙ্কটের ছাপ দেখা গেছে বাবরি ভাঙার উন্মত্ততায় কিংবা দিল্লি দাঙ্গার বীভৎসতায়।
আরও পড়ুন:সূর্য ওঠে গড়িয়াহাট ব্রিজের তলায়
ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতিতে সংঘের রাজনীতির প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী তা এখন বেশ ভাল করেই বোঝা যায়। সংঘের অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন আজকের। তাদের স্বপ্নের এই অখণ্ড ভারতে শুধু ‘হিন্দু’ পরিচয়ভিত্তিক মানুষ, মুসলিম দলিত কিংবা অন্য সংখ্যালঘু শ্রেণীর মানুষদের সেখানে হিন্দু ভিন্ন অন্য কোনও পরিচয় থাকবে না। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিসরে অ-হিন্দু কম বেশি সকল ধর্মের মানুষের প্রতি সংঘ এবং তার রাজনৈতিক আউটপুট বিজেপির এই বিদ্বেষী আচরণ আমাদের নজর এড়ায় না। তবে এই বিদ্বেষী মনোভাব কখনওই ভারতীয় ইহুদিদের উপর পড়েনি। ভারত বোধহয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র দেশ, যেখানে বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি ও সিনাগগদের ওপর কোনও আঘাত নেমে আসেনি। এই সহনশীলতা নিয়ে এখনও ভারতীয়দের অনেক গর্ব আছে। ভারত-ইজরায়েল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে এই দিকটি ভারতের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে। বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারত এবং ইজরায়েলের পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে বহু বদল এসেছে। এক্ষেত্রে সংঘের ইসলাম-বিদ্বেষের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। গান্ধী নিজে ইহুদি জাতীয়তাবাদের সমর্থনে কথা বললেও স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্রের পক্ষে তাঁকে কখনও কথা বলতে দেখা যায়নি। তবে আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী- যিনি নিজে ফ্যাসিবাদী অত্যাচারের শিকার- স্বতন্ত্র ইজরায়েলের পক্ষে সরব হয়েছিলেন। জহরলাল নেহরু নিজে আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার বিষয়ে স্পর্শকাতর ছিলেন। তাই ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে তাঁর ভিন্নমত না থাকলেও, তাঁর আশঙ্কা ছিল যে, ইজরায়েলকে আরব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হতে পারে। তাই 1950 সালে ভারত নবীন রাষ্ট্র ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও, সেই অর্থে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। প্রসঙ্গত, কংগ্রেস ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বিনির্মাণে নেহরুবাদী বিদেশনীতি অনুসরণ করে চলায়, দুই দেশের মধ্যে কোনওকালেই তেমন হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি। 1992 সালে অবশ্য কংগ্রেসেরই প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও-এর আমলে ভারত ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হয়, সেই সময়েই তেল আভিভে ভারত দূতাবাস খোলে।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিজেপি অবশ্য সচেতন ভাবেই নেহরুবাদী বিদেশনীতি থেকে অনেকটা পথ সরে এসেছে। সোভিয়েতের ভাঙন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ শক্তি হিসাবে চিনের ক্রমোত্থানও ভারতকে কিছুটা বাধ্য করেছে বৃহৎ শক্তি আমেরিকা ও তার সমর্থনপুষ্ট দেশগুলির দিকে ঝুঁকতে। মধ্য প্রাচ্যে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ইজরায়েলের কাছে ভারত সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তাছাড়া সংঘ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফায়দা পেতে এবং নিজেদের স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের প্রধান রসদ হিসাবে মুসলমান বিদ্বেষকেই পুঁজি করেছে। আর সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে আরব জাতীয়তাবাদ এবং শেষ দুই দশকে, আরাফত-পরবর্তী ইসলামিক মৌলবাদের সঙ্গে লড়া ইজরায়েলকে তাই বড় 'আপনার' মনে করছে বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার।
আজকের ভারত তার চরিত্র নির্মাণে গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্র ও নেহরুবাদী বিশ্ববীক্ষাকে খানিক প্রকাশ্যেই পরিত্যক্ত ঘোষনা করেছে। আজকের ভারতে শুধু ইহুদি নয়, অ-হিন্দু যে কোনও ধর্মের মানুষের জীবন সঙ্কটময়। 2017 তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইজরায়েল সফরে গিয়ে সেখানকার Yad Vashem হলোকস্ট সংগ্রহশালা সম্পর্কে বলেছিলেন "This is a mirror to the world'. ভারতে হলোকস্ট না হলেও জাতি, ভাষা বা ধর্মের ভিত্তিতে নানা আকারের গণহত্যার নজির রয়েছে। 2002 সালের গোধরা পরবর্তী কাণ্ডকেও গণহত্যার তুল্য বলেই তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী আমেরিকা যাওয়ার ভিসা পাননি।আজ তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভারতে গণহত্যা বা তুলনীয় কাণ্ডের কি কোনও সংগ্রহশালা গড়ে তুলবেন, যাকে বলা চলে আত্মসমীক্ষার দর্পণ?
হিজাব বা অন্য পোশাক নয়,মৌলবাদী শাসকদের আসল টার্গেট নারীর শিক্ষার অধিকার ও স্বাধীনতা।
হলোকস্ট স্মরণ করায় গণতন্ত্রী শাসকের সবচেয়ে ভয়াবহ স্বরূপের।
আধুনিক পেশাদার জীবনের দাবি মেনে ক্রমশ মেয়েদের পোষাকে পকেট চালু হচ্ছে, এমনকী শাড়িতেও
সংস্কৃতির নামে মানুষের জীবন নিয়ে ভয়ঙ্কর খেলা জালিকাট্টু চলছে, বিরোধিতা করে না কোনও রাজনৈতিক দলই
মানব সভ্যতায় সঙ্কট ও প্রয়োজনই সর্বদা আবিষ্কারের জন্ম দিয়েছে, কোভিড আবারও তা প্রমাণ করল।
খাদ্যের অতিরিক্ত সংরক্ষণ এবং তার ব্যবহারের কারণে মানুষের পাশাপাশি পৃথিবীও অসুস্থ।