×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অন্তত প্রাথমিক আলোচনাটা শুরু হোক

    4thPillar WeThePeople | 10-08-2021

    প্রতীকী ছবি।

    ব্ল্যাকবোর্ডে বহুদিন খড়ির দাগ পড়ে না, কচিকাঁচারা সমস্বরে বলে ওঠে না প্রেজেন্ট প্লিজ। করোনার কোপে খোয়া গেছে নাগরিক জীবনের অনেক কিছুই, খোয়া গেছে কতশত মানুষের প্রাণ। কিন্তু নিঃশব্দে খোয়া গেছে আরও একটা জিনিস। তা হল শিক্ষার অধিকার। কিন্তু আর পাঁচটা মহামারীর মতো এই মহামারীর প্রাবল্যও তো একদিন স্তিমিত হয়ে আসবে। কিন্তু পাঠশালা খুলবে কবে? কোন উপায়ে যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে পড়ুয়াদের শিক্ষার অঙ্গনে আনা যাবে? দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, গণমাধ্যমের আলোচনায় এই জরুরি বিষয়টি যথোচিতভাবে আসছে না। সরকারি স্তরেও যে এই নিয়ে খুব ভাবনাচিন্তা হচ্ছে, তেমন নয়শিক্ষকরাই বলছেন, মহামারীর মধ্যে কীভাবে মিড ডে মিলের সামগ্রী বিতরণ হবে তা নিয়ে পাতার পর পাতা সার্কুলার আসে শিক্ষা দফতর থেকে, কিন্তু লেখাপড়া কীভাবে হতে পারে, সেই বিষয়ে কোনও নির্দেশিকা নেই। এই পরিস্থিতিতে 4thpillarwethepeople.com তিনদিন ব্যাপী একটি আলোচনার আয়োজন করেছিল, যেখানে শিক্ষা নিয়ে নিবিড় ভাবে কাজ করা বিশিষ্টজনরা স্কুল খোলা এবং শিক্ষাদানের বিকল্প উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন

     

     

    মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, পুজোর পর স্কুল খোলার কথা ভাবা হবে সরকারি স্তরে ভাবনা ও তার বাস্তবায়নের মধ্যে যে অনেকখানি ফাঁক থাকে, তা আমরা অনেকেই চর্মচক্ষে দেখেছি। তাছাড়া পুজোর পরে কোভিডের প্রকোপ কমে যাবে এমন ধারণার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেইতাই পুজোর পর স্কুল খোলার কথা বলার পিছনে অনেক বিশেষজ্ঞই কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁদের অনেকেই পরিতাপের সুরে বলছেন, বিগত 17 মাসে কোন কোন বিকল্প উপায়ে পঠনপাঠন চালালে, প্রায় সব পড়ুয়াকে শিক্ষার অঙ্গনে আনা যেত, তা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা হয়নি। একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক পৃথা বিশ্বাস যেমন বলছিলেন, ‘বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি বেশ কিছু পন্থা অবলম্বন করলে সিংহভাগ পড়ুয়াকে লেখাপড়ার মূলস্রোতে ফেরানো সম্ভব। কিন্তু প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা কখনও এই বিকল্প উপায়গুলির কথা শিক্ষকদের থেকে জানতে চাননি।' রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কিছু শিক্ষক সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে খোলা মাঠে কিংবা বাড়ির উঠোনে ক্লাস করিয়েছেন। কিন্তু এগুলো নিয়ে কোনও সরকারি নির্দেশ না থাকায়, অল্প কয়েকদিনেই তাঁদের কাজে ইতি টানতে হয়েছে

     

     

    সমাজকর্মী কুমার রানা খানিক অসন্তোষের সঙ্গেই জানাচ্ছিলেন, ‘এই দেশে এবং রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষা চিরকালই অবহেলিত। তাই ভোটকেন্দ্র থেকে আধাসেনার থাকার জায়গা— প্রাথমিক স্কুলগুলোকেই বারবার ব্যবহার করা হয়ে থাকে।' অথচ উচ্চতর শিক্ষায় কাউকে উপযুক্ত করতে হলে বুনিয়াদি স্তরের শিক্ষায় অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? খাতায় কলমে অবশ্য পাঠশালা বন্ধ হয়নি নিয়ম মোতাবেক সেখানে প্রতিদিন অনলাইন ক্লাস চলছে। কিন্তু কতজন সেই ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছে? ডিজিটাল ডিভাইড নিয়ে চারদিকে এত আলোচনা চলছে। অথচ অনলাইন ক্লাসকেই বিকল্প মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করছে প্রশাসন। রাজ্যের সীমান্তবর্তী একটি গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষিকা মঞ্জীরা সাহা অনলাইন ক্লাসের এক নিদারুণ বাস্তবতার কথা বলছিলেন তাঁর কথায়, ‘এমনিতেই অনলাইন ক্লাসে আগের থেকে পড়ুয়া অনেক কমে যাচ্ছে। তার মধ্যে একদিন খেয়াল করলাম একটি ছেলে অনেকদিন ধরে অনুপস্থিত। তার অভিভাবককে ফোন করে তাকে ক্লাসে ফেরানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারপর সেই অভিভাবকই একদিন জানালেন, ছেলেটি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ করছে।' মঞ্জীরার গলায় আক্ষেপের সুর, ‘ইস! স্কুল খোলা থাকলে ছেলেটিকে সরাসরি বোঝানো যেত। আমি আশাবাদী ঠিকমতো বোঝালে ছেলেটি কখনও লেখাপড়া ছেড়ে দিত না।'

     

    আরও পড়ুন: সব‌ই খুলবে স্কুল ছাড়া?-2

     

    প্রশাসনিক স্তরে এই নিয়ে যে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, তা স্পষ্ট। কিন্তু শিক্ষকরাও কি দায় এড়াতে পারেন? অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তীর পর্যবেক্ষন, ‘মহামারী আসার আগেও প্রাথমিক শিক্ষায় একটা গলদ ছিল। উঁচু ক্লাসে উঠেও অনেক পড়ুয়ার সাধারণ জ্ঞান তৈরি হয়নি। এসব ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষকরা বলে থাকেন, পড়ুয়া পরিবারের প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত হলে, বাড়িতে তার লেখাপড়ার তত্ত্বাবধান করার কেউ থাকেন না। অনেক গরিবগুর্বো বাবা-মা'ও টাকা খরচ করে মাস্টার রাখেন।' অচিনবাবুর প্রশ্ন, ‘এই মাস্টারদের কি শিশুদের পড়ানোর মতো কোনও প্রশিক্ষণ রয়েছে?’ তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ‘করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকলেও প্রাইভেট টিউশনগুলো রমরমিয়ে চলেছে।'

     

     

    শিক্ষকদের অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই দ্রুত পঠনপাঠন চালুর পক্ষে। কিন্তু সরকারি নির্দেশ ও নিশ্চয়তা না পেলে তাঁরা এগোতে পারছেন না। তাই তাঁরা অভিন্ন একটা নীতি চাইছেন, যা অনুসরণ করে আবার পঠনপাঠন চালু করা যাবে। তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, রাজ্যের সর্বত্র কোভিড পরিস্থিতি সমান নয়। তাছাড়া প্রত্যেক জায়গাতেই কিছু স্থানীয় বিষয় মুখ্য ভূমিকা নেয় তাই তাঁরা কোনও অভিন্ন নীতি না নিয়ে অঞ্চলভেদে আলাদা আলাদা নীতি নেওয়ার পক্ষপাতী

     

     

    যে কোনও সামাজিক সমস্যারই একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকে এই প্রসঙ্গে সাংবাদিক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় একটা তাত্ত্বিক বিতর্ককে পুনরায় সামনে নিয়ে এসেছেন। তাঁর কথায়, ‘জনমোহিনী সরকার যখন বলে এত দিচ্ছি, তাও কেন চাইছ, তখন সাধারণ মানুষ ভাবে যে, সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পাচ্ছে। তেমনই শিক্ষার অধিকার যে একটা মৌলিক অধিকার, কোনও অবস্থাতেই যে এই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যায় না, তা অনেকেই জানেন না।'

     

     

    কিন্তু অন্ধকার সুড়ঙ্গপথের শেষে কি কোনও আলোকবিন্দু নেই? বিশেষজ্ঞরা বলছেন অবশ্যই আছে। আমরা তো সেই ঈশপের গল্প পড়েও জেনেছি, বুদ্ধি থাকলে উপায় হয়। কিন্তু উপায়টা কী? সমাজবিজ্ঞানী উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলছিলেন, ‘চিকিৎসকরা বলেছেন বদ্ধ ঘরে যেন অনেকে না থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের সব স্কুলেই মাঠ আছে, ফলে সেখানে বহু আগে থেকেই পঠনপাঠন শুরু করা যেত।' তাঁর কথায়, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো অনেক আগেই এই পথ দেখিয়ে গেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা সেই পথ অনুসরণ করিনি।' শিক্ষকদের একাংশ উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছেন, বহু পড়ুয়ার সঙ্গেই লেখাপড়ার সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। অনেকের বাড়িতে পাঠ্যপুস্তকই নেই। শিক্ষাঙ্গন থেকে কতজন পড়ুয়া বেরিয়ে গেছে, তা বোঝা সম্ভব হবে স্কুল পুনরায় চালু হলে। কুমার রানার গলায় অবশ্য একটা প্রত্যয়ের সুরও রয়েছে। তাঁর মতে, ‘এই স্কুলছুট, বইছুট পড়ুয়াদের পুনরায় শিক্ষার মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে তার জন্য সরকারি স্তরে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন।' তাঁর সংযোজন, ‘মহামারীর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের আরও এগিয়ে যাওয়া উচিত।' প্রায় অনুরূপ আশার কথা শোনা যায় অচিন চক্রবর্তীর গলাতেও। ছাইয়ের গাদা থেকে এখনও যে ফিনিক্স ওড়ানো সম্ভব, এই বিষয়ে মোটামুটি একমত সকলেই

     

     

    প্রতীচি ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত উর্বা চৌধুরী যেমন জোর দিচ্ছেন ক্লাস ঘরের বাইরের শিক্ষার ওপর। তাঁর কথায়, ‘গ্রামাঞ্চলে যেমন প্রচুর ফাঁকা মাঠ আছে, তেমনই শহরের দিকে প্রচুর পার্ক, কমিউনিটি হল রয়েছে। স্কুল খোলার অব্যবহিত পরেই যদি আবার স্কুল বন্ধ করার পরিস্থিতি আসে, তবে যেন এইসব বিকল্প জায়গাগুলোয় ক্লাস নেওয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি আমরা সকলে নিয়ে রাখতে পারি।' অচিন চক্রবর্তীও জানাচ্ছিলেন, ‘বিশ্বের অধিকাংশ দেশে স্কুল খুলে গেছে। বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট নিয়মেই সেখান থেকে শিশুদের সংক্রামিত হওয়ার খবর খুব বেশি আসেনি। তাই আমাদের ভয় ভেঙে এবার এগিয়ে আসতেই হবে।'

     

    আরও পড়ুন: স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত এলাকার পরিস্থিতি অনুসারে স্থানীয় স্তরে নিলে ক্ষতি কী? রাজ্য জুড়ে এক সরকারি বিধান কেন হবে?

     

    কোভিডের চোখরাঙানি এখনও চলছে। এমন নয় যে আগামীকালই হইহই করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু একদিন না একদিন তো স্কুলগুলোকে খুলতে হবেই। উদয়ন পণ্ডিতরা পঠনপাঠন চালু করতে না পারলে তো আজকের কচিকাঁচারাও একদিন বলে উঠবে, ‘লেখাপড়া করে যে, অনাহারে মরে সে।' সব জেনেবুঝে একটা প্রজন্মকে তো শিক্ষার আলো থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায় না। তাই স্কুল, ক্লাসরুমের বাইরেও শিক্ষাদানের বিকল্প উপায়গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা নিয়ে নিবিড় ভাবে কাজ করা বিশিষ্টদের মত যেমন নিতে হবে, তেমনই বয়স ও অভিজ্ঞতায় ছোট হওয়া সত্ত্বেও কচিকাঁচাদের মতামত নিতে হবে। কারণ এর সঙ্গে ওদের স্বার্থের প্রশ্ন, ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িত। তবে সর্বাগ্রে, এটা যে একটা গুরুতর সমস্যা তা সরকার, প্রশাসনকে মানতে হবে। কোন উপায়ে আর কী পদ্ধতিতে আবার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার অঙ্গনে ফেরানো যায়, তা নিয়ে সর্বস্তরে আলোচনা করতে হবে। আলোচনা রাতারাতি কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে না, তবে ভাবীকালের কাছে এটা অন্তত বলা যাবে যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এত বড় সংকটে হিরণ্ময় নীরবতা নিয়ে বসে থাকেনি। আর উদ্যোগ শুভ আর প্রয়াস সৎ হলে ফল মিলবেই। ক্লাসঘরে না হোক, অন্য কোথাও, অন্য কোনও ভাবে আবার শোনা যাবে অ-এ অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে।'


    4thPillar WeThePeople - এর অন্যান্য লেখা


    বাঙালি সারাদিন টিভির সামনে কোপা আর ইউরোর ফুটবলে মত্ত। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলে বাঙালি ফুটবলার কোথায়?

    ভারতে সর্ববৃহৎ খোলামুখ কয়লাখনি দেউচা পাচামিকে কেন্দ্র করে বাংলা উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছে।

    টিকাকরণের উপর মানুষের আস্থার প্রশ্ন জড়িত দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের ওপর।

    ভারতীয় গণতন্ত্র মোদী জমানায় ক্রমশ পিছাতে পিছাতে এখন ডাহা ফেল। রাজার কাপড় নেই - বলার মিডিয়াও নেই!

    সুষ্ঠু এবং অবাধ ভোট করানো হবে কথা দিয়েও বারবার কেন তা রাখা যাচ্ছে না?

    বিপুল সাড়া রাজ্য সরকারের দুয়ারে সরকার প্রোগ্রামে। অর্থনীতির দিক থেকে কি স্থায়ীভাবে চালানো সম্ভব?

    প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অন্তত প্রাথমিক আলোচনাটা শুরু হোক-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested