আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ তাঁর সাম্প্রতিক দু'টি টুইটে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবক্ষয়ে বিচারবিভাগের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, আগামীদিনে ঐতিহাসিকরা যখন বিগত 6 বছরে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন নিয়ে চর্চা করবেন, তখন তাঁদের আলোচনায় বিশেষভাবে উঠে আসবে সুপ্রিম কোর্ট এবং তাঁর শেষ চার বিচারপতির ভূমিকার প্রসঙ্গ। এই বক্তব্যে শীর্ষ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগ এনে বিচার করে, এবং বিচারে প্রশান্ত ভূষণকে দোষী সাব্যস্ত করে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, তবে কি ব্যক্তির মতপ্রকাশের কোনও স্বাধীনতা থাকবে না? কেউ বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করলেই কি তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে? দু'টি টুইটে ভারতের গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে গেল? এই প্রশ্নগুলো নিয়ে www.4thpillars.com -এর আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং অরুণাভ ঘোষ। আলোচনায় এঁদের দু'জনের বক্তব্যে যে বিষয়গুলি উঠে এল:
1) ক্রিমিনাল কনটেম্পট বা অপরাধমূলক আদালত অবমাননার আক্ষরিক সংজ্ঞা দিয়েও প্রশান্ত ভূষণের বক্তব্যকে আদালত অবমাননা হিসেবে গ্রহণ করা যায়না। বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করলে অথবা বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে কুৎসা করলে সুপ্রিম কোর্ট কাউকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করতে পারে। কিন্তু প্রশান্ত ভূষণ তো তেমন কিছু করেননি। বরং তিনি যা বলেছেন, তা বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাকে পুনঃস্থাপিত করার কাজে সহায়ক হতে পারে।
2) সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবদে ব্যক্তি মানুষ হিসাবে পছন্দের হার্লে ডেভিডসন মোটর বাইকে সওয়ার হয়েছিলেন। প্রশান্ত ভূষণ সেই বিষয়টা নিয়ে টুইট করেন। ব্যক্তি বোবদের অবমাননা সুপ্রিম কোর্টের অবমাননা হতে পারে না।
3) কলকাতা হাইকোর্টে যখন অরুণ মিশ্র প্রধান বিচারপতির আসনে, তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "এখন টাকা দিয়ে বিচার কেনা যায়।' এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা হয়। তখন হাইকোর্টে এই বিচারপতি অরুণ কুমার মিশ্রই সহনশীলতার কথা বলে সেই মামলায় আদালত অবমাননার আর্জি খারিজ করে দিয়েছিলেন।
4) তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধে 4 জন বিচারপতি সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন। সেই সময় কি তাহলে আদালত অবমাননা হয়নি? বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর বিরুদ্ধে যখন সুপ্রিম কোর্টের মহিলা কর্মীকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠল, তখন বিচারপতিরাই একতরফাভাবে প্রধান বিচারপতিকে ক্লিন চিট দিলেন। রঞ্জনবাবুর অবসরের পর সেই মহিলা, যাঁর চাকরি চলে গিয়েছিল, তিনিই আবার সুপ্রিম কোর্টে কাজে বহাল হয়েছেন।
5) জনৈক ব্যক্তির দু'টো টুইট আর কিছু বক্তব্যে যদি কোনও প্রতিষ্ঠান ভেঙে যায়, তাহলে এত ঠুনকো প্রতিষ্ঠানের থাকার প্রয়োজন কী?
6) সুপ্রিম কোর্টের 10 জন প্রাক্তন বিচারপতি প্রশান্ত ভূষণ ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। সুতরাং এমন নয় যে বিচারব্যবস্থার মধ্যে অন্য স্বর নেই। তবে সুপ্রিম কোর্টের উপরে যেহেতু অন্য আদালত নেই তাই তাদের কথাই শেষ কথা।
7) যে ক্রিমিনাল কনটেম্পটে প্রশান্ত ভূষণ দোষী সাব্যস্ত হলেন, সেই ক্রিমিনাল কনটেম্পটের 28 বছরের পুরনো মামলা ঝুলে আছে সুপ্রিম কোর্টে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিষয়ে সেই মামলার কী হবে? লালকৃষ্ণ আদবানি এবং অন্যান্য গণ্যমান্য অভিযুক্তরা জীবিত থাকাকালীন সেই মামলার কোনও মীমাংসা হবে কি?
8) রাম জন্মভূমি মামলায় সুপ্রিম কোর্টে রায় দিয়েছে মামুষের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। এভাবে কখনও কোনও রায় দেওয়া যায় না। এই রায়ে কোনও বিচারপতির স্বাক্ষর নেই। রায়টা কে লিখেছেন জানার কোনও উপায় নেই। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে ভেঙে ফেলার ঘটনার আইনি নিষ্পত্তি না হওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের।
9) সুপ্রিম কোর্টের উপর আর কোনও নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠান নেই, তাই আমাদের কোর্টের যাবতীয় সিদ্ধান্ত মানতে হবে। কিন্তু মানুষ মন থেকে মানছে না এই সিদ্ধান্ত। সুপ্রিম কোর্ট ভাবছে মানুষ মেনে নিচ্ছে এগুলো, কিন্তু আসলে মানছে না। সুপ্রিম কোর্টের বরং উচিত বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করা।
10) বিচারব্যবস্থার বিচ্যুতি হলে আইনসভার তাকে সামলানোর কথা। এটাই গণতন্ত্রের চেক অ্যান্ড ব্যালান্স। কিন্তু ভোটাররা যাঁদের নির্বাচিত করছেন, তাঁরা কি সাংবিধানিক কাঠামো রক্ষায় আদৌ দায়িত্বশীল, বা তাঁদের সেই যোগ্যতা আছে? আমাদের আইনসভা গুণগত দিক থেকে অনেক দুর্বল। নারদা কাণ্ডে সিবিআই স্পিকারের অনুমতি চেয়েও পায়নি, যার ফলে অভিযুক্তদের জেরা করতে পাচ্ছে না। এটা দুর্ভাগ্যের।
11) ইন্দিরা গান্ধী অনুগত বিচারব্যবস্থা চেয়েছিলেন, এটা সত্যি। তার প্রতিবাদ করে জেলও খেটেছেন অরুণাভ ঘোষ। তবে ইন্দিরা গান্ধীর সময়েও পরিস্থিতি আজকের মতো এমন ভয়াবহ ছিল না।
12) সুপ্রিম কোর্ট পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে প্রথমে নেতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল। পরে জনরোষের চাপে কোর্ট কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। ততদিনে পরিযায়ীদের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ে। শাসক শক্তিশালী হলে, বিচারপতিরাও তাদের অনুগত হয়ে যায়। অতীতেও আমরা এমন দৃষ্টান্ত দেখেছি। বর্তমানে দক্ষিণপন্থী শাসনের বাড়বাড়ন্তে শাসকের কণ্ঠস্বর অনেকসময় বিচারপতিদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে— যা একেবারেই অভিপ্রেত নয়।
13) নারদা মামলায় প্রধান বিচারপতি শুনানির আগের রাতে খোদ অভিযুক্তের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পরের দিন অবসর নিয়ে মানবাধিকার কমিশনের বিচারপতি হয়ে গেছেন। দেশের বিচারব্যবস্থায় এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে?
14) কিছু হাইকোর্ট এই পরিস্থিতিতেও খুব ভাল অবস্থান নিচ্ছে। তাই বিচারব্যবস্থা নিয়ে এখনই এত হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আইনি মূল্যবোধগুলির উপর ভরসা করে রায় দিলে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরতে পারে। স্মরণে রাখতে হবে, অসহায় মানুষই বিচারব্যবস্থার দ্বারে ছুটে যান। যাঁরা আইন কিনতে পারেন, তাঁদের কথা না ভেবে বিচারবিভাগ বরং এই অসহায়দের কথা ভাবুক।
15) 370 ধারা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এখনও চুপ। সিএএ নিয়েও তাই। কত বেশি সময় লাগে এগুলোর শুনানি হতে? প্রশান্ত ভূষণকে নিয়ে এই ব্যস্ততা আর স্পর্শকাতরতা কেন? দেশের অনেক মানুষ কিন্তু এই ব্যাপারে প্রশান্ত ভূষণের পাশে রয়েছে।
16) বর্তমানে হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টে জরুরি কোনও মামলার শুনানি হচ্ছে না। অনেকক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কোর্টের রায় প্রতিষ্ঠান মানছে না। এটা খুব খারাপ লক্ষণ।
17) আগে বিচারপতিদের নিজের আয়ত্তের বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। এখন তো দেখা যায়, ইন্ড্রাস্টি ল' নিয়ে যিনি কোনও কাজ করেননি, তিনি সেই সংক্রান্ত মামলার রায় দিয়ে দিচ্ছেন। আসলে এখন সর্বত্র পড়াশোনার মান পড়ে গেছে। তাও নরিম্যানের মতো বিচারপতিরা এখনও আছেন, কিছু তুখোড় তরুণ আইনজীবী আছেন। কিন্তু 45-এর আগে তো কেউ বিচারপতি হন না।
18) আদালত অবমাননায় দায়ে অভিযুক্ত হলে প্রশান্ত ভূষণের সর্বাধিক 6 মাস জেল আর 2000 টাকা জরিমানা হতে পারে। যদি প্রশান্ত ভূষণ এই শাস্তি মাথা পেতে নেন, তাহলে কিন্তু তিনি দেশে নায়কের মর্যাদা পেয়ে যাবেন। অনেকে এই ব্যাপারে বলেছেন ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান বড়। তাঁদের বোঝা উচিত, ব্যক্তি আছে বলেই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে।
সামাজিক বার্তা দেওয়া আদালত বা সরকারের কাজ নয়।
রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে মানুষকে পাইয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতাই কি জনগণের মঙ্গল কল্যাণের পথ?
বিচারও কি দলীয় রাজনীতির অঙ্গ?
প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি রক্ষা করতে বলি হচ্ছে না তো জাতীয় স্বার্থ?
মানুষের পাশে দাঁড়ানোই মিডিয়ার কাজ।
দেশের কাণ্ডারীর কথায় পাওয়া গেল আশার আলো।