বাঙালি এখন শোকগ্রস্ত। উপর্যুপরি প্রিয় নায়ক এবং ফুটবলের রাজপুত্রকে হারিয়ে বুক ভেঙে গেছে তার।
এ প্রসঙ্গে নিজের মনের কথা বলাও এড়াই কী করে! সেই সুদূর কৈশোরে যখন স্কুলের বন্ধু স্বাতী প্রথম ‘হয়তো তোমারই জন্য’ গানটা লিখে নিয়ে এল, মনে আছে স্কুলের টিফিন-বাক্সর খাবারের সঙ্গে গোগ্রাসে গেলা সেই কথাগুলো, ‘জানি তুমি অনন্য, আশার হাত বাড়াই...।‘ ক্রমশ একটা স্বপ্ন চারিয়ে গিয়েছিল মনে, সত্যি না হোক, মিথ্যে করেও যদি কেউ কখনও বলে...যদি...। পরে দূরদর্শনে ছবিতে গানটা দেখার পর নিতান্ত সাধারণ হওয়া সত্ত্বেও তনুজার জায়গায় বেশ নিজেকে ভেবে নিয়েছিলাম, আর ভেবে নিয়েছিলাম বলেই তো...
যাক সে কথা। তারও অনেক পরে, 1986 সাল, মেক্সিকো বিশ্বকাপ। তখন সবে কোনও একটি অর্থকরী সংস্থায় চাকরিতে প্রবেশ করেছি, রাত জেগে সব খেলা দেখা হচ্ছে না। অথচ সেবারই প্রথম সরাসরি দেখা যাচ্ছে সব ম্যাচ, সে এক অভূতপূর্ব শিহরণ! কিন্তু ব্রাজিল প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে গেছে জিকো পেনাল্টি মিস করায়। বাঙালি শোকস্তব্ধ। তৃতীয় বিশ্বকে স্বপ্ন দেখাবে কে! কিন্তু দেখালেন, তিনি দেখালেন। আকাশি- রূপোলি ডোরাকাটা জামা পরা এক অদম্য যুবক, দরিদ্র বিশ্বটাকে বুকে করে নিয়ে ধনী ইউরোপীয় দেশগুলোর দুর্ভেদ্য রক্ষণ ভেদ করে তাদের পেনাল্টি বক্সে পৌঁছে গেলেন! আমাদের দু’শো বছরের শাসকেরা ফকল্যান্ড যুদ্ধজয়ের গরিমায় আঘাত পেয়ে প্রভূত প্রচার করল তাঁর ‘হাতের গোল’ নিয়ে, কিন্তু সেই ম্যাচেই তো নিজেদের হাফলাইন থেকে একের পর এক ইংরেজ ফুটবলারকে কাটিয়ে শতাব্দীর সেরা গোলটিও তিনিই করলেন! আর্জেন্টিনা...আর্জেন্টিনা... সেই থেকে বাংলার ফুটবল শিবির দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। পেলে এবং মারাদোনা! সেই তর্কে ফুটবল থেকে সরে গিয়ে প্রায়শই পেলে ভক্তদের যুক্তি হত, কালো মুক্তো অনেক সংযত জীবনযাপন করেন, মারাদোনার মতো তাঁর মাদক ও অন্যান্য নেশার দ্রব্যের প্রতি আসক্তি নেই। হতভাগ্যদের কে মনে করাবে মাইকেলকে নিয়ে বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত বক্তব্য, ‘ওরকম একটা ‘মেঘনাদবধ’ লিখতে পারলে...।’
একইভাবে, চুরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে গ্রিসের সঙ্গে ম্যাচে শুধু একটা বল গলবার জায়গা ছিল কি ছিল না, পায়ের চেটো দিয়ে তাঁর সেই অবিস্মরণীয় গোল, এফিড্রিনের বাপেরও সাধ্যি ছিল না অমন একটি নিখাদ শিল্প সৃষ্টি করে...
টেকনিক্যাল আলোচনা ছেড়ে এই ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়া থেকেই মনে পড়ে গেল বাঙালির নিন্দাপ্রিয় হওয়ার কথা। মনে পড়ল সাম্প্রতিক অতীতেও বাঙালি উৎকণ্ঠা এবং শোক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে হাঁড়ির খবরও রেখেছে। হাঁড়ি মানে যে রুটি নয় ভাত, সে কথা বাঙালি মাত্রেই জানে, কাজেই এই ঔৎসুক্য পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা সম্পর্কে নয়, বরং কত ধানে কত চাল, সে কথাই বাঙালি বুঝে নিতে চেয়েছে। অর্থাৎ কিনা গড়পড়তা বাঙালি পরিবারের মতোই কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির পরিবারেও রোজগেরে মানুষ যে একজনই এবং তিনি হঠাৎ অবর্তমান হয়ে যাওয়ার পরে সংসারটা যে একেবারে অকূল পাথারে গিয়ে পড়তে পারে, এ কথা ভেবে নিতে পারলে বাঙালির খুব সুখ। এমন একটা ভাব, যেন যত বিখ্যাতই হও বাবা, যতই ফিল্মের পর্দায়, কাগজে কলমে, মাইক্রোফোনে পারফরম্যান্স দিয়ে চমকে দাও, হুঁ হুঁ শেষ পর্যন্ত পেটের জন্যেই তো সব।
অতএব মন, মগজ ইত্যাদি বাদ দিয়ে উদর পর্যন্ত যদি পৌঁছেই যাওয়া যায়, তাহলে আর নিম্নবর্তী অঞ্চলটি বাদ থাকে কেন! আর সকলেই তো জানে, এসব মামলায় ওঁরা অর্থাৎ সেলেব্রিটিরা একেবারে যাচ্ছেতাই! অর্থাৎ মোদ্দা কথায় সাধারণ বাঙালি এ বাবদে অনেক ‘চরিত্রবান’, যদিও তারা সুযোগ পেলেই পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে কিম্বা চায়ের দোকানে বসে মেয়েদের ‘মাপেন’, কিম্বা পাড়ার সুন্দরী বউদির কোল থেকে তাঁর বাচ্চাটাকে নেওয়ার জন্য সহসাই উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। তা ছাড়াও রাজনীতি, খেলা, ছায়াছবি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকেই সম্মিলিত ভাবে পরিচিত নারীদের শরীরের টুকরো টুকরো অঙ্গ নিয়ে আলোচনা করে প্রভূত হর্ষ অনুভব করেন। এসব কিছুকে একেবারেই দোষের বলা যায় না, কারণ এ’টুকু নইলে আর...
আসলে বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে কুচ্ছো করবার প্রবণতা তো বাঙালির আজকের নয়। বাঙালির নকশা জাতীয় বস্তুটিতে (অনেকের মতে এতে ইংরেজি সাহিত্যের sketch-এর প্রভাব রয়েছে, যদিও সে সব রচনার উৎকর্ষ অন্যতর) সামাজিক অনাচার এবং হুজুগ ও গুজবকে ছাপিয়ে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত কুৎসাই প্রাধান্য পেত, যার অধিকাংশটা জুড়েই থাকত যৌন ব্যভিচার, ভাষাও হত অত্যন্ত অশ্লীল। সে সময়ের নামকরা দু’টি সংবাদপত্র ‘সম্বাদ ভাস্কর’ (সম্পাদক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য) এবং ‘সংবাদ প্রভাকর’ (সম্পাদক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত) সমান্তরাল ভাবে দু’টি খেউড় পত্রিকা চালাত, যাদের নাম যথাক্রমে ‘রসরাজ’ ও ‘পাষণ্ডপীড়ন’। সে সব পত্রিকার বিষয়বস্তু এবং ভাষাই যে শুধু রুচির পক্ষে পীড়াদায়ক ছিল তা নয়, শিবনাথ শাস্ত্রী লিখছেন, “রসরাজ’, ‘যেমন কর্ম্ম তেমনি ফল’ প্রভৃতি অশ্লীলভাষী কাগজগুলি ছাড়িয়া দিলেও ‘প্রভাকর’ ও ‘ভাস্করের’ ন্যায় ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজের জন্য লিখিত পত্রসকলেও এমন সকল ব্রীড়াজনক বিষয় বাহির হইত যাহা ভদ্রলোকে ভদ্রলোকের নিকট পাঠ করিতে পারিত না।” স্ত্রী শিক্ষা নিয়ে ঈশ্বর গুপ্ত যে ছড়া কেটেছিলেন তা তো অনেকেরই জানা, “যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে/ এ বি শিখে, বিবি সেজে বিলাতী বোল কবেই কবে।” ইত্যাদি।
এ ছড়া শুনে আজকের প্রজন্ম হেসেই খুন হবে। রক্ষণশীলতার এমনই মজা! এই সামাজিক পশ্চাদগামিতা ছাড়াও কাগজ চালাতে গেলে পাবলিকের খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী গল্প লিখতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা সেকালেও ছিল, কিন্তু সেটা যে নিতান্তই অশিক্ষিত গ্ৰাম্য রুচি বিকারকে প্রশ্রয় দেওয়া, তাতে তো সন্দেহের অবকাশ নেই। এই বিকৃতির মোক্ষম জবাব দিয়েছিলেন হুতোম, অর্থাৎ কালীপ্রসন্ন সিংহ, তাঁর অননুকরণীয় ঢংয়ে, অশ্লীলতাকে যথাসম্ভব পরিহার করে। কিন্তু একালে?
একালেও সেকালের মতোই কুৎসাকাহিনী শুধু খবরের কাগজেই সীমাবদ্ধ নেই, বই ছেপেও বিখ্যাত ব্যক্তিদের যৌনজীবন নিয়ে রগরগে লেখা চলছে। নাহলে কালীপ্রসন্ন সিংহর শরীর ‘সোনাগাজী’-তে গিয়ে কোনও এক কমলমণির কোলেও নেতিয়ে রইল কেন, রামমোহন রায় তরুণ বয়সে তাঁর দুই স্ত্রীর সঙ্গে এক ঘরে রাত্রিবাস করলেন কী ভাবে, রবীন্দ্রনাথের ‘প্রথমা প্রেমিকার’ অন্তর্বাস কোথায় ঝোলানো ছিল, এমনতর অসংখ্য মুদ্রিত গালগল্পের অর্থ কী ।
যদি ঘটনাগুলো কাল্পনিক নাও হয়, যদি কেউ তাঁর আত্মজীবনীতে নিজস্ব দ্বিধা দ্বন্দ্বের কথা লিখেও থাকেন, তাহলেও তাঁর সারা জীবনের উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে তাঁর ব্যক্তিগত যৌনজীবন? পাবলিককে ব্যবসার নামে আর কত পচা মাল খাওয়ানো হবে ভাই! এর ফলে তো দু’টো জিনিস হচ্ছে, দু’টোই সমান আশঙ্কাজনক। এক, আদর্শ মানুষের ‘চরিত্রদোষ’ খুঁজে নিয়ে পামরজন নিজেদের নারীলোভী জীবনদর্শনকে বৈধতা দিচ্ছে এবং দুই, বিরুদ্ধমতের রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল এতাবৎকালের জাতীয় বরেণ্য নেতাদের আত্মিক হননের সুবিধে পেয়ে যাচ্ছে, ফলে বৈধতা অর্জন করছে তাদের ঘৃণার রাজনীতি।
ভুললে চলবে না এই একই কারণে সেকালেও সতীদাহ প্রথা রদ করার সময় রামমোহন এবং বিধবা বিবাহ প্রচলনের সময় বিদ্যাসাগর সম্পর্কেও কুৎসিত কথা বলা হত।দেবতুল্য চরিত্র বলে কিছু হয় না। দেবতারা নারীসম্ভোগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট লালসাপূর্ণ ছিলেন, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নারীরাও আর কতদিন নিজেদের ভোগযোগ্যতা নিয়ে খুশি থাকবে! বিখ্যাত মানুষদের মনোযোগ আকর্ষণ করেই শুধু সুখী হবে, নিজেদের কোনও কীর্তি রেখে যাবে না?
এ লেখা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু বাদ সাধল বাড়ির পঞ্চদশী কন্যাটি। একাল অনুযায়ী সে ‘One Direction’ নামের একটি ইংরেজি গানের দলের ভক্ত। বলল, ‘জানো, ওদের এক মহিলা interviewer প্রশ্ন করেছিল, ‘Who is the best at the game among you?‘ ওরা তো ফুটবল না অন্য কোনও খেলা এই নিয়ে ভাবছে। ওদের তখন বলা হল এটা আসলে মেয়েদের নিয়ে খেলার কথা বলা হচ্ছে। ওরা কী বলল জানো? বলল, ‘This is objectifying women. We never do it.’
আমরা কবে ওই বাচ্চা ছেলেগুলোর মতো করে ভাবতে পারব?
প্রেম তা সে যে রূপেই হোক, কেবলমাত্র বাঁচাতে পারে এই দেশকে। ঋষি তাঁর অন্তিম ট্যুইটে এমন কথাই লিখেছিলে
পেশোয়ারী খানদান আর অভিনয় দক্ষতার বৈচিত্রে তিনিই যেন মিনি ভারতবর্ষ।
অমৃতসরের এম এ ও (মহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল) কলেজের এক লাজুক মুখচোরা অধ্যাপক ছিলেন আপনি ফয়েজ।
আমাদের ছোটবেলায় জন্মদিনে বই দেওয়ার প্রথা ছিল
আজও বাস্তব গালিবের সাধের দিল্লীর বিশেষ বিশেষ মহল্লার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনা।
একালের এক বিচারপতির সভায় পূর্বকালের কবিরা মিলে গেলেন, এ আজও বড় সৌভাগ্যের।