×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • একটি দাঙ্গা, চারটি রিপোর্ট, অজস্র প্রশ্ন

    সোমনাথ গুহ | 27-06-2020

    চার মাসে আগে দেশের খাস রাজধানীতে ভয়াবহ দাঙ্গা নিয়ে চর্চা প্রায় পুরোপুরিই চাপা পড়ে গিয়েছে করোনা ভাইরাসের আগ্রাসনে। কিন্তু মিডিয়ায় চর্চা না হলেও দিল্লি পুলিশ তাদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে: গ্রেফতার, তদন্ত, আইনি প্রক্রিয়া সবই চলছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনও তাদের মতো করে ঘটনার সুলুক সন্ধান করে রিপোর্ট দিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে পরিচিত প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংগঠন ছাড়াও নবীন কিছু সংগঠনও আছে, যাদের রিপোর্টে কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশের বক্তব্যই মান্যতা পাচ্ছে। ‘কল ফর জাস্টিস’ নামে একটি সংস্থার এই ধরনের রিপোর্ট খতিয়ে দেখা যাচ্ছে সঙ্ঘ পরিবারপন্থী কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংস্থাগুলি সোশাল মিডিয়ায় যে ভুয়ো ভিডিও প্রচার করে থাকে, সেগুলোকেই তারা প্রামাণ্য নথি বলে গণ্য করেছে। বোঝাই যাচ্ছে, মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য যাচাইয়ের রীতিনীতির কোনও তোয়াক্কা না করে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্যই এ কাজ করা হয়েছে। আমরা দিল্লির দাঙ্গা বিষয়ে সাম্প্রতিক চারটি রিপোর্ট খতিয়ে দেখছি এই নিবন্ধে। তার মধ্যে দুটির বক্তব্য এবং প্রতিপাদ্য এবং অন্য দুটির বক্তব্য এবং প্রতিপাদ্যর সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রশ্ন জাগে, মানবাধিকারের নামে কি যে যা খুশি করতে পারে?

     

    প্রেক্ষাপট

    গত 23 ফেব্রুয়ারি উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে দাঙ্গা শুরু হয়। খুন, লুঠতরাজ, দোকান, বাড়ি, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় তিন দিন ধরে এই তাণ্ডব চলে। চতুর্থ দিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ও আপ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতির পর হিংসা কিছুটা প্রশমিত হয়। যদিও বেশ কিছু জায়গায় তা মাসের শেষ অবধি ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকে। সাত দিনের এই দাঙ্গায় সরকারি হিসেবে বলা হচ্ছে 55 জন মৃত এবং 500-এর অধিক আহত। কিছু মানুষ নিরুদ্দেশ বলেও অভিযোগ। এখনও অবধি পুলিশ প্রায় 700টি এফআইআর দায়ের করেছে এবং প্রায় 1300 মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন।

     

     

    গত 11 ডিসেম্বর সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) অনুমোদিত হয়। এর চারদিন পরে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় এই আইনের বিরোধিতা করে একটি জমায়েত হয়। পুলিশ এই জমায়েতের উপর হামলা চালায়। তাদের অভিযোগ, ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে একটি রাস্তায় হিংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল। টিভি ফুটেজে দেখা যায় তারা কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে, প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে পর্যন্ত ঢুকে পড়ে ভাঙচুর চালায়, এবং পাঠরত পড়ুয়াদের উপর ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। অনেকে গুরুতর ভাবে আহত হন এবং তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এই হামলার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আজ অবধি কোনও এফআইআর দায়ের করতে ব্যর্থ হয়েছে।

     


    গত ২৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে ভিডিওটি আমাদের পোর্টালে সম্প্রচারিত হয়

     

    এই ঘটনার পরেই নয়া নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। দিল্লিতে বিশেষ করে শাহিনবাগের জমায়েত প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দিল্লির রাজনৈতিক বাতাবরণ স্পষ্টতই দু’টি অনতিক্রম্য ভাগে বিভাজিত হয়ে যায় - একদিকে মূলত অদলীয় নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত সিএএ বিরোধী শান্তিপূর্ণ সভা, সমাবেশ, মিছিল; অন্যদিকে সিএএ-র সমর্থনে সংঘ পরিবারের বিভিন্ন সংগঠনের প্ররোচনামূলক পাল্টা প্রত্যুত্তর। এরপর জানুয়ারির 5 তারিখ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখোশধারী গুন্ডার দল শিক্ষার্থীদের ওপর একতরফা হামলা চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন একইসঙ্গে ফি-বৃদ্ধি ও সিএএ-বিরোধী আন্দোলন চলছিল। এই নৃশংস আক্রমণে জেএনইউ-র ছাত্র সংসদের সভাপতি ঐশী ঘোষ এবং অধ্যাপিকা সুচরিতা সেন-সহ আরও কয়েকজন গুরুতর আহত হন। পুরো ঘটনা চলাকালীন ক্যাম্পাসের ভিতরের পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। সিসিটিভি ফুটেজ এবং বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ার পোস্ট থেকে কিছু আক্রমণকারীকে শনাক্ত করা হয়, কিন্তু কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি। ফেব্রুয়ারির 8 তারিখ দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন হয়। নির্বাচনী প্রচারে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে লাগামছাড়া বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, যা পরিস্থিতিকে আরও বিষাক্ত করে তোলে। নির্বাচনের পরেও যেখানেই সিএএ-বিরোধী আন্দোলন হয়েছে, সেখানেই লাগামছাড়া ঘৃণা প্রচার করা হয়েছে। অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে পুলিশ, প্রশাসন কোনও সদর্থক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়।

     

    রিপোর্ট 1: গ্রুপ অফ ইন্টেলেকচুয়ালস অ্যান্ড অ্যাকাডেমিশিয়ান্স

     

    রিপোর্টিটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে

     

    শিক্ষক, গবেষক, উদ্যোগপতি, আইনজীবী এবং মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে এই সংগঠনটি 2015 সালে গঠিত হয়। এদের রিপোর্টের শিরোনাম হল, ‘দিল্লি রায়টস 2020 গ্রাউন্ড জিরো থেকে প্রতিবেদন— উত্তর-পূর্ব দিল্লির শাহিনবাগ মডেল: ধরনা থেকে দাঙ্গা’। রিপোর্টটি সরাসরি বলছে, হিন্দুদের বিরুদ্ধে এটি একটি পূর্ব-পরিকল্পিত দাঙ্গা ছিল এবং সিএএ শুধুমাত্র একটা বাহানা, যেটা দাঙ্গার পরিকল্পনা করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। দাঙ্গার চারটি ধাপ ছিল: (1) সংসদে আইন হয়ে যাওয়ার পরেই জেহাদি এবং পিএফআইয়ের (PFI) সদস্যরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ শুরু করে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জামিয়া মিলিয়াতে পুলিশের সঙ্গে এদের সংঘর্ষ হয়। (2) শাহিনবাগ ধরনের ধরনা, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে শুরু হয়। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এদের সমর্থন করে। আরবান নকশাল-জেহাদি চক্র গড়ে ওঠে, যারা বাইরের কারও মধ্যস্থতার রাস্তা বন্ধ করে দেয়। (3) 15 জানুয়ারি থেকে 15 ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ জারি থাকে, পুলিশ এবং প্রশাসনের তরফে বাধা দেওয়ার কোনও চেষ্টা হয় না। ধরনাস্থলগুলিতে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ হয়। উগ্র ইসলামিক মতবাদ এবং হিন্দু-বিরোধিতা প্রচার করা হয়। (4) 15 ফেব্রুয়ারির পর থেকে বেশির ভাগ ধরনাই হিংস্র এবং আগ্রাসী হয়ে ওঠে। 23 ফেব্রুয়ারি চার হাজার সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারী মালবিয়া নগরের শিব মন্দিরের সামনে একত্রিত হন এবং আজাদির স্লোগান দেন। তারা রাস্তা অবরোধ করার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এরপরেই হিন্দুদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু হয়। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, আপের দুই মুসলিম নেতা, তাহির হুসেন এবং আমানুল্লাহ খান দাঙ্গায় জড়িত ছিলেন এবং তফসিলি শ্রেণীর মানুষ দাঙ্গায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

     

     

    এই রিপোর্ট অনুসারে সিএএ-বিরোধী ধরনাগুলিই ছিল দাঙ্গার উৎস। চরিত্রগত ভাবে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন ছিল হিংসাত্মক। আন্দোলন ছিল হিন্দু, ভারত, পুলিশ ও সরকার বিরোধী। আন্দোলনগুলিতে তথাকথিত আরবান-নকশাল, জেহাদি নেটওয়ার্ক কাজ করেছে, বহিরাগতদেরও ভূমিকা ছিল। সীমান্তের ওপারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। রিপোর্টটিতে কিছু বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন- এনআইএ-এর দাঙ্গার তদন্ত করা উচিত, দাঙ্গায় বিদেশি অর্থ ও সমর্থন সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা উচিত, শাহিনবাগ ধরনের ধরনা সংগঠিত করার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল কোথা থেকে জোগাড় হল সেটাও জানা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রাজনৈতিক সমাবেশ এবং বিদ্বেষমূলক প্রচার বন্ধ করা উচিত।

     


    গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে ভিডিওটি আমাদের পোর্টালে সম্প্রচারিত হয়

     

    এই রিপোর্টটি ‘অরগানাইজার.ওআরজি’(organizer.org) ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত। লক্ষ্যণীয় যে, রিপোর্টটি শুধুমাত্র দাঙ্গা-কবলিত কিছু জায়গা পরিদর্শনের উপর ভিত্তি করে লেখা। কোনও তথ্যসূত্রের উল্লেখ নেই। কারও কোনও দেশবিরোধী বা হিন্দুবিরোধী বক্তব্য, কিংবা কারও কাছে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র বা নিষিদ্ধ কাগজপত্র পাওয়া গেছে কিনা, সেই নিয়েও কোনও কিছুর উল্লেখ নেই। সমাবেশগুলিকে আর্বান-নকশাল এবং জেহাদিদের কার্যকলাপ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু নির্দিষ্ট করে কে বা কারা নকশাল বা উগ্রপন্থী সেটা চিহ্নিত করা হয়নি। পুরো সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকে মূলত একটি হিংসাত্মক ও উগ্রপন্থী মুসলিম আন্দোলন হিসাবে দেখানো হয়েছে। বাস্তব হচ্ছে, এই আন্দোলন ছিল মূলত শান্তিপূর্ণ, কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ব্যতিক্রম মাত্র। এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে অভূতপূর্ব ভাবে অ-মুসলিম মানুষ এবং ছাত্র-যুবর সমাবেশ ঘটেছিল।

     

     

    রিপোর্ট 2: লেট আস হিল আওয়ার দিল্লি

     

    রিপোর্টিটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে

     

    দাঙ্গা চলাকালীন 27 ফেব্রুয়ারি চারজন সমাজকর্মী উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করেন। এই জায়গাগুলি হল ভজনপুরা, চাঁদবাগ, গোকুলপুরী, চমন পার্ক, শিব বিহার, মেন মুস্তাফাবাদ (ভাগীরথী বিহার, ব্রিজপুরী)। তাঁরা এই দাঙ্গাকে একটি মনুষ্যসৃষ্ট ট্র্যাজেডি হিসাবে বর্ণনা করেন। তাঁদের মূল পর্যবেক্ষণগুলি নিম্নরূপ:

            এই এলাকাগুলিতে যেভাবে মুসলিমদের নিশানা করা হয়েছে, তা 1984-তে দিল্লিতে শিখদের এবং 2002 সালে গুজরাটে মুসলিমদের যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছিল, তা মনে করিয়ে দেয়। মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম, কিন্তু নৃশংসতা একইরকম ভাবে ভয়াবহ। দেখা গেছে একটি দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পাশের দুটি অক্ষত আছে। রাস্তার ধারে মাজার, মহল্লার ভিতরে মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

            হিন্দু, মুসলিম উভয়েরই বক্তব্য যখন সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল, তখন দিল্লি পুলিশের খোঁজ পাওয়া যায়নি। অসহায় মানুষ বারবার 100 নম্বর লাইনে ফোন করেছেন, কিন্তু 48 থেকে 72 ঘণ্টা কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

            এই দলের ছেষট্টি বছরের শিখ ট্যাক্সিচালক চারিদিকের লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ দেখে বিহ্বল হয়ে যান। তাঁর 1984-এর দাঙ্গার কথা মনে পড়ে যায়। তিনি খুব গর্বিত যে দাঙ্গায় যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তাঁদের জন্য দিল্লির সব গুরুদ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল।

            মানুষের চোখেমুখে ভয়, কারও ক্রোধ, কারও চোখে অশ্রু। প্রবীণ মানুষরা আমাদের ভিতরে ঢুকতে বলছিলেন, কারণ খোলা রাস্তায় কথা বলা নিরাপদ নয়।

            মুসলিমরা নিশ্চিতভাবেই নিশানা ছিলেন, কিন্তু কিছু হিন্দুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দোকান, ব্যাঙ্কোয়েট হল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গোকুলপুরীতে আমরা দেখেছি হিন্দুদের অটোরিকশা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন হিন্দুর দুটো অটোর পিছনে ‘জয় মাতা দি’ লেখা আছে। কিন্তু তাঁর গাড়িতে তখন মুসলিম যাত্রী ছিল, তাই তাঁকেও মুসলিম ভেবে তাঁর দু’টো অটোই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের দরিদ্রতম মানুষদের জীবিকা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।  

            বহু জায়গায় আমরা শুনেছি পুলিশ উন্মত্ত গুন্ডাদের সাহায্য করেছে। পুলিশের উপর মানুষের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।

            সদ্যগঠিত আপ সরকারের উপরেও মানুষ ক্ষিপ্ত। দাঙ্গার সময় কোনও নেতানেত্রী বিপর্যস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াননি। অথচ এনারাই নির্বাচনের আগে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন।

            বহু মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। একটি বাঙালি পরিবার উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরে তাঁদের গ্রামে ফিরে যাচ্ছিল। তারা ভয়ে ছিলেন যে, তাদের বাংলাদেশি বলে দেগে দেওয়া হবে। আরেকটি পরিবার বেরেলিতে ফিরে যাচ্ছিল। অনেকে দিল্লির মধ্যেই তাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়ি চলে যাচ্ছিলেন। চাঁদবাগ, শিব বিহার থেকে প্রায় 3,000 লোক অন্যত্র চলে গেছেন।

            ইউসুফ নামে একজনের ফটো আমাদের দেখানো হয়, যিনি নিরুদ্দেশ।

     

    রিপোর্ট 3: কল ফর জাস্টিস

     

    রিপোর্টিটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে

     

    গত 29 মে দিল্লির এই এনজিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে একটি তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট জমা দেয়। এঁরা 29  ফেব্রুয়ারি এবং 1 মার্চ উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিভিন্ন এলাকা- যমুনা বিহার, চাঁদবাগ, ব্রিজপুরী, শিব বিহার, ভজনপুরা প্রভৃতি স্থান পরিদর্শন করেন। তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই দাঙ্গা ছিল একটি পূর্ব-পরিকল্পিত চক্রান্ত। টুকরে-টুকরে গ্যাং, পিঁজরা তোড়, জামিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটি, জামিয়া মিলিয়া প্রাক্তনী সংসদ, পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া, ভীম আর্মি, স্থানীয় বিধায়ক, আইএসআই এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন এই চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই রিপোর্টে কংগ্রেস, আপ এবং বিভিন্ন বামপন্থী দলকে ভুয়ো খবর ও ঘৃণা ছড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে তাঁরা যে কারণগুলির উল্লেখ করেন সেগুলি হল: ওই দিন সব মুসলিম স্কুল বন্ধ ছিল, হিন্দু স্কুলে মুসলিম ছাত্ররা অনুপস্থিত ছিল, ম্যানেজার মুসলিম হওয়ার কারণে একটি প্রাইভেট ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল। রিপোর্ট সংগ্রহকারীরা উভয় সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি পরিদর্শন করেছেন। হিন্দুরা তাদের বাসস্থানের ক্ষতি দেখাতে পেরেছে, কিন্তু মুসলিমরা তাদের ক্ষতির কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি। তাঁদের দাবি, কোনও দরগার ওপর আক্রমণের কোনও প্রমাণ আমরা পাইনি। তাঁরা মনে করেন, এই দাঙ্গা যে একটি পূর্ব-পরিকল্পিত চক্রান্ত, উপরোক্ত ঘটনাগুলি তার অব্যর্থ প্রমাণ। এখানে বলা দরকার, মাদ্রাসাকে ‘মুসলিম স্কুল’ বলার তবু একটা প্রবণতা থাকতে পারে, যদিও সেখানে অনেক হিন্দু ছাত্রছাত্রীও পড়ে। কিন্তু অন্যান্য স্কুলগুলিকে ‘হিন্দু স্কুল’ বলে অভিহিত করা সাম্প্রদায়িক মানসিকতার একটি বিরলতম নিদর্শন। ‘কল ফর জাস্টিস’-এর মূল তথ্যসূত্র হচ্ছে একটি অতি পরিচিত, সরকারপন্থী সর্বভারতীয় ইংরাজি সংবাদমাধ্যম এবং ‘অপইন্ডিয়া’(OpIndia) নামক একটি ওয়েবসাইট, যারা নিজেদের সম্বন্ধে লিখছে যে, বাম আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করা এবং প্রকৃত সত্য প্রকাশ করা তাদের উদ্দেশ্য। তারা খোলাখুলি ভাবে নিজেদের দক্ষিণপন্থী বলে এবং মতাদর্শগত ভাবে নিরপেক্ষ হওয়ার দাবি করে না।

     

    ‘অল্ট নিউজ’(AltNews) নামে একটি নির্ভরযোগ্য ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট প্রমাণ করেছে যে, ‘কল ফর জাস্টিস’-এর বেশ কিছু তথ্য ভুল, বিপথগামী এবং একদেশদর্শী। এই ধরণের কিছু উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হল: (1) একটি ভিডিও-র মাধ্যমে রিপোর্টটি দাবি করছে যে, প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার জন্য প্রতি শিফটে একজন মহিলাকে পাঁচশো এবং পুরুষকে সাতশো থেকে আটশো টাকা দেওয়া হয়েছে। একটি শিফটের সময়সীমা আট ঘণ্টা। ফ্যাক্ট-চেক বলছে ভিডিওটি আসলে দিল্লি দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের একজন ব্যক্তি অর্থসাহায্য করছেন, সেটার রেকর্ডিং। (2) দাবি- আপ বিধায়ক আমানুল্লাহ খান জামিয়া নগরে দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, বাস পোড়ানো হচ্ছে। ফ্যাক্ট-চেক- দুপুর দুটো থেকে সন্ধ্যা ছটা অবধি তিনি শাহিনবাগে ছিলেন। কোনও বাস পোড়ানোর খবর মিডিয়ায় নেই। (3) দাবি- 17 ফেব্রুয়ারি উমর খালিদ তাঁর বক্তব্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় দাঙ্গা শুরু করার আহ্বান জানাচ্ছেন। ফ্যাক্ট-চেক- বাস্তবে খালিদ ঐ তারিখে মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে বক্তব্য রেখেছিলেন, যেখানে তিনি মহাত্মা গান্ধী এবং অহিংসা ও সত্যাগ্রহের উল্লেখ করেছিলেন। খালিদ বলেছিলেন, “আমরা হিংসার উত্তর হিংসা দিয়ে দেব না, ঘৃণার উত্তর ঘৃণা দিয়ে নয়। ঘৃণার উত্তর আমরা ভালবাসা দিয়ে দেব, আমাদের লাঠি মারলে আমরা তেরঙ্গা জড়িয়ে থাকব, গুলি করলে সংবিধান তুলে ধরব, গ্রেপ্তার করলে ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’ গাইতে গাইতে জেলে চলে যাব।“ (4) দাবি- 23 ফেব্রুয়ারি পনেরো থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের সাত হাজার লোক, যারা লুঠতরাজ করতে সিদ্ধহস্ত, সর্দার বাজারের শাহি ইদগাহতে একত্রিত হয়। ভীম আর্মির লোকেরা উপস্থিত ছিল। একজন হকার বলেছেন, তারা ‘অন্তিম যুদ্ধ’-র জন্য এসেছে। ফ্যাক্ট-চেক- মিডিয়াতে এই ধরনের কোনও জমায়েতের খবর নেই। স্থানীয় থানার স্টেশন হাউস অফিসার কোনও সমাবেশের কথা অস্বীকার করেন। (5) দাবি- দাঙ্গার চার্জশিটে হর্ষ মান্দারের নাম দেওয়া হয়েছে। 16 ডিসেম্বর জামিয়া মিলিয়াতে তাঁর বক্তব্যের বিশেষ কিছু অংশ তুলে ধরে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তিনি আদালতের অবমাননা করেছেন এবং জনতাকে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে বলেছেন, যার অর্থ তিনি তাদের হিংসাত্মক কার্যকলাপে প্ররোচিত করেছেন। ফ্যাক্ট-চেক- এই বরেণ্য সমাজকর্মীর বক্তব্যের কিছু অংশে দেখা যাচ্ছে, তিনি জনতাকে জিজ্ঞাসা করছেন, “কী ধরণের দেশ আপনারা সন্তানদের জন্য রেখে যেতে চান? সেই সিদ্ধান্ত কোথায় হবে? প্রথমত, রাস্তায় যেখানে আমরা আজকে আছি। ...কোন জায়গায় এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে? আমাদের হৃদয়ে। আপনাদের হৃদয়ে এবং আমার হৃদয়ে... ঘৃণা দিয়ে তারা আমাদের হৃদয়কে হত্যা করতে চায়। আমরা যদি ঘৃণা দিয়ে উত্তর দিই, তাহলে সেটার পরিণাম ঘৃণাই হবে... যদি আপনারা 2 শতাংশ হিংস্র হন, ওরা 100 শতাংশ হবে। গান্ধীজির থেকে আমরা শিখেছি হিংসা এবং অন্যায়কে কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়। কেউ যদি আপনাদের হিংসায় প্ররোচিত করে, তবে তিনি আপনার শুভাকাঙ্খী নন।”

     


    গত ৬ মার্চ দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে ভিডিওটি আমাদের পোর্টালে সম্প্রচারিত হয়

     

     

    রিপোর্ট 4: পিপলস ইউনিয়ান ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস

     

    রিপোর্টিটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে

     

    ‘পিপলস ইউনিয়ান ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস’ (পিইউডিআর PUDR)

    একটি অত্যন্ত সুপরিচিত মানবাধিকার সংগঠন। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তারা ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের উপর উল্লেখযোগ্য কাজ করে আসছেন। এই সংগঠন দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে নিজেদের অনুসন্ধান চালিয়েছেন এবং এই দাঙ্গায় যে সাতশো’টি এফআইআর দায়ের হয়েছে, সেগুলি বর্তমানে তদন্তের কোন পর্যায়ে আছে তা জানতে চেয়েছেন। তাঁদের রিপোর্টের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অভিযোগ নীচে তুলে দেওয়া হল:

     

            পুলিশ বিশেষ কিছু এফআইআর বেছে নিচ্ছে এবং নিজেদের মনগড়া একটি আখ্যান তৈরি করছে। তাঁরা একটি উদাহরণ দিচ্ছেন, যেখানে পুলিশ নিজে অভিযোগকারী এবং তাঁর তথ্যসূত্র হচ্ছে একজন ‘স্পেশাল ইনফর্মার’। যখন দেখা যাচ্ছে অভিযোগগুলি জামিনযোগ্য, তৎক্ষণাৎ সেটার উপর ইউএপিএ-র অধীন অন্যান্য ধারা চাপিয়ে লকডাউনের মধ্যে এত দ্রুততার সঙ্গে সেটার তদন্ত হচ্ছে যে, প্রায় রোজ স্পেশাল সেল থেকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক এবং সংগঠকদের জেরার জন্য ডেকে পাঠানো হচ্ছে। তাদের ফোন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে (বিশেষ করে যারা জামিয়া মিলিয়ার সঙ্গে যুক্ত)। লকডাউন এবং ইউএপিএ-র কারণে অভিযুক্তদের পক্ষে কোনও আইনি সাহায্য পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

            বিভিন্ন অনুসন্ধান রিপোর্ট জানাচ্ছে যে, দাঙ্গায় 53 জন মৃতের মধ্যে 38 জন মুসলিম, আহতরা অধিকাংশ মুসলিম বা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত যারা হয়েছেল, তারাও মুসলিম। কিন্তু এই বাস্তবটা স্মৃতি থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সাংবাদিকদের হিন্দু নাম হলে তবেই উন্মত্ত জনতা তাদের যেতে দিয়েছে; মুসলিম যুবকদের মারধর করা হয়েছে, জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করা হয়েছে। আহত মুসলিম যুবকদের যাতে হাসপাতালে না নিয়ে যাওয়া যায়, তার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পিইউডিআর এটাও অভিযোগ করে যে, একটি থানায় মুসলিমদের আটকে রেখে অত্যাচার করা হয়েছে।

            যে কোনও ঘটনায় সত্য উদঘাটনে এফআইআর মুখ্য ভূমিকা নেয়। এতে কোনও গরমিল হলে পুরো তদন্ত বিপথগামী হয়ে যায়। এফআইআর দায়ের করতে গিয়েই অনেককে হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মৃত ব্যক্তির পরিবার এফআইআর দায়ের করতে গেলে সেটা তুলে নেওয়ার জন্য তার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ নিতে থানা অস্বীকার পর্যন্ত করেছে।

            পিইউডিআর দাঙ্গা সংক্রান্ত 40টি এফআইআর সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছে। এগুলির মধ্যে তথ্যের কিছু বিকৃতি ও গরমিল লক্ষ্য করা গেছে। যখন লুঠ, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ কেউ আনার চেষ্টা করেছেন, তাকে চাপ দেওয়া হয়েছে সেটা লঘু করতে বা অ-জামিনযোগ্য অভিযোগ তুলে নিতে। একটা এফআইআরে অনেক ঘটনা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভবিষ্যতে তদন্তের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করবে। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ নিজেই অভিযোগ করেছে, যার অর্থ তিনি গণ্ডগোল থামানোর বদলে সেটা দেখতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বা জেরার জন্য ডাকা হয়েছে, তাদের আইনজীবীদের এফআইআর জোগাড় করতেই কালঘাম ছুটে যাচ্ছে।

            দাঙ্গায় পুলিশের ভূমিকা এবং ঘটনার আগে ও পরে হামলাকারীদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশের অভিযোগের কারণে, সমস্ত এফআইআর-এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে ‘যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ’ হওয়ার কারণ আছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, কোনও এফআইআর-ই প্রকাশ্যে যাচাই করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। পুলিশের মধ্যে যে রকম সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে, তার ফলে মুসলিমদের আরও কোণঠাসা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তদন্তের স্বচ্ছতার জন্য সমস্ত এফআইআর প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। লক্ষ্য রাখা দরকার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণাদি, সিসিটিভি ফুটেজ, ফোন রেকর্ড, ছবি, ভিডিও ইত্যাদি সংগ্রহে যেন কোনও পক্ষপাতিত্ব না থাকে।    

            কোভিড জনিত লকডাউনের মধ্যেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তলব পাঠিয়েছে। সন্দেহভাজনদের মধ্যে বেশিরভাগই মুসলিম। এর ফলে আইনি সাহায্য পেতে অসুবিধা হয়েছে, এবং শুধু তাই নয় করোনা সংক্রমণের কারণে তাদের জীবনও বিপন্ন হয়েছে। ‘দিল্লি মাইনরিটিজ কমিশন’-এর চেয়ারম্যান জাফারুল ইসলাম খান, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বলেছেন, দিল্লি দাঙ্গা ‘একতরফা এবং সুপরিকল্পিত’ এবং মুসলিমদের ‘র‍্যান্ডম’ গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশকে তিনি নোটিস পাঠিয়েছিলেন। এই কারণে তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে এবং তাঁর বাড়ি তল্লাশি হয়েছে।

            অভিযোগ করা হয়েছে পুরো সিএএ-বিরোধী আন্দোলন একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। দেশজুড়ে যে প্রতিবাদ সমাবেশ সংগঠিত হয়েছিল, তা ছিল মূলত শান্তিপূর্ণ এবং আইনি পথে পরিচালিত। অথচ, সেটাকে লাগাতার ভাবে সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী হিসাবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। এটা করে দেশব্যাপী এই জনপ্রিয় আন্দোলনকে, এবং যে দাবিগুলো উঠেছিল সেগুলোকে নস্যাৎ করার চেষ্টা হয়েছে। জামিয়া মিলিয়ায় পুলিশের তাণ্ডবের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপই নেওয়া হল না। মনে রাখা দরকার, এই ভয়াবহ আক্রমণকে দেশে বিদেশে প্রবল ভাবে ধিক্কার জানান হয়েছে।

     


    গত ৭ মার্চ বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর ও কপিল মিশ্রের "গোলি মারো' মন্তব্য নিয়ে ভিডিওটি আমাদের পোর্টালে সম্প্রচারিত হয়

     

    দিল্লি পুলিশ পিইউডিআর-এর এই রিপোর্টের তীব্র সমালোচনা করেছে, এবং সেটিকে নিখাদ অলস চর্চা ও ডাহা সাম্প্রদায়িকতা বলে অভিহিত করেছে। তাঁদের যুক্তি মাত্র ছয় শতাংশ এফআইআর-এর ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্তে আসা প্রমাণ করে দেয়, তারা কতটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পুলিশের মতে, পিইউডিআর গ্রেপ্তারের সংখ্যা এবং সম্প্রদায়গত চরিত্র বুঝতেও শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা বলছে, শতাংশের বিচারে তেরোশো গ্রেপ্তারের মধ্যে উভয় সম্প্রদায়ের ভাগ প্রায় সমান সমান এবং দাবি করে যে, দু’টি সম্প্রদায় প্রায় একইরকম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা আরও দাবি করছে যে, প্রত্যেক অভিযুক্তকে আইনি সাহায্য দেওয়া হয়েছে। পিইউডিআর ভ্রান্তিবশতঃ পুলিশের কার্যকলাপ অভিসন্ধিমূলক মনে করেছে। তারা বৈরীমূলক গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করে, কারণ আদালত কোনও ক্ষেত্রেই সেগুলো সম্পর্কে কোনও প্রতিকূল মন্তব্য করেনি। তারা বলেন পুলিশ একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেছে, এটা সর্বৈব মিথ্যা।

     

     

    যে সব প্রশ্নের উত্তর নেই

     

    এত বিভ্রান্তি থাকে না যদি এই সাতশো এফআইআর সম্পর্কে সবাই জানতে পারে। কারা অভিযুক্ত, কী কারণে অভিযুক্ত, এটা জানা গেলেই তদন্ত প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়। সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাট যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের তালিকা চেয়ে দিল্লি আদালতে একটা পিটিশন করেছিলেন। পুলিশ আদালতকে জানায় যে, নাম প্রকাশ করলে অভিযুক্তের অধিকার লঙ্ঘন করা হয়। তাঁরা বলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার্থে সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, দাঙ্গা সংক্রান্ত এফআইআরগুলি ‘স্পর্শকাতর’। তবুও পুলিশ ও আদালতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। পরিস্থিতি যখন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছিল তখন পুলিশ কেন আগাম সতর্কতা অবলম্বন করেনি, যারা বিদ্বেষমূলক প্রচার করেছিল তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি? কেন ফ্ল্যাগ মার্চ করা হয়নি? প্রশাসন কেন সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয়নি? অনেকেই জানিয়েছেন সেনা রাস্তায় নামলে ক্ষয়ক্ষতি এড়ান যেত। দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস.মুরলীধরন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জানতে চেয়েছেন, যে ব্যক্তির ঘৃণা-প্রচারের জন্য 23 তারিখ হিংসা ছড়িয়ে পড়ে তার বিরুদ্ধে কেন এফআইআর দায়ের করা হয়নি। রাতারাতি বিচারপতি মুরলীধরন বদলি হয়ে যান। তাঁর পরিবর্তে যিনি আসেন, তিনি নিদান দেন যে, এফআইআর দায়ের করার এখনও সময় হয়নি। সেই এফআইআর আজও দায়ের হয়নি এই যুক্তিতে যে, ওই বক্তব্যের জন্য দাঙ্গা শুরু হয়নি, ঘৃণা-প্রচার নাকি সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই চলছিল।

     

    আদালত পুলিশকে 14 অগাস্ট অবধি যাবতীয় এফআইআর নিষ্পত্তি করার সময় দিয়েছে। কিন্তু তদন্ত জটিল ও দীর্ঘায়িত হবে ধরেই নেওয়া যায়, কারণ কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই জামিয়া মিলিয়া এবং শাহিনবাগের সক্রিয় সংগঠক ও নেতানেত্রীদের ইউএপিএ-র অধীন অভিযুক্ত করা হয়েছে। 70 দিন কারাবাসের পর এবং তিনবার আবেদন করার পর সাফুরা জরগরকে জামিন দেওয়া হয়েছে, মানবিকতার খাতিরে। প্রশ্ন জাগে, এর আগের তিনবার কি মানবিকতা কম পড়েছিল? দাঙ্গার চার্জশিটে হর্ষ মান্দারের নাম উল্লিখিত হয়েছে, কালনির্ঘণ্টতে ভীম আর্মির নেতা চন্দ্রশেখর আজাদের নামও উঠে এসেছে। কিন্তু জামিয়া, জেএনইউ-তে যারা তাণ্ডব চালাল, তাদের কিছু হল না, ‘ইয়ে লো আজাদি’ চিৎকার করে জামিয়া মিলিয়ার সামনে যিনি গুলি চালিয়েছিল, সেও বেমালুম ছাড় পেয়ে গেল, আর যে নেতানেত্রীরা অবিরাম কুৎসিত, প্ররোচনামূলক প্রচার করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের উচ্চাসনে ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেলেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে যেটা অশনি সংকেত সেটা হল, যখন আইনি ও সাংবিধানিক পথে চলা আন্দোলনকেও দেশদ্রোহী বা সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে দেওয়া হয়, তখন প্রতিবাদের পরিসর আশঙ্কাজনক ভাবে সংকুচিত হয়ে যায়। মানুষের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যায়, গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়ে। 

     

     


    সোমনাথ গুহ - এর অন্যান্য লেখা


    কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংস্থাগুলি সোশাল মিডিয়ায় যে ভুয়ো ভিডিও প্রচার করে থাকে, সেগুলোকেই তারা প্রামাণ্য

    উত্তরপ্রদেশে আইনের প্রয়োগ অখন নাগরিকের ধর্মের উপর নির্ভর করে।

    দেশ কৃষিতে উদ্বৃত্ত, অথচ ক্রমবর্দ্ধমান অনাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা- হিসেবে ভুল হচ্ছে কোথায়?

    সরকারের থেকে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা কৃষকের অন্যায্য দাবি নয়, হকের পাওনা

    তামিলনাড়ু থেকে বাংলা: দান খয়রাতির রাজনীতির শেষ কোথায়?

    নানা ধরনের দমনমূলক আইনের প্রয়োগ এবং সরকার-বিরোধী সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার যে প্র

    একটি দাঙ্গা, চারটি রিপোর্ট, অজস্র প্রশ্ন-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested