×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন, আর সিন্ধুতে পরদেশ

    বিতান ঘোষ | 17-12-2020

    সমস্যার ‘সিন্ধু'

    মানবজীবনের দুঃখকে বিষয়বস্তু করে যারা কবিতা লেখেন, তাদের বিদ্রুপ করে কবি মোহিতলাল মজুমদার লিখেছিলেন, ‘দুঃখের কবি শুনে হাসি পায়, সোনার পাথরবাটি। কল্পনা তার এতই সূক্ষ্ম, মাটিকে বলে যে মাটি।' কেন্দ্রের শাসকদলের কেষ্টবিষ্টুদের উর্বর কল্পনাশক্তি নিয়ে এই কয়েকদিন আগে পর্যন্ত অনেকেরই প্রগাঢ় আস্থা ছিল। পুরাণ আর ছদ্ম-বিজ্ঞানকে তাঁরা যেভাবে মিলিয়েছিলেন, তার তারিফ না করে উপায় ছিল না। কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের মাত্র একটি শব্দের আক্ষরিক অর্থে তারা কীভাবে "আহত' হলেন, তা এখনও অবধি বোঝা যাচ্ছে না। শাসকদলের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক নেতা বলেছেন, স্বাধীনতা উত্তর ভারতের ধারণা নাকি বর্তমান জাতীয় সঙ্গীতে নেই। থাকবেই বা কী করে অবশ্য? 1911 সালে গান লিখে ভদ্রলোক মারা গেলেন 1941-এ, আর র‌্যাডক্লিফ সাহেবের ছুরি দেশ ভাগ করল 1947-এ এসে! কথাটা ভুলে গেলেন কী করে তাত্ত্বিক সঙ্ঘপন্থী নেতা? তাঁর কোপে পড়েছে জাতীয় সঙ্গীতের "সিন্ধু' শব্দটিআস্ত সিন্ধু প্রদেশ এবং নদীটির সিংহভাগ যেহেতু "শত্রুদেশ পাকিস্তানে, তাই সিন্ধু হঠাওয়ের আর্জি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পত্রনিক্ষেপ করেছেন সেই নেতা।


    জাতীয় সঙ্গীত জন গণ মন আগেও বহুবার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। 1911 সালের 27 ডিসেম্বর কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে গানটি প্রথম গাওয়া হয়। সেই বছরেরই 11 ডিসেম্বর পাঁচটি স্তবকে এই সংস্কৃতঘেঁষা বাংলা গানটি রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর থেকে আগাগোড়া প্রশ্ন উঠে এসেছে যে, ঠিক কার উদ্দেশ্যে এই গানটি রচনা করেছিলেন কবিগুরু? সেই সময় দেশে দিল্লি দরবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। লন্ডন থেকে ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ এসেছেন তাঁর রাজত্ব পরিদর্শন করতে। একটা চর্চা বহুকাল থেকেই চালু, সেই রাজাকেই ভাগ্যবিধাতার আসনে নাকি বসিয়েছেন কবি বন্ধু পুলিনবিহারী সেনকে লেখা পত্রে রবীন্দ্রনাথ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন, "কোনও চতুর্থ কিংবা পঞ্চম জর্জ এ দেশের মানুষের ভাগ্যবিধাতা হতে পারেন না।' সময়ের রথচক্রের ঘূর্ণন পরিলক্ষিত করা কবি, জীবনের বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী থাকা কবি তাই লিখছেন, "পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী। হে চিরসারথী তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।' এই সারথী কে? আর যেই হোন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির কুশীলব কেউ নন— কবি বারবার জানিয়েছেন সেই কথা। 1939 সালে কবি আবারও লিখছেন, "যারা মনে করছেন আমি এই গানটি পঞ্চম জর্জের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছি, তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমি নিজেই নিজেকে অপমানিত করব।' দ্য হিন্দু সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ-ঘেঁষা সংবাদপত্রগুলি প্রচার করেছিল যে, এই গান পঞ্চম জর্জের উদ্দেশ্যেই গাওয়া হয়েছে, যা আদৌ সত্য নয়।

    জনতা দল ঘুরে অধুনা বিজেপি-সঙ্গ করা সেই নেতা বর্তমান জন গণ মন-র বদলে কাওয়ামি তারানার প্রথম পঙক্তি "শুভ সুখ চ্যান'-কে জাতীয় সঙ্গীত করার আর্জি জানিয়েছেন। এখানেও মারাত্মক এক ইতিহাসগত প্রমাদ করে ফেলেছেন তিনি। যে "জন গণ মন'-তে তিনি বর্তমান ভারতের কোনও ছবি পাননি, সেই জন গণ মন-রই হিন্দুস্তানি অনুবাদ শুভ সুখ চ্যান তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করবে কী করে? সেই নেতার বোধহয় জানা নেই, আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জন গণ মন-কে 1942 সালেই জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু একে সংস্কৃতঘেঁষা কঠিন বাংলা, তায় বেশ দুর্বোধ্য। অনেকে বললেন, বাহিনির সব অংশের কথা ভেবে হিন্দি-উর্দু মিশ্রিত প্রাঞ্জল হিন্দুস্তানিতে এই গানকে অনূদিত করা হোক। নেতাজীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আবিদ হাসান লিখে ফেললেন শুভ সুখ চ্যান। সুরারোপ করলেন রাম সিং ঠাকুর। দু'টি গান পাশাপাশি রেখে শুনলেই বোঝা যায়, দু'টিতে বিশেষ কোনও প্রভেদ নেই। শুধু বর্তমান জাতীয় সঙ্গীতের নির্ধারিত সময়সীমা 52 সেকেন্ড আর অন্যটির 55 সেকেন্ড। তাত্ত্বিক নেতারত্নটি মনে হয় বিস্মৃত হয়েছেন যে, "সিন্ধু' শব্দটি শুভ সুখ চ্যান গানেও রয়েছে।

    তা, হঠাৎ সব ভুলে দেশের জাতীয় সঙ্গীত বদলের জিগির তোলা হল কেন? বাসন্তী দেবী কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপিকা চিলিকা ঘোষ বলছিলেন, "শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিলেই শাসক জনগণের নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি চলতি কৃষক আন্দোলনে রাজনৈতিক ভাবে যথেষ্ট বিপাকে পড়েছে। তাই বোধহয় এসব অবান্তর প্রসঙ্গ তুলে জলঘোলা করতে চাইছে।' সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ, পেশায় আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের বক্তব্য, "বিজেপি দেশের বহুত্ববাদকে স্বীকৃতি দেয় না। জাতীয় সঙ্গীতে দেশের বিভিন্ন প্রদেশের উল্লেখ আছে। সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের বহুত্ববাদী ভাবনার প্রতিফলন আমাদের এই জাতীয় সঙ্গীত। বিজেপি তো তাকে রুখতে চাইবেই। এটা বিজেপির রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা।' প্রায় অনুরূপ বক্তব্য নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের প্রধান ইমানুল হকেরও। তাঁর টিপ্পনী, "এই বিজেপিই তো কিছুদিন আগে পর্যন্ত জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার সময় কেউ না দাঁড়ালে তার ওপর হামলা করত। এখন দেশের জাতীয় সঙ্গীতটাকেই বদলে দিতে চাইছে। এরা অন্যদের দেশদ্রোহী বলে। কিন্তু দেশের জাতীয় সঙ্গীতকে যারা বদলাতে চায়, তাদের চেয়ে বড় দেশদ্রোহী আর কারা হতে পারে?' ইমানুলবাবু আরও জানালেন যে, "সিন্ধু শব্দ থেকেই কিন্তু "হিন্দু' শব্দের উৎপত্তি। সেই সিন্ধু শব্দটিকেই বাদ দিতে চাইছে দেশে হিন্দুত্বের ঠিকাদারি নেওয়া বিজেপি। এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কিছু হতে পারে না।' বাংলা বাঙালির অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন, জাতীয় বাংলা সম্মেলনের তরফে সিদ্ধব্রত দাস অবশ্য পুরো বিষয়টিকেই কেন্দ্রের শাসকদলের বাঙালি-বিদ্বেষ হিসাবে দেখতে চাইছেন। তাঁর মতে, "রবীন্দ্রনাথ বাঙালি এবং একইসঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধী। তাই বিজেপির নেতারা মুখে যতই রবীন্দ্রনাথ আওড়ান না কেন, আসলে তারা বাঙালি কবির বাংলা ভাষায় লেখা জাতীয় সঙ্গীতকে বদলে ফেলতে চান।'

    ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায় বিজেপি এবং তার ছত্রধর সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রথমদিকে স্বাধীন দেশের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকাকেও স্বীকৃতি দেয়নি। তিন সংখ্যাকে "অশুভ' বলে গণ্য করে তারা ব্রিটিশের ইউনিয়ন জ্যাকের উদ্দেশ্যেই সেলাম ঠুকত এই কিছুকাল আগে পর্যন্ত। এখন দেখা যাচ্ছে দেশের জাতীয় সঙ্গীতকে নিয়েও তাদের হরেক "অসুবিধা' আছে। এর আগে একবার বিজেপি নেতা কল্যাণ সিং জাতীয় সঙ্গীতে কিছু শব্দ বদলের নিদান দিয়েছিলেন। এবার প্রায় আস্ত জাতীয় সঙ্গীতটাকেই বদল করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। দেখা যাক তাত্ত্বিক নেতার এই প্রস্তাবের পর সিন্ধুর জল কতদূর বয়, আর দেশের জন গণ মন কী রায় দেন।


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    আচ্ছা মৃত্যুর পর কী? মৃত্যুতেই কি সবকিছুর পরিসমাপ্তি নাকি, তার মধ্যে থেকেই সৃষ্টির বীজ উপ্ত হয়?

    কালো চামড়ার মানুষদের ওপর অত্যাচারের যে সুদীর্ঘ দলিল, তাতে জর্জ ফ্লয়েডের নামটা নতুন সংযোজন মাত্র।

    বীরপুজোয় মত্ত শাসক এবং ভক্তরা ইতিহাস-বিস্মৃত হলে তাদেরই চরম মূল্য চোকাতে হবে।

    ধর্ম যাদের সঞ্জীবনী, সেনাশাসন যাদের গণতান্ত্রিক আভরণ, তাদের পথ আমরা কেন অনুসরণ করব?

    কৃষ্ণের মোহনবাঁশিতেই যখন হিরণ্যকশিপুরা পরাভূত, তখন বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতারে আসার কীই বা প্রয়োজন?

    দলের বাইরে বহু চালচোর ছিলই, ভোটের পর দেখা গেল দলের ভিতরেও বহু চালচোর আছে!

    বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন, আর সিন্ধুতে পরদেশ-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested