ইতিহাসের কিছু বিশেষ মুহূর্ত আসে, যার তাৎপর্য সবসময় সমসাময়িক কালের বিচারে ঠিকমতো ধরা পড়ে না। সেই মুহূর্তটি কোনও একক ঘটনা বা বহু ঘটনার সমন্বয়ে সৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু, বর্তমানে দাঁড়িয়ে তাকে চিনতে পারা, তার গুরুত্ব বুঝতে পারাটা জরুরি। ঐতিহাসিকরা যে হেতু অতীত ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে ইতিহাস রচনা করেন, তাই বর্তমান কালকে বোঝা বা বিশ্লেষণ করার দায় তাঁরা সহজেই এড়িয়ে যেতে পারেন, কিন্তু সাংবাদিকরা পারেন না। সাংবাদিকদের যে হেতু বর্তমানকে নিয়েই কাজ করতে হয়, তাই সময়কে চেনা, তার গুরুত্বকে বোঝার জন্য সাংবাদিকদের নিয়ত পরীক্ষায় বসতে হয়। যেমন, এই সময়ে হচ্ছে।
সি এ এ, এন আর সি, এন পি আরের বিরুদ্ধে গোটা দেশে বেড়ে চলা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি যে ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে, তাকে কীভাবে দেখব আমরা ? বহমান এই আন্দোলনকে দেখে একটা কথা অবশ্যই বলা যায়, দেশে রাজনীতির যে ঐতিহ্য এতদিন ধরে গড়ে উঠেছে, এই আন্দোলনের চরিত্র তা থেকে ভিন্ন। বলা বাহুল্য, এই রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মধ্যে দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী, রক্ষণশীল রাজনীতি বা উদারনৈতিক রাজনীতি সবই রয়েছে। এমনকী, সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থা হারানো সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতিও এই ঐতিহ্যেরই বিপ্রতীপ অঙ্গ। কিন্তু বর্তমান আন্দোলন এ সবকে পাশে সরিয়ে রেখে, আক্ষরিক অর্থেই রাজনৈতিক দলগুলিকে বা প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতিকে (Representative Democracy) অগ্রাহ্য করে সরাসরি রাস্তায় নেমে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের (Participatory Democracy) মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে অন্য মাত্রা দিতে চলছে।
রূপকার্থে বলাই যায়, দেশে নতুন এক রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে, যার নাম ‘We, the people of India’ বা ‘আমরাই ভারতীয় জনগণ’, যাদের রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো বা ইস্তাহার ভারতের সংবিধান, এবং এই দলের পতাকা তেরঙ্গা। আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষে এই রাজনৈতিক দল দ্রুত প্রভাব বিস্তার করছে। নতুন এই ‘রাজনৈতিক দল’ গান্ধীজির মতোই অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী। এদের পুরোভাগে রয়েছে ছাত্র, যুব ও মহিলা। এই প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য, প্রকাশ্য স্থানে সমবেত হয়ে একসঙ্গে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা (Preamble) অংশটি পাঠ করা। হাতে থাকে জাতীয় পতাকা। শুধু এটুকুতেই ক্ষান্ত নন তাঁরা। দিল্লির শাহিনবাগে মহিলারা প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহ উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে সত্যাগ্রহ শুরু করেন, প্রশাসনের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে অবস্থানে অটল থাকেন। তাপাঙ্ক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামার পরেও তাঁরা ছোট ছোট পুত্রকন্যাকে নিয়েই সত্যাগ্রহ চালিয়ে যান। তাঁদের সামনে এখন দেশের মানুষ সম্ভ্রমে নতজানু। তার প্রমাণ, দিল্লির শাহিনবাগ এখন দেশের নানা জায়গায় নতুন নতুন শাহিনবাগের জন্ম দিচ্ছে। যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে ইতিমধ্যেই সি এ এ, এন আর সি বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে অন্তত ২৮ জনের প্রাণ গিয়েছে। তা সত্ত্বেও খোদ লখনউ শহরে ক্লক টাওয়ারের চারপাশে কয়েক হাজার মহিলা সত্যাগ্রহ শুরু করেছেন। সত্যাগ্রহ চলছে ইলাহাবাদ, কানপুর শহরেও। নরেন্দ্র মোদীর দোসর নীতীশ কুমারের বিহারেও বিক্ষোভ বাড়ছে। গয়া শহরের পার্কে চলছে সত্যাগ্রহ। পশ্চিমবঙ্গে মিছিল ও জনসভা চলছিলই। এবার শাহিনবাগের সমর্থনে কলকাতার পার্কসার্কাসে চলছে অবস্থান সত্যাগ্রহ। একই চিত্র আসানসোল শহরের নজরুল পার্কে। সত্যাগ্রহের আগুণ ছড়াচ্ছে দেশের অন্যান্য প্রান্তেও।
লক্ষণীয়, এই সত্যাগ্রহের পুরোভাগে রয়েছেন মহিলারা। শুধু সত্যাগ্রহ ও মিছিলের মধ্যেই এঁদের প্রতিবাদ সীমিত নেই। শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা এগিয়ে এসেছেন তাঁদের সৃজনশীলতা দিয়ে প্রতিবাদের ভাষা জোগাতে। এই ভাষা চিরাচরিত রাজনৈতিক আন্দোলনের “দিতে হবে, দিতে হবে” বা “জবাব চাই, জবাব দাও নয়,”। এক অনন্যসাধারণ কবিতা এখন জনগণের মুখের স্লোগান হয়ে গেছে “হম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে”। কলকাতায় ফুটবল স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শক তারই প্রতিধ্বনি তোলেন, “রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়।"
দেশের নবতম রাজনৈতিক দলের নাম ‘We, the people of India’ বা ‘আমরাই ভারতীয় জনগণ’, যাদের রাজনৈতিক ইস্তাহার ভারতের সংবিধান, এবং এই দলের পতাকা জাতীয় তেরঙ্গা। আসমুদ্রহিমাচল এই দল দ্রুত প্রভাব বিস্তার করছে। গান্ধীজির মতোই অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী এই দলের পুরোভাগে রয়েছে ছাত্র, যুব ও মহিলা। |
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কমিউনিষ্টরা আওয়াজ তুলেছিল, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। জনগণ সেই হঠকারিতায় সায় দেয়নি। কিন্তু আজাদি আবার নতুন করে ফিরে এসেছে জনগণের কণ্ঠে। এখন মানুষ চাইছে, জাতপাত, ধর্ম, ভাষা ও আঞ্চলিকতার ভেদাভেদ, ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতি থেকে আজাদি। এটাও চিরাচরিত রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে বর্জনের আহ্বান। নতুন এই রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে পুরনো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলির আন্দোলনের ধারাকে পাশাপাশি ফেলে তুলনা করলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের পরে সংসদীয় মধ্যপন্থী দলগুলি (কংগ্রেস সহ) নীরব। তাঁরা এ নিয়ে আইনি লড়াইয়েই নিজেদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড সীমিত রাখতে আগ্রহী। বামপন্থী নেতারা দুবার কাশ্মীর গিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু একবার শ্রীনগর এয়ারপোর্টে নেমে প্রশাসনের বাধা পেয়ে ফিরে আসেন, কোনও ধর্না বা সত্যাগ্রহ করেননি। দ্বিতীয়বার সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি নিয়ে বুড়ি ছুঁয়ে এসেছেন। শাহিনবাগের মহিলারা কিন্তু সরকার, পুলিশ বা সুপ্রিম কোর্টের অনুমতির অপেক্ষায় বসে থাকেননি। তাঁরা রাস্তায় নেমে সত্যাগ্রহ করছেন। পশ্চিমবঙ্গে বাম, কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেস সি এ এ-এন আর সি নিয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ মিছিল করছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল জেলায় জেলায় একদিনের প্রতীকি ধর্না অবস্থান করেছেন। কিন্তু এখানেও পার্কসার্কাসের মহিলাদের লাগাতার সত্যাগ্রহ তাঁদের আন্দোলনকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। মমতার কাজেকর্মে কতটা আন্তরিকতা রয়েছে, তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলার অবকাশ করে দিচ্ছেন। প্রথমত, মোদীর সঙ্গে রাজভবনে একান্ত বৈঠক সেরে তিনি অনেকটা কৈফিয়তের সুরে বলেন যে রাজ্যের দাবিদাওয়া জানানোর সঙ্গেই তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সি এ এ-এন আর সি নিয়ে রাজ্যের বিরুদ্ধ মনোভাব জানাতে ভোলেননি। অথচ, কদিন আগেই পার্লামেন্টে এ নিয়ে ভোটাভুটির সময় হুইপ জারি সত্ত্বেও তৃণমূলের বেশ কজন সাংসদ তাতে অংশ না নিয়ে গরহাজির থাকেন। আবার, রাজ্য বিধানসভায় কেরলের অনুসরণে সি এ এ বিরোধী প্রস্তাব আনার জন্য কংগ্রেস ও বামপন্থীরা যৌথভাবে প্রস্তাব দিলে তিনি তা খারিজ করে দেন। কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা আবদুল মান্নান মমতাকে প্রয়োজনে ওই প্রস্তাবে কিছু পরিবর্তন করে তা বিধানসভায় একসঙ্গে পেশ করার প্রস্তাব দিলেও তিনি রাজি হননি। এতদিনে মমতা একই প্রস্তাব আনছেন বিধানসভায়। অর্থাৎ, দেশের এই বিপজ্জনক পরিস্থিতেও চিরাচরিত রাজনীতির সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠার কোনও ইচ্ছা নেই।
রাজনৈতিক দলগুলির বৃত্তের বাইরে দেশের জনগণ কিন্ত কোনও নেতা বা কেন্দ্রীয় সংগঠনের ছত্রচ্ছায়া ছাড়াই লড়ছেন। তাঁরা লড়ছেন, দেশের সংবিধানের মূল ভাবনাকে রক্ষা করতে। ইংরেজরা বিদায় নেওয়ার পরে স্বাধীন ভারতের রূপকাররা যখন দেশের সংবিধান রচনার কাজে হাত দেন, তখন অনেক পশ্চিমী পন্ডিত সংশয়ী ছিলেন। তাঁদের সংশয় ছিল, এত দারিদ্র্য, বিপুল জনসংখ্যা ও নিরক্ষরতার বোঝা, তার উপর জাতপাত, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদির ভেদাভেদ যে দেশে, সেখানে ইউরোপীয় ধাঁচে সংসদীয় গণতন্ত্র ফলপ্রসূ হবে কী করে ? বাস্তবে কিন্তু সংবিধানপ্রণেতারা পশ্চিমী সংসদীয় গণতন্ত্রের সংবিধানকে হুবহু নকল করে ভারতীয় সংবিধান রচনা করেননি। টানা তিন বছর ধরে নানা স্তরে আলাপ আলোচনা করে যে সংবিধান তাঁরা উপহার দেন, তা দেশের পশ্চিমী ধাঁচের থেকেও অনেক বেশি দেশজ বৈচিত্রকে, “নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান”কে স্বীকৃতি ও পরিসর দিয়ে তৈরি। ইউরোপের অনেক দেশের থেকে এক ধাপ এগিয়ে এই সংবিধান দেশের ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে ভোটাধিকার দিয়েছিল। আর সে জন্যই এই সংসদীয় গণতন্ত্র তার বহু অপূর্ণতা সত্ত্বেও সমাজের গভীরে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে শিকড় গাড়ছিল। হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় সমাজে যে বর্ণহিন্দুদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত, রাষ্ট্রপরিচালনায় ক্ষমতাসীন যে রাজনৈতিক শ্রেণীর আধিপত্য এখন কায়েমি স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত, তারা সবই এখন সমাজের নিচুতলার মানুষের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এই সংসদীয় গণতন্ত্রের জোরেই। ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর এই অধিকার সাধারণ মানুষকে দিয়েছে ভারতীয় সংবিধান। তাই আজ যখন উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তি সেই সংবিধানের মূল চরিত্রকেই সংসদে নিছক সংখ্যার জোরে পাল্টে দিতে উদ্যত, তখন সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছেন তাঁদের সংবিধানকে বাঁচাতে। তাই কোনও দলীয় পতাকা নয়, তাঁদের হাতে আজ জাতীয় পতাকা। সংবিধানের প্রস্তাবনাই তাঁদের স্লোগান। এই সত্যাগ্রহীরাই স্বাধীন ভারতের প্রকৃত নাগরিক।
দলের ভিতরকার সমালোচনা ও বিরোধী স্বরকে গুরুত্ব দিতে হবে বামপন্থার নতুন দিশার সন্ধানে
মলোটভের তৈরি নয় মলোটভ ককটেল, রুশ বিদেশমন্ত্রীকে পাল্টা ব্যঙ্গ করে ফিনল্যান্ডের বাসিন্দারা প্রথম বানা
চারপাশের অন্ধকার যখন আমাদের ঘিরে ধরছে, তখন একবার ফিরে দেখা যুক্তিবাদী চর্চার ইতিহাসকে।
নতুন নাগরিকত্ব আইন, এন আর সি এবং এন পি আর এর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আজ যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা এক কথায়
অর্ধ শতাব্দীরও আগে দেশের শত্রু বলে নিন্দিত হয়েও ক্ষুধার্ত সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল বামেরা
চাষি তার ইচ্ছা মতো উৎপন্ন পণ্যের বিপণনের অধিকার পাবে কি? মনে হয় না।