যে কোনও ঐতিহাসিক মুহূর্তেই প্রতিতুলনা মনে আসতে বাধ্য। নতুন নাগরিকত্ব আইন, এন আর সি এবং এন পি আর এর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আজ যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা এক কথায় ঐতিহাসিক। স্বাধীনতার পরবর্তী সাত দশকের মধ্যে এত বড় গণআন্দোলনের সঙ্গে তুলনায় একটি মাত্র সমসয়ের কথাই মনে আসে। তা হল, সত্তরের দশকে জরুরি অবস্থা জারির আগের দুই বছরের সময়কালের কথা। তখনও দেশে ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। মাত্র ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যুদ্ধে পাকিস্তানকে হারিয়েছেন, পূর্ব পাকিন্তান ভেঙ্গে জন্ম নিয়েছে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। তার আগেই ‘গরিবি হঠাও’ স্লোগান দিয়ে ইন্দিরা লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়েছেন, মোট ৫১৮ আসনের মধ্যে ৩৫২টি।
এর পরের দুই বছরের মধ্যেই একে একে ব্যাঙ্ক ও কয়লাখনি জাতীয়করণ, প্রাক্তন দেশীয় রাজাদের রাজন্য ভাতা বিলোপ করে তিনি দেশের সাধারণ গরিব মানুষ ও বামপন্থীদের কাছে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। কিন্তু ১৯৭৩ সালে শেষদিক থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ আর চাপা রইল না। ইন্দিরার রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা দিয়ে দেশের অর্থনীতি সঙ্কট, বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে বেড়ে চলা ভয়াবহ বেকারিকে আর ঢেকে রাখা যাচ্ছিল না। বারুদে প্রথম আগুন দেয় গুজরাতের ছাত্ররা। ডিসেম্বর মাসে গুজরাতের ছাত্ররা ফি বৃদ্দির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে, কিন্তু দ্রুত তা সরকারি স্তরে দুর্নীতি এবং বেকরির সমস্যার বিরুদ্ধে গোটা রাজ্যে বৃহত্তর আন্দোলনের আকার নেয়।
১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে ছাত্ররা রাজ্য জুড়ে নবনির্মাণ সভার নামে আন্দোলন চালাতে থাকে। পুলিশের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ, গুলিতে ছাত্রের মূত্যু ও রাজ্য জুড়ে বন্ধ পালনের জেরে শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দলের চিমনভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে গড়া রাজ্য সরকার ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হন। মোটমুটি এই সময়েই বিহারেও অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গোটা রাজ্যের ছাত্র প্রতিনিধিদের ডেকে এক সভায় লালুপ্রসাদ যাদবকে সভাপতি ও রামবিলাস পাসোয়ান, সুশীল মোদি প্রমুখকে নিয়ে বিহার ছাত্র সঙ্ঘর্ষ সমিাতি গঠন করে। এখানেও গোড়ায় তা ছিল শিক্ষার সুযোগ ও হস্টেলের সুবিধা ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলন। কিন্তু অচিরেই তা ছড়িয়ে পড়ে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে।
কিছু দিন পরেই প্রবীণ নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। তিনি গান্ধীর আদর্শে ডাক দেন সম্পূর্ণ ক্রান্তি বা টোটাল রেভল্যুশনের। ১৯৭৪ সালে কংগ্রেস বাদে বাকি সব কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন একযোগে রেল ধর্মঘটের ডাক দেয়। জর্জ ফার্নান্ডেজের নেতৃত্বে মে মাসের ৮ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত চলে। কেন্দ্রীয় সরকার কড়া হাতে ওই আন্দোলনকে দমন করলেও স্থায়ী রেলকর্মীদের ৭০ শতাংশই ধর্মঘটে যোগ দেয়। এ দিকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা তাঁর নির্বাচনে অসৎ উপায় অবলম্বনের অভিযোগে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হন। সুপ্রিম কোর্ট সেই রায় বহাল রাখে। তখন জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রকাশ্য সভা থেকে পুলিশকে সরকারের অন্যায় হুকুম পালন না করতে আহ্বান জানান। এ রকম একটা অবস্থার মুখোমুখি হয়ে শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা ১৯৭৫ সালের জুন মাসে জরুরি অবস্থা জারি করেন।
আজকের অবস্থার সঙ্গে সেদিনের ঘটনাবলীর মিল ও অমিল দুটোই আছে। মিল রয়েছে ইন্দিরা ও নরেন্দ্র মোদীর বিপুল জনপ্রিয়তার মধ্যে, দুজনেরই নির্বাচনী সাফল্যের মধ্যেও। এ ছাড়াও মিল রয়েছে দেশে ঘনিয়ে আসা আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ মিল রয়েছে, দুই ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অগ্রভাগে রয়েছে ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়। অমিলও বহু। যেমন, ১৯৭৪ সালে গুজরাত ও বিহারে আন্দোলন দ্রুত কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত হয়েছিল। জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো বড়মাপের জননেতা এই দুই আন্দোলনকে একসূত্রে গেঁথে তোলার কাজটা করেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বর্তমানের আন্দোলনের কোনও কেন্দ্রীয় মঞ্চ গড়ে ওঠেনি। বরং, তা এখনও অসংখ্য ছোট ছোট নাগরিক গোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগের সুবাদেই চলছে। সে জন্যই এই আন্দোলন এখনও পর্যন্ত নিছক রাজনৈতিক আন্দোলন না হয়ে নাগরিকদের লড়াই, দেশবাসীর লড়াইয়ের চরিত্র পেয়ে যাচ্ছে। তার সুফলও মিলছে। রাহুল গান্ধী, মায়াবতী, অখিলেশ যাদব, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতানেত্রীরা তাঁদের কাজেকর্মে অনেকদিন ধরেই মানুষের আস্থা হারাচ্ছেন। নাগরিকত্ব আইন, কাশ্মীর প্রভৃতি বিষয়ে তাঁদের প্রতিরোধ করার ইচ্ছে কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় জাগছে। তাই মানুষকে এদের দলীয় পতাকা ছেড়ে দিয়ে বেশি বেশি করে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে আন্দোলনে রাস্তায় নামতে দেখা যাচ্ছে।
ছাত্ররা ছাড়াও দেশের মানুষের এই সার্বিক আন্দোলনে নৈতিক মনোবল জোগাচ্ছেন মহিলারা। প্রবল শীত উপেক্ষা করে দিনের পর দিন দিল্লির শাহিন বাগে, গয়ার শান্তি বাগে এবং কলকাতার পার্কসার্কাসে মহিলারা রাস্তায় বসে ধরনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেরলের গ্রামে গ্রামে বাড়ির সামনে নোটিশ পড়ছে, বিজেপি এবং আর এস এস কর্মীরা স্বাগত নন। অমিত শাহের নির্দেশে নাগরিকত্ব আইনের মহিমা বোঝাতে বিজেপি কর্মীরা ঘরে ঘরে যেতে শুরু করে গোড়াতেই এই ধাক্কা খেয়েছে। সাধারণ মানুষের এই আন্দোলনকে যুক্তি ও তথ্য দিয়ে শানিত করে চলেছেন দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, গবেষণাসংস্থাগুলি এবং প্রাক্তন বিচারপতিরা, প্রাক্তন আমলারা। নৈতিক মনোবল বাড়াতে সাহায্য করছেন অমর্ত্য সেনের মতো আরও অনেকে।
সব মিলিয়ে তাই এবারের আন্দোলন শুধু ঐতিহাসিক মুহুর্তের জন্ম দিচ্ছে, তাই নয়। তা গভীরতা ও ব্যাপ্তির দিক থেকে তা ১৯৭৪ সালের আন্দোলনকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। ইন্দিরার আমলে লড়াইটা ছিল প্রধানত ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার, এবারও সেটা রয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, দেশের সংবিধান রক্ষার লড়াই। এই লড়াইয়ের কী ফল হয়, সে দিকে গোটা বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে। তাকিয়ে রয়েছে ইতিহাসও।
(শেষ)
ইতিহাস বলে কোনও একটি ভাষাকে চাপিয়ে দিয়ে দেশে ঐক্যপ্রতিষ্ঠা করা যায়নি।
করোনার বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই অসংগঠিত। নির্দিষ্ট পন্থার বদলে একাধিক পরস্পরবিযুক্ত বা পরস্পরবিরোধী
বাম কংগ্রেস আইএসএফ মোর্চার সমাবেশে মানুষের রাজনৈতিক দাবি শোনা গেল না।
ইতিহাসের পুরনো ক্ষত বাঙালি ভদ্রলোকদের বিজেপি-প্রেমী করে তুলেছে।
গান্ধী পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার কি বং বং-এর মতো রাজনৈতিক গড় রক্ষা করতে পারবেন?
চাষি তার ইচ্ছা মতো উৎপন্ন পণ্যের বিপণনের অধিকার পাবে কি? মনে হয় না।