‘ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি’, মনুর এই কথা কোথাও যেন আজও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে নারীকে। আজও অধিকাংশ নারী মনে প্রাণে হয়ত মনে করেন যে, সে কারও অধীন, সে ভালবাসে কারও ছায়ায় থাকতে, বাঁচতে। অন্যথা করে যে গুটিকতক, তাদের আজও সমাজ হয়ত দেখে আড়চোখে, তাদের দিকে বাঁকা হাসে, ভিনগ্রহের জীব ভেবে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অথচ, এমনটা তো চিরকাল ছিল না। কে তবে হরণ করে নিল নারীর স্বাতন্ত্র্য, পুরুষের মতো একই ভাবে বাঁচার অধিকার?
যে সময়ের কথা বলছি, তখনও কৌরব-পাণ্ডব ভাইদের জন্ম হয়নি। কথোপকথন চলছে পুত্রশোকে কাতর সত্যবতী ও রাজা শান্তনুর বড় ছেলে ভীষ্মের মধ্যে। গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম; সুপুরুষ, বীর, যে কোনও নারীরই ঈর্ষার পাত্র হতে পারেন তিনি। কিন্তু তিনি যে কঠিন পণ করে বসে আছেন, বিবাহ করবেন না। শুধু তাই নয়, সত্যবতীর পিতা দাস রাজা বুঝি বা কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেন যে, ভীষ্ম আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করবেন। পিতার স্বার্থে তাতেই রাজি হন যুবরাজ। এদিকে সত্যবতীর গর্ভে রাজা শান্তনুর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। চিত্রাঙ্গদ অসময়ে মৃত্যুবরণ করলে বিচিত্রবীর্য সিংহাসনে বসেন। শান্তনুর অবর্তমানে তাঁর অভিভাবক হলেন ভীষ্ম। কাশীরাজের কন্যা দু’টির সঙ্গে ভাইয়ের বিয়েও দিলেন ভীষ্ম। কিন্তু ভবিতব্যকে খণ্ডাবে কে? প্রাণক্ষয়ী যক্ষ্মা কেড়ে নিল বিচিত্রবীর্যকে। পুত্রশোকে কাতর হলেন সত্যবতী। সময় শোকের উপর কিছুটা প্রলেপ দিল, কিন্তু ততক্ষণে তাঁর মনে চেপে বসেছে নানা আশঙ্কা। রাজ্যের তো এই হাল! একদিকে ভীষণ প্রতিজ্ঞায় অটল থাকা বড় ছেলে ভীষ্ম, অন্যদিকে তাঁর নিজের সন্তানের সুন্দরী বিধবা দুই পত্নী। এতবড় রাজ্যভার কে সামলাবে? দিশাহারা হয়ে পড়েন রাজমাতা। আকুল হয়ে বড় ছেলেকে নানাভাবে বোঝাতে থাকেন। সেই সময়কার সমাজ আর আজকের সমাজকে এক খাতে ফেললে হবে না। নিঃসন্তান রমণী, নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে সন্তানবতী হতেন। সেই ক্ষেত্রজ সন্তান সমাজে বৈধ ছিল। তবে হ্যাঁ, সেই প্রথাতেও মেয়েটির আদৌ সায় ছিল কিনা জানা যায় না। ধরেই নিতে পারি ছিল না। সত্যবতীর বক্তব্য ছিল এই যে, ভীষ্ম যদি রাজি থাকেন, তবে তাঁর দুই সুন্দরী পুত্রবধূ সন্তানবতী হতে পারেন। পিতা হিসেবে ভীষ্মের কোনও বিকল্প হতে পারে না। না, এটা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে, সেক্ষেত্রেও স্বামীহারা দুই নারীর কোনও রকম মত নেওয়া হয়েছিল। গুরুজনেরা তাঁদের জন্য যে বিধান দেবেন, তাই তাঁদের মাথা পেতে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে যদি পরপুরুষের অঙ্কশায়িনী হতে হয়, সেটাও। এদিকে ভীষ্ম তো কঠোর প্রতিজ্ঞায় অবিচল। সত্যবতীর অনেক অনুরোধ উপরোধ তাঁকে চুলমাত্র টলাতে পারে না। রাজা শান্তনুর বংশ কি তবে নির্বংশ হবে? না, ভীষ্মও তা চান না। পুত্রশোকাতুরা উত্কণ্ঠিতা মাকে সান্ত্বনা দিলেন তিনি। বললেন, এমন নিদর্শন তো অতীতে রয়েছে, যখন ক্ষত্রিয় রমণীরা বংশ রক্ষার খাতিরে বেদ পারদর্শী ব্রাহ্মণের সঙ্গে মিলিত হয়ে সন্তান উত্পাদন করেছেন। সে তো সমাজের নিরিখে দোষের নয়, বিশেষত ক্ষেত্রজ পুত্র যখন সমাজে স্বীকৃত। আর ব্রাহ্মণ উচ্চবর্ণ, সুতরাং দোষের কোনও কারণও নেই। তবুও চিন্তাকুল সত্যবতী জানতে চান, কী সেই নিদর্শন? অন্তত, একটা উদাহরণ না শুনলে বুঝি তিনি মনে জোর পান না।
তখন ভীষ্ম তাঁকে বলা শুরু করেন। পিতার আদেশে পরশুরাম একুশবার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করেন। ক্ষত্রিয় পরিবারগুলো অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। তখন বংশের সন্তানকামী নারীরা সদ্বংশজাত ব্রাহ্মণের দ্বারা নিয়োগ প্রথায় সন্তান উত্পাদন করতেন। ভীষ্ম বলেন, এতে দোষের কিছু নেই, বরং এ শাস্ত্রসম্মত।
ভীষ্ম সত্যবতীর অনুরোধে আবার বলা শুরু করেন এক প্রাচীন ইতিহাস। প্রাচীনকালে উতথ্য নামের এক ঋষি ছিলেন। তাঁর পত্নী মমতা ছিলেন সন্তানসম্ভবা। উতথ্যের ছোট ভাই ছিলেন দেবপুরোহিত বৃহস্পতি। একদিন কামনার বশবর্তী হয়ে বৃহস্পতি উপস্থিত হন ভ্রাতৃজায়া মমতার কাছে। মমতা বারংবার তাঁকে বিরত করার চেষ্টা করলেও তিনি বিরত হলেন না। হ্যাঁ, ধর্ষণের সংস্কৃতি সেকালেও ছিল যথেষ্ট পরিমাণে। বৃহস্পতি দেবপুরোহিত, তায় আবার নিজের দেবর, তাঁকে বাধা দিতে পারলেন না দুর্বল মমতা। ক্ষীণকণ্ঠে অনুরোধ করলেন, আমার গর্ভস্থ শিশু গর্ভে থেকেই ষড়ঙ্গ বেদ অধ্যয়ন করেছে। এর ফলে তার ক্ষতি হতে পারে। এদিকে আপনিও অব্যর্থরেতা। দয়া করে এই সময় এমন আচরণ থেকে বিরত থাকুন। কামুক বৃহস্পতি সে কথা শুনলে তো! প্রতিবাদ করে উঠল গর্ভস্থ শিশু। তাতেও নিরস্ত হলেন না তিনি। মমতার গর্ভস্থিত ঋষিবালক বীর্যপাতের মুহূর্তে নিজের পা দু’খানি দিয়ে বীর্য প্রবেশের পথ আটকে রাখল। বীর্য প্রবেশের পথ না পেয়ে পড়ল মাটিতে। ক্রুদ্ধ হলেন বৃহস্পতি। অভিশাপ দিলেন, মমতার গর্ভস্থিত শিশুকে। নিজের কাম চরিতার্থ না হওয়ায় দেবপুরোহিত বৃহস্পতিও আচরণ করলেন প্রাকৃতজনের মতো। বৃহস্পতির অভিশাপে জন্মান্ধ হলেন দীর্ঘতমা। জন্মান্ধ দীর্ঘতমা বেদজ্ঞ পণ্ডিত হওয়ায় প্রদ্বেষীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। প্রদ্বেষী ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী। দীর্ঘতমার ঔরসে প্রদ্বেষী গৌতম সহ অন্যান্য পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। এই অবধি সব ঠিকঠাকই চলছিল। ছেলেরা বড় হতে লাগল, স্বামী অন্ধ, সংসার চালানো, সন্তানপালন ইত্যাদি সব কাজ ভালবেসেই পালন করতেন প্রদ্বেষী। গোল বাঁধল অন্য জায়গায়। দীর্ঘতমা পণ্ডিত, ধার্মিক, আবার বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। কিন্তু আদতে তো তিনি রক্তে মাংসে গড়া সাধারণ মানুষ। স্ত্রী-পুত্র, নিজের পরিবারের কথা ভুলে গেলেন। সুরভিপুত্রের কাছে গোধর্ম শিক্ষা করলেন। নিজের পরিচয়, বিদ্যাবত্তা সবকিছু ভুলে গিয়ে প্রকাশ্য মৈথুনে প্রবৃত্ত হলেন। স্বাভাবিক ভাবেই ক্রুদ্ধ হলেন প্রদ্বেষী, পুত্রেরাও প্রবল ক্ষুব্ধ হল। প্রদ্বেষী বললেন, “আপনি অন্ধ, তাই কিছুটা সহানুভূতি, কিছুটা বা দায়িত্বের খাতিরে এতকাল ছেলেদের সঙ্গে আপনারও ভরণপোষণ করে এসেছি। কিন্তু আর নয়, আর আমি এই দায়িত্ব পালন করতে নারাজ।” দীর্ঘতমার পৌরুষ জেগে উঠল যেন। যতই তিনি অসমর্থ হোন না কেন, নারীর কাছে কেন হার মানবেন? যত বড় অপরাধই তিনি করে থাকুন না কেন, কেনই বা অপরাধ স্বীকার করবেন তিনি? তাও একজন অবলা নারীর কাছে? তিনি বলে উঠলেন, “কোনও ক্ষত্রিয়ের বাড়ি নিয়ে চলো আমায়। সেখান থেকে যে ধন মিলবে, তাই দিয়ে আমাদের দিব্যি কেটে যাবে দিন।” প্রদ্বেষী আত্মমর্যাদা সম্পন্না নারী। তিনি ভিক্ষা চাইতে রাজি নন।
ক্রুদ্ধ পুরুষ নারীকে ভরণ করতে পারেন না, কিন্তু অভিশাপবাণী উচ্চারণে কোথাও গলাটা এতটুকুও কেঁপে উঠল না। তিনি বলে উঠলেন-
অদ্য প্রভৃতি মর্য্যাদা ময়া লোকে প্রতিষ্ঠিতা।
এক এব পতির্নার্য্যা যাবজ্জীবং পরায়ণম্।।
মৃতে জীবতি বা তস্মিন্ নাপরং প্রাপ্নুয়ান্নরম্।
অভিগম্য পরং নারী পতিষ্যতি ন সংশয়ঃ।।
অপতীনান্তু নারীণামদ্যপ্রভৃতি পাতকম্।
যদ্যস্তি চেদ্ধনং সর্ব্বং বৃথাভোগা ভবন্তু তাঃ।।
অকীর্ত্তিঃ পরিবাদাশ্চ নিত্যং তাসাং ভবন্তু বৈ।। (আদিপর্ব: ৯৮;৩৩-৩৫)
“আজ থেকে আমি জগতে স্ত্রীগণের জন্য এই নিয়ম প্রতিষ্ঠা করছি, যাবজ্জীবন পতিই একমাত্র অবলম্বন হবে তাদের। সে যদি বিধবাও হয়, তথাপি অন্য পুরুষসঙ্গ করলে পতিত হবে, পতির ধনে তাদের কোনও অধিকার থাকবে না। সমাজে তারা নিন্দিত হবে, আত্মীয়স্বজন তাদের ত্যাগ করবে।”
না, বিধানটা কোনো পুরুষের জন্য ছিল না। এক অন্যায়কে ঢাকা দেওয়ার জন্য, নিজের পৌরুষের প্রমাণ দিতে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিও এমন অভিশাপবাণী উচ্চারণ করতে পিছপা হলেন না। আবারও যেন প্রমাণ হয়ে গেল ঋষিরাও খুব সাধারণ মানুষ। একদিকে যেমন ছিল তাঁদের অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি, অন্যদিকে তাঁরাই আবার সাধারণজনোচিত আচরণে নিজেদেরই কোথাও ছোট করেছেন।
এরপর ক্রুদ্ধ পুত্ররা মায়ের আদেশে পিতাকে ভেলায় করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়। তাঁকে উদ্ধার করেন বলিরাজা। বলিরাজা নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর ইচ্ছায় রানী সুদেষ্ণার গর্ভে দীর্ঘতমার ঔরসে পাঁচ পুত্রের জন্ম হয়।
সে তো আর এক গল্প।
দীর্ঘতমার অভিশাপবাণী উচ্চারিত হয়েছিল সমগ্র নারীজাতির প্রতি। ভর্ত্তা তাঁকে ভরণ করছেন না, তাঁর কষ্টার্জিত অন্নে দিনযাপন করে নিন্দনীয় আচরণ করছেন। কিন্তু প্রদ্বেষী যখন সামান্য প্রতিবাদ করলেন, গর্জে উঠল পৌরুষ। কোপ নেমে এল সেই নারীকুলের ওপরেই। সেই নারীকুল, হারাল তার স্বাতন্ত্র্য, পছন্দ অপছন্দ প্রকাশ করবার অধিকার। সমাজের প্রয়োজনে, বংশ রক্ষার খাতিরে সে মেনে নিল অনেক অন্যায় অবিচার। খোঁজও রইল না তার, পুত্রার্থে পরের শয্যাসঙ্গিনী হতে সে কতবার চোখের জল ফেলেছে। যুগের পর যুগ এল গেল। কত দেশ, রাজ্যপাটের উত্থান পতন হল, কত না শাস্ত্রকার যুগের প্রয়োজনে নিত্য নতুন বিধান দিলেন, সমাজে তা বলবৎ হল, আবার কালের নিয়মে তাও পুরোনো হল নতুনের কাছে। কিন্তু নারীর স্বাতন্ত্র্য রয়েই গেল বড় প্রশ্ন চিহ্নের মুখে।
.....
লেখক বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজের সংস্কৃতের অধ্যাপক
একলা মায়ের গল্প আজকের ভারতে নতুন নয়। মহাভারতের বিদুলার গল্প এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়।
ঊর্বশী, স্বর্গের অপ্সরাশ্রেষ্ঠা...
কে তবে হরণ করে নিল নারীর স্বাতন্ত্র্য, পুরুষের মতো একই ভাবে বাঁচার অধিকার?
প্রাণপ্রিয় বোনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বঞ্চনায় বেছে নিলেন ধ্বংসের পথ, আত্মাহুতির পথ। যে পথে শান্তি নেই, লক