×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ঊর্বশী: নহ মাতা নহ কন্যা নহ বধূ সুন্দরী রূপসী

    অদিতি ভট্টাচার্য্য | 16-04-2020

    urvashi - the apsara by Raja Ravi Varma

    মহাভারতের মূল গল্প আবর্তিত হয়েছে কৌরব ও পাণ্ডব ভাইদের ঘিরে। তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, রাজ্যলাভ, যুদ্ধ এসবের পাশাপাশি আনাগোনা রয়েছে অন্যান্য অজস্র ছোট-বড় চরিত্রের। মুখ্যচরিত্রগুলোকে এরা পুষ্ট করেছে। গল্প এগিয়ে গেছে তার নিজস্ব গতিতে। আমি তেমনই একটা ‘ছোট’ চরিত্রের কথা বলব।

    মহাভারত বা রামায়ণে আমরা দেখি, দেবতাদের সাথে মানুষের যোগাযোগ অনেক সহজ। সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বশে কামনার অধীন হয়, দেবতাকে ডাকে, কঠোর তপস্যা করে। দেবতা তার ইচ্ছা পূর্ণ করেন। দেবতা কখনও মানুষের ঘরের লোকও বটে। তারই ফলে ইন্দ্র তাঁর পুত্র অর্জুনের কথা ভেবে কর্ণের কাছে কবচ কুণ্ডল চাইতে আসেন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে। অর্জুন যান স্বর্গে। ইন্দ্রের রাজসভায় সকল দেবতার সাথে বসে তাঁরও সৌভাগ্য ঘটে অপ্সরাদের অপার্থিব নাচ দেখবার।

    ঊর্বশী, স্বর্গের অপ্সরাশ্রেষ্ঠা। তাঁর নাচ দেখবার জন্য দেবতারা মুখিয়ে থাকেন। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের মনোরঞ্জন করেন তিনি।

    নিরুক্তে যাস্কমুনি ‘ঊর্বশী’ শব্দের অর্থ নানাভাবে দেখিয়েছেন। স্বর্গের অপ্সরা ঊর্বশী, মহাযশের অধিকারিণী। মহান কাম তার বশে। অন্যদিকে ‘অপ্সরা’ শব্দের অর্থ হ’ল, যে জলে থাকতে পছন্দ করে। এ তো গেল সাধারণ অর্থ। আর যদি এর বিশেষ অর্থ খুঁজতে চাই, তবে বলা যেতে পারে, অপ্সরাশব্দের অর্থ হল ব্যাপক যে রূপ। আবার অপ্সরা-র অর্থ অনন্যরূপসম্পন্নাও বটে। সুতরাং ব্যাপক যে রূপ, অতিবৃহৎ যে আনন্দ, তা-ই হ’ল ঊর্বশী। সুতরাং ঊর্বশীকে পাওয়ার মধ্যে অতিজাগতিক পরমানন্দ চাওয়া-পাওয়ার আনন্দও লুকিয়ে আছে।

    ঊর্বশী যেমন বেদের সূক্তের একটি চরিত্র, তেমনই ব্রাহ্মণসাহিত্য মহাভারত পুরাণ, মায় কালিদাস পর্যন্ত ঊর্বশীকে আপন করেছেন তাঁর ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নাটকে। কোনও এক সময় মর্ত্যের রাজা পুরুরবা স্বর্গের অপ্সরা ঊর্বশীর প্রেমে পড়েন। বিবাহ হয় তাঁদের। চারবছর তাঁরা একসাথে থাকেন। ঊর্বশী শর্তসাপেক্ষে মর্ত্যে বাস করতে রাজি হয়েছিলেন। পুরুরবা সেই শর্ত ভঙ্গ করায় ঊর্বশী ফিরে যান স্বর্গে। পরবর্তীকালে, সন্তানের জন্ম হলে ঊর্বশী তাঁকে পুরুরবার কাছে পাঠিয়ে দেন। সেই সঙ্গে শোকসন্তপ্ত পুরুরবার প্রতি বার্তা পাঠান, পুরুরবা যেন কর্তব্যে অবিচল থেকে রাজ্যপালন করেন, স্ত্রীলোকের শোকে বৃথা কালযাপন না করেন। পুরুরবা একদিন মৃত্যুজয়ী হবেন, স্বর্গে যাবেন ও সুখে কাটাবেন, ঋগ্বেদের সূক্তে এই কাহিনীটি পাওয়া যায়।

    এবার আসি মহাভারতের কথায়। অর্জুন, কুন্তীর শ্রেষ্ঠ সন্তান, পাণ্ডুপুত্র বলে তাঁর পরিচিতি হলেও আদতে তিনি ইন্দ্রের সন্তান। দেবরাজ ইন্দ্রের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে অর্জুনের জন্ম। সেই আমলে ক্ষেত্রজসন্তানকে বৈধ বলেই গণ্য করা হত। অন্যদিকে পাণ্ডুর সন্তান উত্পাদনের ক্ষমতা ছিল না। ফলে কুন্তী ও মাদ্রী দেবতাদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।

    আগেই যে কথাটা বলেছিলাম, দেবতাদের সাথে যোগাযোগ অনেক সহজ ছিল সেই যুগে। অর্জুনকে একদিন ডেকে পাঠালেন ইন্দ্র। সারথি মাতলি গেল তাঁকে আনতে। মাতলির সঙ্গে অর্জুন পৌঁছলেন স্বর্গে। সেখানে অপ্সরারা অপূর্বনৃত্যশৈলী দেখিয়ে অর্জুনের মনোরঞ্জন করলেন। দেবতা আর গন্ধর্বেরা তাঁকে স্বাগত জানালেন। অর্জুন ইন্দ্রের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করলেন। এরপর ইন্দ্রের আদেশে গন্ধর্ব চিত্রসেনের কাছে অর্জুন নৃত্যগীতাদি শিক্ষা করেন। এরপর কোনও একদিন যখন এইরকমই এক নাচগানের আসর বসেছিল, তখন দেবরাজ ইন্দ্রের চোখে পড়ে অর্জুনের মুগ্ধদৃষ্টি ঊর্বশীতে আবদ্ধ। ঊর্বশী অপ্সরাশ্রেষ্ঠা। স্বয়ং দেবতারা আকৃষ্ট যাঁর রূপে - নৃত্যশৈলীতে, সেখানে অর্জুন তো তুচ্ছ মানুষ। ইন্দ্র তা লক্ষ্য করে চিত্রসেনকে আদেশ করেন, ঊর্বশীকে যেন পাঠানো হয় অর্জুনের মনোরঞ্জনের জন্য। চিত্রসেন বলেন, স্বর্গের সেরা সুন্দরী ঊর্বশীর সঙ্গলাভ করলে অর্জুনেরও স্বর্গে আসা সার্থক হবে। এরপর ঊর্বশী অপরূপসাজে সজ্জিত হয়ে অর্জুনের বাসগৃহে যান। অর্জুন তাঁকে বসিয়ে গুরুপূজা করেন। তাতে অবাক হন ঊর্বশী। তিনি জানান, অর্জুনের মনোরঞ্জনের জন্যই তাঁর এখানে আসা। অর্জুনের মতো বীরের প্রতি নিজের মুগ্ধতাও প্রকাশ করেন ঊর্বশী। এতে অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে অর্জুন বলেন, আপনি আমার গুরুরও অধিক, আমার পূজনীয়া, পুরুবংশের জননী।

    বেদের যে গল্পটা আগে উল্লেখ করেছি, এখানে রয়েছে তারই প্রসঙ্গ। পুরুরবা, মনুর পৌত্র। আর অর্জুন হলেন পুরুরবার পুত্র পুরু থেকে সাঁইত্রিশতম পুরুষ। ঊর্বশী সেই হিসেবে অর্জুনের গুরু জননীস্বরূপিণী হবেন। ঊর্বশী অর্জুনের কথার উত্তরে বলছেন- পুরুবংশের যে যে পুত্ররা স্বর্গে এসেছেন নিজ নিজ তপোবলে, তাঁরা সকলে আমাদের সঙ্গসুখ লাভ করেছেন। সুতরাং অর্জুনের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হবে না, এটাই স্বাভাবিক। ঊর্বশী অপ্সরা, তাই সর্বপুরুষভোগ্যাও বটে।  অর্জুন ঊর্বশীর প্রস্তাব মেনে না নেওয়ায় ঊর্বশী তাঁকে অভিশাপ দেন।

    গল্পটা তো মোটামুটি এরকম। এখন, যেটা খটকা লাগতে পারে, পুরুরবা যে ঊর্বশীকে বিয়ে করেছিলেন, সেই ঊর্বশী কিভাবে তাঁর পূর্ণরূপযৌবন নিয়ে পুরুরবার উত্তরবর্ত্তী আটত্রিশতম পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য উপস্থিত হতে পারেন?

    মহাভারতের গল্প সুত বা চারণেরা বলে বেড়াত, রাজসভায় বা অন্য কোনও বিশেষ জনসমাগমে। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি রয়েছে গল্পশোনার প্রতি। কথাতেই রয়েছে, গল্পের গরু গাছে ওঠে। ফলে কথায় কথায় গল্পে গল্পে মূল ঘটনাতেও অনেক রঙ লাগত। বদলে যেত কাহিনীগুলো। আবার অনেক সময় অনেক জটিলকথা সরলকরেও পেশ করা হত সকলের কাছে, যাতে সেটা সকলের গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।

    বলা হয়, যার সাথে দুঃখের কোনও সম্পর্ক নেই, পরম অনন্ত সুখ যা তা-ই স্বর্গ। আগেই ব্যাখ্যা করেছিলাম, ঊর্বশী শব্দের অর্থ অতিজাগতিক পরম আনন্দ, জাগতিক চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে যে আনন্দ। এমন সুখ, এমন আনন্দ তো সকলেরই চাওয়ার।

    তবে কি ঊর্বশী সেই পরমসুখের প্রকাশ যা সকলের কাম্য? সেই অনন্ত সুখ, যা লাভ করলে স্বর্গলাভের ফল মেলে? সেই সুখ যাকে দেবতারা কত না রাজরাজড়ারা, পুরুরবা থেকে শুরু করে অর্জুন অবধি আটত্রিশ পুরুষ ধরে সকলে চেয়ে এসেছেন, খুঁজে ফিরেছেন? স্বর্গ তো সকলেই চায়। স্বর্গলাভের জন্য, অক্ষয় অনন্ত স্বর্গবাসের জন্য চলে কত যজ্ঞ কত আয়োজন। এই কি সেই স্বর্গসুখ? ঊর্বশী কি সেই মানসী যাকে নিয়ে এত আলোচনা? সেই বেদের আমল থেকে রবীন্দ্রনাথ অবধি! ঐতিহাসিকেরা বলেন পুরুরবা হলেন সূর্য আর ঊর্বশী ঊষা। সূর্য আর ঊষার তো কখনও মিলন হতে পারে না।

    এ তো গেল বেদ-মন্ত্রের ব্যাখ্যা। আর মহাভারতেও ঊর্বশী রয়েছেন তাঁর স্বমহিমায়। কারণ সুখের আকাঙ্ক্ষা তো মেটে না। যুগে যুগে তার দাবি একইরকম। চেষ্টা চলে যার যার মতো করে তাকে হাসিল করার। রবীন্দ্রনাথ ঊর্বশীর ভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-কে লিখেছেন-

    ...সে যেন চিরযৌবনের রূপের অমৃত তার সাথে কল্যাণ মিশ্রিত নেই। সে অবিমিশ্র মাধুর্য।

     

    লেখক বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজের সংস্কৃতের অধ্যাপক     


    অদিতি ভট্টাচার্য্য - এর অন্যান্য লেখা


    কে তবে হরণ করে নিল নারীর স্বাতন্ত্র্য, পুরুষের মতো একই ভাবে বাঁচার অধিকার?

    ঊর্বশী, স্বর্গের অপ্সরাশ্রেষ্ঠা...

    প্রাণপ্রিয় বোনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বঞ্চনায় বেছে নিলেন ধ্বংসের পথ, আত্মাহুতির পথ। যে পথে শান্তি নেই, লক

    একলা মায়ের গল্প আজকের ভারতে নতুন নয়। মহাভারতের বিদুলার গল্প এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়।

    ঊর্বশী: নহ মাতা নহ কন্যা নহ বধূ সুন্দরী রূপসী-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested