কোথা গো মেরে রয়েছ তলে/ হরিচরণ, কোন গরতে?
ছোটবেলায় অনেকেই অনেক ‘নিষিদ্ধ’ কাজ করে থাকে। আমিও করেছি। আমার উল্লেখযোগ্য নিষিদ্ধ কাজটা ছিল বাড়ির বইয়ের তাক থেকে খুঁজে বের করা ‘বড়দের’ পাঠ্য বইগুলো এবং সেগুলো সন্তর্পণে নিঃশেষ করা। ক্লাস থ্রি-ফোর, সে বয়সে সিলেবাসের বইয়ের বাইরে আমায় পড়তে দেওয়া হত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিশুপাঠ্য ছড়া, গল্প, কমিকস্; তাতে আমার কোনও খেদ ছিল না, খুশি হতাম... কিন্তু ‘আঁতে ঘা’ লাগত খুব। বড়দের রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, তারাশঙ্কর, গোর্কি, টলস্টয়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জীবনানন্দ, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়... আমায় কেন কেউ সেধে পড়তে দেয় না! মনে আছে, ওই বয়সেই একবার এক অনুষ্ঠানে ‘ক’ বিভাগের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি, কিন্তু আমার শর্ত ছিল বড় দাদা-দিদিদের ‘গ’ বিভাগেই আমায় জায়গা করে দিতে হবে, নইলে আমার মূল্যবান পাঠ কেউ শুনতে পারবে না। শেষে আমার বেলাগাম কান্নাকাটিতে বিশেষভাবে আমায় সুযোগ করে দেওয়া হয়। আমি সেদিন গদগদ হয়ে আবৃত্তি করেছিলাম জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’। “সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে, আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা? আমার পথেই শুধু বাধা?...আলো-অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে…।”
আমার ‘পাকামি’ শুনে সকলে যখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন বিচারকমণ্ডলীর একজন আমায় কাছে ডেকে, মাথায় হাত রেখে খুব হেসে বলেছিলেন, আচ্ছা ঐ যে লাইনটা তুমি বললে, আমার পথেই শুধু ‘বাঁধা’ (ধাঁধার সঙ্গে মিলিয়ে বাঁধা বলে ফেলেছিলাম), ওটা কিন্তু ‘বাধা’ হবে, অর্থাৎ নিষেধ/ব্যাঘাত। শব্দের মারপ্যাঁচ তখনও বুঝতে শিখিনি। সেই ঘটনার পর মা আমার হাতে একটা ‘Magical’ বই তুলে দিয়েছিল, নাম- হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’।
মাতৃভাষার স্বাদান্বেষণে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ সেদিন থেকে আমার কাছে ‘জিন’ (আশ্চর্য প্রদীপের), যা চাইব তাই পাব। যত সহজে আমি এই কথাটা লিখে দিলাম, ততটা সহজ ছিল না বাংলাভাষার এই অমূল্য রত্নটি আবিষ্কার করা। শব্দ-কারিগর হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিষ্ঠায় বাংলা ভাষার এই শব্দকোষ গড়ে তুলতে ব্যয় করেছিলেন তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়, প্রায় 40 বছর! তাঁকে এ যাবৎ খুব কাছাকাছি রাখা হয়, এমনটা হয়তো কখনওই আর বলা যাবে না। তাঁর বহু যত্নে গড়া ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর প্রয়োজন এখন ‘লিমিটেড’। তিনিও স্মরণাতীত। তবে তাঁর ‘লিমিটেড’ অনুগামীদের মধ্যে যাঁরা পড়েন, তাঁরা হয়তো এখনও মনে রাখেন তাঁকে, তাঁর জন্মদিন।
1867 সালে উত্তর চব্বিশ পরগনার যশাইকাটিতে মায়ের পৈতৃক ভিটেতে 23 জুন জন্ম তাঁর। বাবা নিবারণচন্দ্র। মা জগৎমোহিনী দেবী। প্রাথমিক পড়াশোনা মামার বাড়িতেই। স্কুলে ভর্তি হওয়ার টাকা নেই। বেতন দেওয়ার টাকা নেই। কোনওক্রমে স্কুল শেষ করে বিএ তৃতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই আর্থিক অনটনে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। আগাগোড়া অভাব-সঙ্কটের ভিতর বেড়ে ওঠা যাকে বলে। অথচ সেই তিনিই পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষার মতো মহৎ কিছুর পৃষ্ঠপোষক, শব্দ অনুসন্ধানী, ভাষার চিকিৎসক, পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব।
কর্মসূত্রে জীবনের অনেকটা কাটিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। সেখানে প্রায় বছর তিনেক শিক্ষকতা করা হয়ে গিয়েছে, ঠিক সেই সময়েই একদিন হরিচরণের কাছে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ব-ইচ্ছা জানালেন।
জানালেন- “আমাদের বাংলা ভাষায় কোনও অভিধান নেই, তোমাকে একখানি অভিধান লিখতে হবে।”
রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধে তিনি অতি উদ্যমে শুরু করে দেন শব্দ-অর্থ সন্ধানের কাজ। রবীন্দ্রনাথও তাঁর নিষ্ঠা দেখে খুশি হয়ে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিপাঠীকে লেখেন, “এ গ্রন্থখানি রচিত ও প্রকাশিত হইলে দেশের একটি মহৎ অভাব দূর হইবে।”
তবে অর্থকষ্ট তাঁর পিছু না ছাড়ায় তাঁকে অভিধানের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে আশ্রম ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। সেই সময় খুব আর্থিক টানাপোড়েন চলছিল শান্তিনিকেতনে। বাধ্য হয়েই ছেড়েছিলেন আশ্রম। তারপর ক্ষুদিরাম বসুর সাহায্যে একটা চাকরি জোটালেন। সেন্ট্রাল কলেজে সংস্কৃত পড়ানোর চাকরি। পড়ানোর চাকরি করছেন, অথচ মনপ্রাণ সবই তাঁর গুরুদেবের সেই ইচ্ছাপূরণেই পড়ে আছে। মানসিক কশাঘাতে একদিন গিয়ে পৌঁছলেন জোড়াসাঁকোয়, সবটা বললেন রবীন্দ্রনাথকে।
রবীন্দ্রনাথ সবটা মন দিয়ে শুনে তাঁর হিল্লে করে দেন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর কাছে। হরিচরণ মাসিক পঞ্চাশ টাকা বৃত্তি পেতে শুরু করেন মহারাজার তরফে। বেহাল অবস্থায় খানিক স্থিতি আসে। বৃত্তি পেয়ে তিনি সেই যে কলকাতা ছেড়েছিলেন, 1959 সাল অবধি আমৃত্যু শান্তিনিকেতনেই থেকে গিয়েছিলেন। যেটুকু অর্থ সঞ্চয়ে রাখতে পেরেছিলেন তার সবটাই দিয়ে দিয়েছিলেন অভিধান প্রকাশের কাজে। ‘বিশ্বকোষ’-এর নগেন্দ্রনাথ বসু নিয়েছিলেন বই প্রকাশের দায়িত্ব। একে একে তেরো বছর ধরে মোট একশ’ পাঁচটি খণ্ডে প্রকাশ পায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। তা উৎসর্গিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রতি।
বিশ্বভারতী অভিধান বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়। অর্থ সাহায্য আসে রথীন ঠাকুর, নাড়াজোলার মহারাজা, আশ্রমিক সঙ্ঘ, বিশ্বভারতী সংসদ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। প্রশংসা আসে মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে। গান্ধী তাঁর ‘হরিজন’ পত্রিকায় হরিচরণকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিলবার্ট মারের সঙ্গে তুলনা করেন। হরিচরণের মৃত্যুর পর দু’টি খণ্ডে গোটা অভিধানটি প্রকাশ করে সাহিত্য অ্যাকাডেমি।
শুধুমাত্র বঙ্গীয় শব্দকোষই নয়, হরিচরণ রবীন্দ্রনাথকে গুরুদক্ষিণায় দিয়েছিলেন নিজের দু’টি চোখও। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে তাঁকে বলতে শোনা যেত, ‘‘গুরুদেবের নির্দিষ্ট কাজে চোখ দু’টো উৎসর্গ করতে পেরেছি, এটাই পরম সান্ত্বনা।’’
অভিধান নিয়ে তাঁর প্রজ্ঞা সম্বন্ধে সুরঞ্জন ঘোষের একটি লেখায় বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে—
‘‘প্রতিদিন সান্ধ্য আহ্নিক সেরে লন্ঠনের আলোয় কুয়োর ধারে খড়ের চালাঘরে পশ্চিম জানলার কাছে হরিবাবু কাজ করতেন। সুনীতিকুমারের স্মৃতিতেও এই ‘ক্ষীণপ্রায় ব্রাহ্মণ’-এর ছবিটা প্রায় একই রকম। সুনীতিবাবু যখনই হরিচরণের বাড়ি যেতেন, তখনই দেখতেন তক্তপোষের উপর ডাঁই করে রাখা উর্দু, পার্সি, ইংরেজি, ওড়িয়া, মারাঠি-সহ বিভিন্ন ভাষার অভিধান ছড়ানো রয়েছে। দ্বিজেন ঠাকুর তো ছড়াই বেধে ফেলেছিলেন, ‘‘কোথা গো মেরে রয়েছ তলে/ হরিচরণ, কোন গরতে?/ বুঝেছি, শব্দ-অবধি-জলে/ মুঠাচ্ছ খুব অরথে।।’’
হরিচরণের শব্দ-শব্দার্থ আগ্রহের বিষয়টি প্রথম ধরা পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের কাছেই। শিক্ষিত-সংস্কৃতজ্ঞ হরিচরণ ছিলেন ঠাকুর পরিবারের পতিসরের জমিদারির সেরেস্তা। একদিন জমিদারির কাজকর্ম দেখতে এসে রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন হরিচরণ দিনে সেরেস্তার কাজ করলেও সন্ধের পর থেকে তাঁর কাজের পরিসর যেত পাল্টে। সন্ধ্যার পর চলত সংস্কৃত আলোচনা, বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখে প্রেসের কপি-পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা। সেইসব পাণ্ডুলিপি নিরীক্ষণ করেই হরিচরণের গূঢ় রহস্য ভেদ করে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, জগদানন্দ রায় এবং অবশ্যই ঠাকুর পরিবারের দিকপালদের সঙ্গে একই সারিতে রবীন্দ্রনাথ হরিচরণকে ঠাঁই দিয়েছিলেন অধ্যাপক হিসেবে। তাঁর রচিত বেশ কিছু গ্রন্থ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য ও মূল্যবান। ‘কবির কথা’; অনূদিত গ্রন্থ ম্যাথু আর্নল্ডের ‘সোরাব রোস্তম’ এবং ‘বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র’, ‘কবিকথা মঞ্জুষা’; ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থ ‘সংস্কৃত প্রবেশ’, ‘পালি প্রবেশ’, ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’, ‘হিন্টস অন সংস্কৃট ট্রান্সশ্লেষন অ্যান্ড কম্পোজিশন’ ইত্যাদি। অনূদিত গ্রন্থগুলো অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন ‘দেশিকোত্তম’, বিশ্বভারতীর ডি–লিট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, শিশিরকুমার স্মৃতি পুরস্কার প্রভৃতি।
প্রজন্মের কোনও এক শিক্ষার তাক-এ এখনও কি রয়ে গিয়েছেন সেই ‘হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়’ ও তাঁর 40 বছরের সাধনা?
রামকিঙ্কর লকডাউন দেখে যাননি। তিনি দেখে গিয়েছেন বিশ্বযুদ্ধ, দুঃখ, দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, খরা।
এমন নারী কন্ঠ, এমন দাপুটে, এমন পা ঠুকে অভিনয় করা
আমি তাকিয়ে আছি ভারতের অভিমুখে– শুধু ভারতের দিকে
ধ্বংস ও ধসের সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ
শুধুই ‘জনপ্রিয়’ রবীন্দ্রনাথ নয়, এ সময়ে উঠে আসুক প্রাসঙ্গিক অথচ উপেক্ষিত যে রবীন্দ্রনাথ।