দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এক কথায় প্রায় নজিরবিহীন। দেশজুড়ে এখন নাগরিকত্ব আইন বা সি এ এ, এন আর সি এবং এন পি আর এর প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। সংসদে সংখ্যাধিক্যের জোরে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহেরা নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস করিয়ে নেওয়ার পর থেকেই লড়াইটা একটা নতুন মাত্রা পেয়ে গিয়েছে। এখন আর লড়াইটা পরিচিত রাজনীতির অঙ্গনে সীমিত নেই। বরং বিরোধীদলগুলিকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে নেমেছে দেশের সাধারণ মানুষ।
কারা এই সাধারণ মানুষ? তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য কোন দিকে? তারা সমাজের কোন শ্রেণির অংশ? এক কথায় এ সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অসম্ভব। তবে বলা যায়, এরা প্রচলিত রাজনৈতিক আঙ্গিনায় ঘোরাফেরা করা মানুষজন নন। এঁদের মধ্যে ছাত্রছাত্রী রয়েছেন, যুবকযুবতীরা রয়েছেন, বিপুল সংখ্যায় মহিলারা রয়েছেন। আবার, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুটি কয়েক ব্যতিক্রমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা মনে রেখেও বলা যায়, এবার দেশের প্রথম শ্রেণীর বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাসংস্থার ছাত্র-শিক্ষক রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছেন, যাদের আগে কখনও রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দেখা যায় নি। তাদের মধ্যে নাম করা যায় মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ ( টি আই এফ আর) এবং টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশাল সায়েন্সেস (টি আই এস এস), বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স, এলাহাবাদের হরিশ্চন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতো নামী প্রতিষ্ঠানের। এমনকি যে আই আই টি এবং আই আই এম এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলিতে দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে যোগ দিয়ে পড়াশোনায় ডুবে থেকে নিজেদের মহার্ঘ কেরিয়ার গড়ে তোলার জন্য প্রাণপাত করে, সেখানেও ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকসমাজ একসঙ্গে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন।
দিল্লির নামী কলেজ সেন্ট স্টিফেন্সেরও একই চিত্র। সেই ১৯৯০ সালে মন্ডল কমিশনের রায় মেনে সরকার নতুন সংরক্ষণ নীতি নিলে তার প্রতিবাদে দিল্লি সহ উত্তরভারতে যে ব্যাপক ছাত্রবিক্ষোভ হয়, তাতে সেন্ট স্টিফেন্সের পড়ুয়ারাও যোগ দিয়েছিল। তারপরের ৩০ বছরে তাদের দেশের রাজনীতি নিয়ে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। এবার কিন্তু তারাও পথে নেমেছে। দেশের প্রায় ২০০০ বিজ্ঞানী ও গবেষক একযোগে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। দেশের ১২২ জন প্রাক্তন আমলা (এঁদের মধ্যে আই এ এস, আই এফ এস এবং আই পি এস, সবাই রয়েছেন) একযোগে নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে সোচ্চার। পাশাপাশি, দেশের শিল্পীসাহিত্যিকদের মধ্যেও এ নিয়ে প্রবল আলোড়ন চলছে।
দিল্লির শাহিনবাগে যে কয়েক হাজার মহিলা শীত, বৃষ্টি উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে রাতের পর রাত ধরনায় বসেছেন, কলকাতায় তাদের সমর্থনে পার্কসার্কাসে যে মহিলারা খোলা আকাশের নিচে বসে রয়েছেন, এদের পাশে কোনও পরিচিত রাজনৈতিক দল নেই। এদের অনেকেই এই প্রথম রাজনৈতিক প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছেন। যে ছাত্রছাত্রী, এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষরা বিজেপি শাসিত রাজ্যে প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছেন, তাদের পুলিশের লাঠি, গুলি এবং বিজেপি-র সশস্ত্র বাহিনীর হামলার মুখে পড়তে হচ্ছে। যেমনটি হচ্ছে যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে, কর্নাটকে এবং দিল্লিতে (দিল্লিতে সরকার আপ দলের হলেও বিশেষ আইনের বলে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব কেন্দ্রের হাতে, তাই দিল্লির পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অধীন)। এদের অধিকাংশই এতদিন রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেন। বলা যেতে পারে যে এরা দেশের সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি, যাঁরা নিত্যদিনের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের অংশ নেওয়ার বদলে নিজেদের পরিচিত কাজের পরিসরেই থাকতে ভালোবাসেন।
এই সব ছাত্রছাত্রী, যুবসমাজ, মহিলারা, বিজ্ঞানী, গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী সহ সমাজের নানা স্তরের মানুষ, যারা এক কথায় অ-রাজনৈতিক শ্রেণির সদস্য হয়েও প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, তার কারণ একটাই। তাঁদের প্রতিবাদ নিছক রাজনৈতিক কর্মকান্ড নয়। তাঁরা মোটেই রাজনীতি করতে রাস্তায় নামেননি, তাঁরা এসেছেন ভারত নামক দেশটিকে বাঁচাতে। যে উদারনীতি ও পরমতসহিষ্ণুতার উপর ভিত্তি করে ভারতীয় সংবিধান তৈরি হয়েছিল, এই অ-রাজনৈতিক জনগণ সেই সংবিধানকে নয়াহিন্দুত্ববাদীদের হাত থেকে উদ্ধার করে পুনরায় তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে রাস্তায় নেমেছেন। তাই তাদের হাতে কোনও দলীয় রাজনৈতিক দলের পতাকা নেই, রয়েছে জাতীয় পতাকা। পতাকা প্রত্যাখ্যানের মধ্যে শুধুই রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা, বীতরাগকে দেখতে আবার বিষয়টিকে লঘু করে ফেলা হবে। কোনও কেন্দ্রীয় কমান্ড ব্যবস্থা বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়াই দেশের এই প্রতিবাদী মানুষজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বার্তাটা দিতে পেরেছেন যে বর্তমান পরিস্থিতি কোনও আর পাঁচটা রাজনৈতিক লড়াই নয়, এটা আরও আরও অনেক বড়, এমনকী দেশের অস্তিত্ব ও তার উদারবাদী চরিত্রকে রক্ষার লড়াই। তাই, এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে লড়াই করাটাই যথেষ্ট নয়, দরকার আরও বৃহত্তর জোট। যে জোটে দেশের সব ধর্মের সব ভাষার, সব অঞ্চলের মানুষকে একজোট হতে হবে। তাই মানুষের এই প্রতিরোধ আন্দোলন দৃশ্যত অ-রাজনৈতিক। রাজনৈতিক দলগুলিও ব্যাপারটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছে। তাই তারাও অনেকেই এখন তাদের দলীয় পতাকা ছাড়াই রাস্তায় নামছে। চেষ্টা করছে, ভারতীয় জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে গুটি গুটি পা মেলাতে।
(চলবে)
চাষি তার ইচ্ছা মতো উৎপন্ন পণ্যের বিপণনের অধিকার পাবে কি? মনে হয় না।
দলের ভিতরকার সমালোচনা ও বিরোধী স্বরকে গুরুত্ব দিতে হবে বামপন্থার নতুন দিশার সন্ধানে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি বাহিনীর ইহুদি গণহত্যা শুরু হয়েছিল ইউক্রেনের এই বাবি ইয়ারেই!
CAA-এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন আর পাঁচটা রাজনৈতিক আন্দোলনের মত নয়। এই লড়াই সংবিধান বাঁচানোর লড়াই
80 কোটি দেশবাসীকে তিন মাসের রেশন বিনা পয়সায় দিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
করোনা মহামারীর সুবাদে ভারতের শহর ও গ্রামের মানুষ নতুন আর একটা কথার সঙ্গে পরিচিত হল - লক ডাউন।