×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ইউক্রেনে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি

    প্রণয় শর্মা | 28-04-2022

    এ বার কি তবে পরমাণু যুদ্ধ?

    দু'মাসের বেশি হয়ে গেল রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ (Sergey Lavrov)-এর ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী সত্যিই যদি এই যুদ্ধ ক্রমশ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করার দিকে এগিয়ে যায়, তা হলে পরিস্থিতি সত্যিই ভয়ঙ্কর হতে পারে। রুশ বিদেশমন্ত্রীর তরফে এইরকম আশঙ্কার পিছনে রয়েছে ক’দিন আগে তাঁরই জারি করা সতর্কবানী— ন্যাটো (North Atlantic Treaty Organisation বা সংক্ষেপে NATO) যুদ্ধজোট যে ভাবে আড়ালে থেকে ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে চলেছে, তা আদতে মস্কোর বিরুদ্ধে ন্যাটোর ছায়াযুদ্ধ চালানো ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা চলতে থাকলে শেষে এই যুদ্ধ পরমাণু যুদ্ধে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

     

    গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে যখন রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করে, তখন অন্য অনেক দেশের মতোই ভারতও ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত হয়েছিল। এখন যুদ্ধ যত গড়াচ্ছে, ততই তার ধাক্কাটা ইউরোপের সীমানা ছাড়িয়ে বহু দূরদূরান্তের দেশেও পড়তে শুরু করেছে।

     

    লাভরভের হুঁশিয়ারির প্রেক্ষিতটা মাথায় রাখলেই এটা বোঝা যাবে যে, ভারত সহ বিশ্বের বহু দেশেরই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মার্কিন বিদেশমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন (Secretary of State Anthony Blinken) এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন (Defence Secretary Lloyd Austin) সম্প্রতি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে গিয়ে সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতৃমণ্ডলীর সঙ্গে দেখা করে তাঁদের আরও অনেক সামরিক সাহায্য পাঠানোর আশ্বাস দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রুশ বিদেশমন্ত্রী লাভরভ ওই হুঁশিয়ারিটি দেন। মার্কিন প্রতিক্ষামন্ত্রী অস্টিন তো আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন যে, আমেরিকা রাশিয়াকে ‘দুর্বল’ হতে দেখতে আগ্রহী। এ জন্য রাশিয়াকে যুদ্ধে হারাতে আমেরিকা ইউক্রেনকে সমরাস্ত্রে সজ্জিত করে যাবে।

     

    ইউক্রেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দুই শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তি বৈঠক করে ফিরে আসার পরেই আমেরিকা 40টি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে আয়োজন করে। সেই বৈঠক থেকে ইউক্রেনকে আরও অস্ত্র সরবরাহের জন্য বিভিন্ন দেশকে উৎসাহিত করা হয়। লক্ষ্যণীয়, যে জার্মানি এতদিন যুদ্ধ টেনে নিয়ে চলার পক্ষে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিল না, তারাও ইউক্রেনে 40টি অত্যাধুনিক ট্যাঙ্ক পাঠাতে সম্মতি দিয়েছে।

     

    লাভরভ মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, পশ্চিমি দুনিয়া ইউক্রেনকে যে সব অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র দিচ্ছে, তাতে যুদ্ধ সহজে থামবে না, প্রলম্বিত হবে। এই অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রগুলির মধ্যে তিনি বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন ‘জ্যাভলিন’ নামের ট্যাঙ্ক ধ্বংস করার ক্ষেপণাস্ত্র, সাঁজোয়া গাড়ি এবং বিশেষ ধরনের ড্রোনের। লাভরভের বক্তব্য, এই সব সামরিক অস্ত্র পাঠিয়ে পশ্চিমি দুনিয়া যুদ্ধ বন্ধ করার বদলে শুধুই যুদ্ধটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। রুশ বিদেশমন্ত্রী লাভরভের হুঁশিয়ারি, ‘‘রাশিয়া এখন এই সব সমরাস্ত্রর যদি পাল্টা আঘাত হানে, তা ইউক্রেনে রাশিয়া যে বিশেষ সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে আক্রমণের বৈধ লক্ষ্যবস্তু বলেই স্বীকার করতে হবে।''

     

    আরও পড়ুন: ইউরোপকে কেন্দ্র করে কি আমেরিকা রাশিয়া সংঘাত?

     

    রাশিয়ার কাছে এখন অন্তত 5977টি পরমাণু বোমা আছে বলে অনুমান করা হয়। যা কিনা বিশ্বের বৃহত্তম পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার। দ্বিতীয় স্থানে আমেরিকা, তার কাছে আছে 5428টি। এছাড়া আমেরিকার 1644 এবং রাশিয়ার 1588টি ক্ষেপণাস্ত্র (যা পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম) যে কোনও সময় নিক্ষেপ করার জন্য সবসময় প্রস্তুত। ভিন্ন পরিস্থিতি (ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় হলে) হলে মার্কিন প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের চোখ রাঙানোর পাল্টা হিসাবে রুশ বিদেশমন্ত্রীর হুমকিকে রাজনৈতিক লড়াইয়ের অঙ্গ বা বাগাড়ন্বর হিসাবেই দেখা যেতে পারত। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাড়তে বাড়তে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে, জো বাইডেন ও ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে সুর নরম করা উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে পড়ছে। নিজের নিজের দেশের নিজস্ব রাজনীতির বাধ্যবাধকতা এখন এতটাই বেশি যে, ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে বড় মাপের সাফল্যের ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরতে না পারলে বাইডেন এবং পুতিনের নেতৃত্বদানের ক্ষমতা নিয়েই তাঁদের দেশে প্রশ্ন উঠতে শুরু করবে। পুতিন 2000 সাল থেকেই হয় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, বা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় রয়েছেন। 2024 সালে তাঁকে নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে, যা তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারকে বড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করাতে পারে।

     

    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউক্রেন যতটা বিদেশ সংক্রান্ত সমস্যা, তার চাইতে অনেক বেশি অভ্যন্তরীণ ইস্যু। এই সমস্যার সূত্রপাত ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকার সময়েই। তখন ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে জানিয়ে দেন যে, মার্কিন সামরিক ও অন্যান্য সাহায্য পেতে হলে জো বাইডেনের পুত্র হান্টার বাইডেনের ইউক্রেনে ব্যবসা সংক্রান্ত ‘দুর্নীতি’র তদন্ত করে তাঁর হাতে তথ্য তুলে দিতে হবে। বলাই বাহুল্য, জো বাইডেন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রাট দলের ঘোষিত প্রার্থী। এটা ফাঁস হয়ে যেতেই ডেমোক্রাটরা মার্কিন কংগ্রেসে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট (impeachment) প্রস্তাব আনেন (ইমপিচমেন্ট হল সাংবিধানিক পদে নির্বাচিত বা মনোনীত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করে বিচারের প্রক্রিয়া)। যদি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব মার্কিন কংগ্রেসে পাস হত, তাহলে তিনি আর দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতেই পারতেন না। কিন্তু ট্রাম্প নির্বাচনে দাঁড়ান ও বাইডেনের কাছে হেরে যান।

     

    নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই কিন্তু দেশের মানুষের কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। এখন তো বলা হচ্ছে, এই বছরের নভেম্বরে আসন্ন নির্বাচনে (মার্কিন দেশে প্রতি দুই বছর অন্তর মার্কিন কংগ্রেসের দুই কক্ষ সেনেট ও হাউজ অব রিপ্রেসেন্টেটিভস-এর এক তৃতীয়াংশ আসনে ভোট হয়, আর প্রতি চার বছর অন্তর মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাচন হয়) মার্কিন সেনেটে ডেমোক্রাটদের পিছনে ফেলে রিপাবলিকানরা (ট্রাম্পের দল) সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাবে। এমনিতেই মার্কিন সেনেটে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তার পরে যদি হাউজ অব রিপ্রেসেন্টেটিভসেও ডেমোক্রাটদের পিছনে ফেলে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়, তাহলে বাইডেন প্রশাসন একেবারে ঠুঁটো সরকারে পরিণত হবে। এইরকম একটা পরিস্থিতি হলে তখন পরবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্পের জয় ও আবারও প্রেসিডেন্ট হওয়া রোখা কঠিন হবে।

     

    ট্রাম্পের আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনাটা ডেমোক্রাট ও লিবারালদের কাছে একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো। তবে ট্রাম্প আবারও হোয়াইট হাউসে ফিরে আসলে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ থামিয়ে শান্তিপ্রক্রিয়া গতি পেতে পারে। আর সেই সম্ভাবনা মাথায় রেখে আমেরিকার সমরাস্ত্র উৎপাদন শিল্প (military-industrial complex) ইতিমধ্যেই বেশ বিচলিত। আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী এই লবির কাছে বিশ্বের কোথাও যুদ্ধ চলা মানেই অনেক বেশি করে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করার সুযোগ। বহুদিন ধরেই রাশিয়ার জুজু দেখিয়ে তারা আমেরিকা ও ইউরোপে ফলাও করে যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবসা করে চলেছে।

     

    বিভেদ ভুলে শান্তি আলোচনায় বসতে রাজি হবে রাশিয়া ইউক্রেন?

     

    ইউক্রেন যুদ্ধ এই সব গোষ্ঠীকেই বাইডেনের পাশে এনে দাঁড় করিয়েছে। এদের নিজের পাশে ধরে রাখতে বাইডেনকেও একজন দৃঢ়চেতা নেতা হিসাবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকার নেতৃত্বে তৈরি সামরিক জোট ন্যাটো (NATO) তৈরিই হয়েছিল প্রধানত পশ্চিম ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অবসানের মধ্য দিয়ে ঠাণ্ডা যুদ্ধ শেষ হলে পরে ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছিল। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় আমেরিকার পক্ষে ন্যাটোকে নতুন করে অক্সিজেন জোগানোর সুযোগ এসেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ন্যাটোর সব সদস্যকে জোটবদ্ধ হওয়ার সুযোগ এনে দেওয়ার সঙ্গেই আমেরিকাকে দূরে রেখে ইউরোপের নিজস্ব সামরিক জোট তৈরির যে চিন্তা ক্রমশ দানা বাঁধছিল, আপাতত সেটাও ধামাচাপা পড়ে গেল। ভারত ও চিন, দু’টি দেশই রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মিত্র। আবার এশিয়ার এই দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত বৈরীসুলভ। এই দুই দেশের পক্ষেও ইউক্রেনের যুদ্ধ খুবই খারাপ সময়ে শুরু হয়েছে।

     

    কোভিড মহামারীর ধাক্কায় টানা দুই বছর ধরে অর্থনীতি মার খাওয়ার পর সবে ভারত উঠে দাঁড়িয়ে অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করার কথা ভাবতে শুরু করেছে। এই সময় ইউক্রেনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে টানাপড়েন সব হিসেব তছনছ করে দিচ্ছে। রাশিয়া যেহেতু বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী, তাই যুদ্ধ বিশ্বে জ্বালানি সঙ্কট ঘটাতে শুরু করেছে। ভারত যেহেতু তার জ্বালানির চাহিদার বেশিটাই আমদানি করে মেটায়, তাই ভারতও এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না। এছাড়া রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলিতভাবে বিশ্বের গমের বাজারে বৃহত্তম সরবরাহকারী। তা ছাড়া ইউক্রেন থেকে ভারত প্রচুর পরিমাণে সূর্যমুখী তেল আমদানি করে থাকে, আর রাশিয়া ইউরোপ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাসায়নিক সার সরবরাহ করে থাকে।

     

    ভারতের উদ্বেগের কারণ, ইউক্রেনের যুদ্ধ চলতে থাকায় ইতিমধ্যেই জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজারে তার চাপ বাড়তে শুরু করেছে। ফলে, শুধু ইউরোপে নয়, জ্বালানির ঊর্ধ্বমুখী দাম ভারত সহ এশিয়া আফ্রিকার বহু দেশের অর্থনীতিকে চাপে ফেলতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে গম ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের দামও বাড়তে থাকলে তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুধার্ত দেশগুলির খাদ্য নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

     

    যদি এমন হয় যে, পরমাণু যুদ্ধের দিকে না গিয়ে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধ থেমে গেল, তা হলেও তার নেতিবাচক ফলগুলি ভারতকে উদ্বেগে রাখার জন্য যথেষ্ট। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রুশ-মার্কিন সম্পর্ক যেভাবে নষ্ট হয়েছে, তাতে ভারতের চিন্তার কারণ আছে। কারণ, ভারত তার অর্ধেকের বেশি সামরিক অস্ত্রই কিনে থাকে রাশিয়ার কাছ থেকে। যে হেতু চিনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে বিবাদের কারণে দু'পক্ষই সেনা সমাবেশ করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাই এই অবস্থায় যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক যন্ত্রাংশ সরবরাহের ব্যবস্থা কোনও ভাবে বন্ধ হয়ে গেলে নয়াদিল্লিকে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এই অবস্থায় রাশিয়া ও আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের দড়ির খেলায় ভারসাম্য রক্ষা করে চলাটা ভারতের বিদেশনীতির প্রধান অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া আমেরিকার তরফ থেকে বাড়তি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে আগামীদিনে রাশিয়া থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনা বা নতুন কোনও যৌথ প্রকল্পে যুক্ত হওয়াও সমস্যাসঙ্কুল হতে পারে। কারণ, আমেরিকা শুধু রাশিয়াকেই শাস্তি দিতে আগ্রহী নয়, রাশিয়ার সঙ্গে কোনও দেশ ব্যবসা করতে গেলে তাকেও শাস্তি দিতে উদ্যত।

     

    আরও পড়ুন: ইউক্রেনে ইতিহাসের বিচিত্র পরিহাস

     

    ভারতের আরও উদ্বেগের কারণ এশিয়াতে চিন যখন আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে চলেছে, সেখানে আমেরিকা এশিয়ায় কোন ভূমিকা নেবে তা নিয়েও। ইউক্রেন যুদ্ধের পর আমেরিকার মনোযোগ এখন ইউরোপেই কেন্দ্রীভূত। ওয়াশিংটনের যাবতীয় সময়, শক্তি ও অর্থ এখন সেখানেই ব্যয় হবে। এই অবস্থা সহজে পাল্টাবে না। এর পরেও কি আমেরিকা চিনের সঙ্গে পাঞ্জা কষতে এশিয়ায় নাক গলাবে? ভারতকে সম্ভবত এই সব কথা মাথায় রেখে জরুরি ভিত্তিতে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার মতো করে নিজেদের সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখার সঙ্গেই এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করতে হবে।

     

    চিনের কাছেও ইউক্রেন যুদ্ধ তার উন্নয়ন ও আর্থিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাঘাত হিসেবে হাজির হয়েছে। গত বছরই চিন বিশ্বের বৃহত্তম রফতানিকারক দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। ওই বছর চিন মোট তিন লক্ষ 30 হাজার কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করেছে। 2021 সালে আমেরিকার সঙ্গে চিনের বাণিজ্য বেড়েছে 20 শতাংশ। ইউরোপের সঙ্গে চিনের বাণিজ্যের পরিমাণও এখন 828 বিলিয়ন। এ ছাড়া চিন ইউরোপের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল।

     

    ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন করার জন্য যদি আমেরিকা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানকে Coordination Committee for the Multilateral Export Controls (CoCOm)-এর ব্যবস্থা অনুযায়ী অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও তার জ্ঞান চিনকে দেওয়া বন্ধ করতে রাজি করাতে পারে, তা হলে চিনের পক্ষে আমেরিকার সঙ্গে প্রযুক্তিবিদ্যার দৌড় প্রতিযোগিতায় জেতা অসম্ভব হতে বাধ্য।

     

    রাশিয়ার সঙ্গে চিনের বাণিজ্যের পরিমাণ এখন মাত্র 159 বিলিয়ন ডলার, যদিও আগামী কয় বছরে তা অনেক গুণ বেড়ে যেতে পারে। ইউক্রেনের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক কম, মাত্র আট বিলিয়ন ডলার। কিন্তু চিনের কাছে ইউক্রেনের গুরুত্ব অন্যত্র, ইউক্রেন চিনের Belt and Road Initiative -এর সঙ্গে যুক্ত। এই সব কারণেই চিন চায় ইউক্রেন যুদ্ধ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্ধ হোক।

     

    তাই লাভরভের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত হুমকির প্রতিক্রিয়ায় চিনের বক্তব্য, যুদ্ধ ‘কেউই’ চায় না। আশা করা যায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব পক্ষ আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করবে এবং যুদ্ধ বন্ধ করতে উদ্যোগী হবে। রাশিয়া ও আমেরিকা কীভাবে ইউক্রেন যুদ্ধে দাঁড়ি টানতে চাইবে তার উপর এখন অনেকটাই নির্ভর করছে।

     

    যদি লাভরভের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পরমাণু যুদ্ধের হুমকিকে মস্কোর তরফে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে শান্তি আলোচনায় বসার আহ্বান হিসাবে দেখা হয়, তাহলে ইউক্রেন সঙ্কট দ্রুত মিটতে পারে। কিন্তু পুতিন ও বাইডেন যদি মনে করেন যে, নিজেদের শত্রুকে সম্পূর্ণ পরাভূত করার আগে আলোচনায় বসা তাঁদের পক্ষে কঠিন, তা হলে ইউক্রেনের জন্য আরও খারাপ পরিণতি অপেক্ষা করছে। সেরকম হলে তা শুধুই ইউরোপকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা নয়, ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশই সেই আগুনে হাত পোড়াবে।

     


    প্রণয় শর্মা - এর অন্যান্য লেখা


    ইউরোপে সঙ্কটময় পরিস্থিতির মধ্যে অতি দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীলদের হারিয়ে প্রেসিডেন্ট মাকরঁর জয়।

    আমেরিকা এবং সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরতা কমিয়ে স্বাধীন বিবেচনা অনুসারে চলার মাশুলই দিতে হল পাকিস্তানকে

    পশ্চিমি দুনিয়া ইউক্রেনকে যে সব অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র দিচ্ছে তাতে যুদ্ধ সহজে থামবে না।

    ইউক্রেনে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested