×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ফ্রান্সে ভোটে উদারপন্থার জয়

    প্রণয় শর্মা | 29-04-2022

    নিজস্ব ছবি

    ইমানুয়েল মাকরঁ (Immanuel Makron) দ্বিতীয়বার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ফলে শুধু যে ভারত ফ্রান্স বিশেষ সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ল তা-ই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভারত যে তার সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার চেষ্টা চালাচ্ছে, সেটাও গতি পাবে। ফ্রান্স এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, আর এমন একটা সময় মাকরঁ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, যখন ব্রাসেলস (ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী) ও নয়াদিল্লি নিজেদের সম্পর্ককে আরও বিস্তৃত এবং গভীর করে তুলতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে

     

    1998 সালে ভারতের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক (strategic partnership) গড়ে তোলার পর থেকেই ফ্রান্স ইউরোপে ভারতের হয়ে কথা বলতে শুরু করেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য সদস্য দেশগুলির সামনে ভারতের সদর্থক ভূমিকাকে তুলে ধরে চলেছে। দ্বিতীয়বার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাকরঁর নেতৃত্বে ফরাসি সরকার সেই কাজটা আরও বেশি করে করবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে নয়াদিল্লি ও ব্রাসেলসকে আরও কাছে টানার কাজটাও গতি পাবে বলে মনে করা যায়

     

    মাকরঁ 2017 লালে প্রথমবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা হয়। গত শনিবারের ফ্রান্সের নির্বাচনী ফল বেরোবার পরে ভারতের সামনে ফ্রান্সের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবেই বলে মনে করা হচ্ছে। মোদী যে আগামী মাসে ইউরোপ সফর করার সময়েই প্যারিসে গিয়ে মাকরঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে নির্বাচনী জয়ের জন্য অভিনন্দন জানাবেন, তা থেকেই ইঙ্গিত মেলে মোদি ও মাকরঁ, এই দুই নেতার মধ্যকার সম্পর্ক ভারতের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ

     

    মাকরঁর জয় ইউরোপ ও পশ্চিমি দুনিয়ার অনেকের কাছেই খুশির বার্তা নিয়ে এসেছে। গত সপ্তাহের আগে পর্যন্ত অনেকেরই ধারণা ছিল যে, এবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে খুবই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে চলেছে। এমনকি সবাইকে চমকে দিয়ে মাকরঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণপন্থী প্রার্থী মারি লা পেন (Marine Le Pen) জিতেও যেতে পারেন। রাশিয়ার ঘোষিত সমর্থক লা পেন ইউক্রেন যুদ্ধ চলার মধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে শুধু ফ্রান্সেরই নয়, এই ধাক্কায় গোটা ইউরোপের উদারপন্থী বা লিবারালদের হতোদ্যম হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল

     

    আরও পড়ুন:ইউক্রেনে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি

     

    লা পেন ভীষণরকম রক্ষণশীল ‘বন্ধ-দরজা’ অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো (NATO)-র সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে মোটেই আগ্রহী নন। তাঁর অভিবাসন নীতি যদিও মুখ্যত মুসলমানদের ফ্রান্সে প্রবেশ ঠেকানোর লক্ষ্যে তৈরি, তবুও ইউক্রেনের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের জন্যও দরজা বন্ধের আশঙ্কা থেকেই যায়

     

    মাকরঁর জয়ের ব্যবধান আপাতত কিছুটা সেই সব আশঙ্কাকে দূরে সরিয়ে স্বস্তি এনে দিয়েছে। 1965 সালে চার্লস দ্য গল দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে মাকরঁ দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি পর পর দু'বার প্রেসিডেন্ট হলেন, যাঁর ন্যাশনাল এসেম্বলিতেও (ফ্রান্সের পার্লামেন্ট) সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন রয়েছে। তবে আগামী জুন মাসেই মাকরঁর সরকারকে শক্ত চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হবে, কারণ তখন ফ্রান্সের পার্লামেন্টের নির্বাচন হবে (ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন আলাদা আলাদা হয়)। ফ্রান্সে জিনিসপত্রের দাম ক্রমবর্ধমান, মুদ্রাস্ফীতিও ঊর্ধ্বমুখী, তার উপরে শ্রমিকদের বেতন এক জায়গায় থেমে রয়েছে - সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের ভিতর যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, তা মাকরঁর 58 শতাংশ ভোটের বিরুদ্ধে লা পেনের ঝুলিতে 41 শতাংশ ভোট জমা করেছে। 1945 সালের পর এই প্রথম কোনও দক্ষিণপন্থী দল এত বেশি ভোট পেল। তাই দেখাই যাচ্ছে, নির্বাচনে জিতে আবারও প্রেসিডেন্ট হতে পারলেও মাকরঁর পক্ষে নিজের পছন্দমতো সরকার গড়া কঠিন হতে পারে

     

    ফ্রান্স ও ইউরোপে পটপরিবর্তনের প্রভাব ভারতের উপর কীভাবে পড়তে পারে?

    কোনও সন্দেহ নেই, আজকের বিশ্বায়িত জগতে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব শুধুই ইউরোপে সীমাবদ্ধ থাকবে না, অন্যান্য মহাদেশেও পড়বে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন (Ursula von der Leyen) তো ইতিমধ্যেই সতর্ক করে বলেছেন যে, এই যুদ্ধের প্রভাব ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলি এড়াতে পারবে না। মনে রাখতে হবে যে, এই অঞ্চল এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিক থেকে প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শুধু বিশ্বের মোট জনসংখ্যার 60 শতাংশই এই অঞ্চলে বাস করে বলে নয়, এই অঞ্চলে একাধিক শক্তিশালী অর্থনীতির দেশও রয়েছে

     

    ভারতের সঙ্গে ফ্রান্সের বিশেষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্সের সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সুবাদে ভারত যে শুধুই সামরিক ক্ষেত্রে লাভবান (মিরাজ ও রাফায়েল যুদ্ধবিমান) হয় তা নয়, এ ছাড়াও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, মহাকাশ সংক্রান্ত গবেষণা ও পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহযোগিতা পাওয়া, এমনকি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংক্রান্ত জ্ঞান আমদানি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও প্রচুর উপকৃত হয়ে আসছে। অবশ্যই এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ফলে দুই দেশেরই লাভ হয়। তা ছাড়া জার্মানির চ্যান্সেলর পদ (সে দেশের সরকারের শীর্ষ পদ) থেকে অ্যাঞ্জেলা মর্কেলের (Angela Markle) সরে যাওয়া এবং ব্রেক্সিটের পর ইংল্যান্ড বেরিয়ে যাওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক সদস্যই ফ্রান্সকে নেতার ভূমিকায় দেখতে আগ্রহী। ইউরোপের মতোই ভারত সহ অনেক দেশই চায় ফ্রান্স এবার ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আরও বড় ভূমিকা নিক

     

    এমনিতে রাশিয়ার পরেই ফ্রান্স দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ, যার উপর ভারত সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য নির্ভরশীল। মোদীর আত্মনির্ভর ভারত স্লোগানে সুর মিলিয়ে ফ্রান্স ভারতে আধুনিক সাবমেরিন ও যুদ্ধবিমান তৈরিতে হাত বাড়িয়েছে। ভারত মহাসাগরের তলদেশের খুঁটিনাটি মানচিত্র তৈরি করতেও এগিয়ে এসেছে। অনেকেই মনে করছেন, মোদী-মাকরঁর যুগলবন্দি ইউরোপ-এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে

     

    গত কয়েক দশকে ভারতে ফ্রান্সের গুরুত্ব বেড়ে চলেছে, যা দেখা গেছে 1998 সালে দ্বিতীয়বার পোখরানে পরমাণু বোমার সফল পরীক্ষার পর। পশ্চিমি দুনিয়া এই নিয়ে অনেক অযাচিত উপদেশ দিলেও (আমেরিকা তো সরাসরি নিষেধাজ্ঞা চাপায়), ফ্রান্স কিন্ত ভারতের এ পথে হাঁটার যৌক্তিকতাকে বুঝেছিল। সেই সঙ্গে ইউরোপও যাতে আমেরিকার পথে না হাঁটে, সে জন্য তাদের বুঝিয়েছিল

     

    কেউ কেউ মনে করছেন, আগামী দিনে রাশিয়া যদি চিনের আরও ঘনিষ্ঠ হয় এবং সেই কারণে ভারতের পক্ষে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে প্রয়োজনে তার ‘ভেটো’ প্রয়োগ না করে, তখন ফ্রান্সের (তারও ভেটো আছে) সাহায্য মিলতে পারে। যদিও রাশিয়া ভারতের হাত ছেড়ে দেবে, এমন সম্ভাবনা এখনই দেখা যাচ্ছে না তবুও ভারতের জন্য ফ্রান্স একটা বিকল্প উপায় হতে পারে। মাকরঁ নিজে কখনই রাশিয়াকে বাদ দিয়ে চলার কথা ভাবেন না। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলার পক্ষপাতী। মাকরঁর সঙ্গে মোদীর আসন্ন বৈঠকে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি, আমেরিকার ইউক্রেনকে যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে চলা বন্ধ না হলে যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ইত্যাদি সব নিয়েই আলোচনা হবে। বার্লিনে জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ (Olaf Scholz)-এর সঙ্গে বৈঠকে এবং মে মাসের 2-6 ডেনমার্কে ভারত ও নর্ডিক (nordic) দেশগুলির (ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড প্রভৃতি) মধ্যে যে বৈঠকেও এই প্রসঙ্গ গুরুত্ব পাবে। এই ভাবে ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে ভারতের আদানপ্রদান যত বাড়বে, ততই ফ্রান্স-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে।

     


    প্রণয় শর্মা - এর অন্যান্য লেখা


    ইউরোপে সঙ্কটময় পরিস্থিতির মধ্যে অতি দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীলদের হারিয়ে প্রেসিডেন্ট মাকরঁর জয়।

    আমেরিকা এবং সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরতা কমিয়ে স্বাধীন বিবেচনা অনুসারে চলার মাশুলই দিতে হল পাকিস্তানকে

    পশ্চিমি দুনিয়া ইউক্রেনকে যে সব অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র দিচ্ছে তাতে যুদ্ধ সহজে থামবে না।

    ফ্রান্সে ভোটে উদারপন্থার জয়-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested