তখনও নোবেল পদক ছিল, তখনও পাঁচিল গজায়নি কোথাও। তখন সেই শান্তিনিকেতনই ছিল। তবে তখন সুরক্ষিত ছিল উপাসনাগৃহ বা কাঁচঘর। বুধবারের সাপ্তাহিক উপাসনা বা বিশ্বভারতীর যে কোনও অনুষ্ঠান থেকে স্মরণ, প্রার্থনা সব কিছুর কেন্দ্র ছিল সেই উপাসনাঘর। সেখানে মূল দরজা বন্ধ, চারদিক ঘেরা। সুরক্ষিত বলয় এবং বিশ্বভারতীর নিজস্ব নিরাপত্তা বেষ্টনী। অনুষ্ঠানের সময়টুকু ছাড়া কখনওই উপাসনাগৃহের দরজা খোলা হত না। সকালে অধিকারিক নিজে এসে কর্মীদের দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করাতেন। একদিন তিনি এসে দেখেন মূল দরজা খোলা। ভেতরে একাধিক ব্যবহার করা কন্ডোম এবং ফাঁকা মদের বোতল, জলের বোতল, একাধিক গ্লাস পড়ে আছে। তখন নব্বই-এর দশক। বিশ্বভারতীর তৎকালীন উপাচার্য বিষয়টি শুনে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিককে পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। সুরক্ষার সঙ্গে আলোর ব্যবস্হা বাড়ানো হল। সর্বক্ষণের নিরাপত্তারক্ষী নজর রাখতে শুরু করলেন। কিন্তু আশ্রমিকদের বড় অংশ ছি ছি করে উঠলেন। মনে পড়ছে, প্রয়াত শান্তিদেব ঘোষ ছিলেন প্রতিবাদে সবার আগে। সবার একটাই প্রশ্ন, কীভাবে সম্ভব হয় এ কাজ উপাসনাগৃহের ভেতর? শান্তিদেব ঘোষ-কে কর্তৃপক্ষ সরাসরি কটাক্ষ করত তার প্রতিবাদী চরিত্রর জন্য। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বভারতীতে রুচির বিকার ঘটছে। তার কথা শুনে সেদিন খবর লিখেছিলাম। লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিলেন গুনীজনেরা।
বাধ্য হয়ে বিশ্বভারতী একটি তদন্ত কমিটি সে সময় গঠন করেছিল। কিন্তু প্রায় তিন দশক হতে চললেও তার রিপোর্ট কেউ জানে না। এরপর থেকে বিশ্বভারতীর উপাসনাগৃহের সাপ্তাহিক উপাসনা অনেকটা ম্লান হয়ে যায়।
ফের কন্ডোম আবিষ্কার, তবে এবার উপাসনাগৃহে নয়, খোলা মেলার মাঠে। এবং অনেকটা পাঁচিল গড়ার যুক্তির ভিত যেন গড়ে দিল খোলা মাঠের ব্যবহার করা কন্ডোম। মেলার মাঠের পূর্বে মাঠের গা ঘেঁষে শান্তিনিকেতন থানা। পুলিশ, কর্মী-আধিকারিকদের ভীড় যেখানে সবসময়, সেখানে দেহব্যবসা, কন্ডোম পাওয়া শুনতেই কেমন লজ্জায় পড়ে যাচ্ছেন স্থানীয়রা। প্রশ্ন উঠছে, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ লিখিত ভাবে বিবৃতি দিয়ে এসব যখন জানাচ্ছেন, তখন ঘটনা নিশ্চয়ই লোক মুখে বা সঙ্ঘ কর্মীদের মুখে তারা শোনেননি, নিশ্চয়ই ঘটনার সাক্ষী বা প্রামাণ্য তথ্য আছে তাদের কাছে। তাহলে সে মুহূর্তে বা পরে কি কোনও আইনি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তারা? না, পুলিশকে জানিয়েছিলেন যে, তাদের সম্পত্তির ওপর দাঁড়িয়ে দেহব্যবসা চলছে, তারা কিছু করতে পারছেন না! নিজেদের কোনও দুর্বলতা ছিল না তো? নিজেদের নিজেরাই অনেক ছোট করে দিলেন কর্তৃপক্ষ, এ মত দলমতের বেড়া টপকে সকলের।
অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, আপত্তিকর জিনিসটি বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষরা একত্রে থাকেন, তাদের শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়াটি যখন কর্তৃপক্ষের লিখিত অজুহাত হয়ে সামনে আসে, তখন তো পাল্টা প্রশ্ন উঠবেই যে, পৌষ মেলায় বোলপুরের গৃহবধূ পুলিশের কাছে লিখিতভাবে উপাচার্যের ছায়াসঙ্গীদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেন। তার পাল্টা কি এই কন্ডোম-তত্ত্বের অবতারণা? উপাচার্য কি হলফনামা দিতে পারবেন, বিশ্বভারতীর চারিদিকে পাঁচিল দেওয়া হলে আর কন্ডোম দেখতে পাবেন না কোথাও? আপত্তিকর কাজকর্ম কোথাও হবে না?
আসলে উপাচার্য ভাবছেন তালিবানি আর উগ্র মনুবাদের সফল প্রয়োগ করবেন এখানে, তা কিন্তু সম্ভব নয়। তিনি তো অস্বীকার করতে পারবেন না, তাঁর দলের আসারাম বাপু, রামরহিম বাবা সহ অনেক বাবার আশ্রমে কী হত। সেইরকম আশ্রম নয় শান্তিনিকেতন। শিল্পকলা, শিক্ষা কিংবা গবেষণা, উৎকর্ষতার লক্ষ্যে দেশ-বিদেশের পড়ুয়ারা আজও আসেন বিশ্বভারতীতে। তালিবানি ফতোয়ার মতো স্বাভাবিক জীবনে যদি নিষেধাজ্ঞার নামে ধর্মীয় রাজনীতির খড়্গ তিনি নামান, তবে হিতে বিপরীত হবে।
এখানে কন্ডোমই সমস্যার কারণ, এমন গবেষনালব্ধ প্রতিক্রিয়া দিয়ে নিজেদের আর ছোট নাই বা করলেন। আগে সুরক্ষিত উপাসনাঘরে কন্ডোম কান্ডের তদন্ত রিপোর্ট সামনে আনুন, পরে খোলা মাঠে কন্ডোম আবিষ্কারের গবেষণা করবেন।
উপাচার্যের কার্যকলাপ একপেশে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অভিযোগে সরব বিশ্বভারতীর অনেকেই।
সব রাজনীতির বাইরে থেকে যে এলাকা বহুজনের কাছে রূপকথার ভূমি, তা দখলের রাজনীতি নাই বা হল।
প্রায় তিন দশক হতে চললেও তার রিপোর্ট কেউ জানে না।