‘উপাচার্যের নেতৃত্বে লড়ছি লড়ব’- বিজেপি এই পোস্টার ঝুলিয়ে দিয়েছে শান্তিনিকেতন পোস্ট অফিস মোড়ে। চতুর্দিকে বিজেপি, তৃণমূলের পতাকা। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী এখন রাজ্যের দুই যুযুধান রাজনৈতিক দলের কুস্তির আখড়া। উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে সেই আখড়ার এক পক্ষের ওস্তাদের মতো লাগছে! এবারের সংঘাতের উপলক্ষ্য বিশ্বভারতীর জনপ্রিয় এক শিক্ষকের সাসপেনশন।
রোম যখন জ্বলছিল তখন সম্রাট নিরো বাঁশি বাজিয়েছিলেন। আর বিশ্বভারতী জ্বলার উপক্রম হলেই মৌনব্রত অবলম্বন করে ছাতিমতলায় বিশ্বস্তদের নিয়ে উপাসনায় বসে পড়েন উপাচার্য। সংবাদমাধ্যম বিশ্বভারতীর অন্যান্য অনুষ্ঠানে অনাহূত, এমনকি অনেক সময়ই অবাঞ্ছিত। কিন্তু ধ্যানরত, মৌন উপাচার্যের ছবি তোলার জন্য সংবাদকর্মীদের ডাক পড়ে। শনিবার সকালে উপাসনায় বসলেন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। অতীতে হস্টেলে ছাত্রী খুন হলেও আতঙ্কিত পড়ুয়াদের কাছে না গিয়ে ধ্যানে বসেছিলেন তৎকালীন উপাচার্য রজতকান্ত রায়। সেই পথই নিলেন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
ক্রমাগত অপছন্দের অধ্যাপকদের নিজের ইচ্ছেমতো সাসপেন্ড করে চলা উপাচার্য তাঁর দীর্ঘদিনের আক্রমনের লক্ষ্য অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্যকে সাসপেন্ড করায় যে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে, সেটা আঁচ করে বিশ্বস্তদের নিয়ে সোজা ধ্যানে বসে পড়লেন। তবে মানুষটি নিজেই নিজের এমন ভাবমূর্তি বা ইমেজ তৈরি করেছেন যে, তিনি উপাসনায় মৌনব্রত অবলম্বন করেছেন শুনে স্থানীয় হস্তশিল্পী, ছোট ব্যবসায়ীরা পাল্টা অবস্থানে বসলেন তাঁর কাছেই। তাঁদের দাবি, গত পৌষমেলায় প্রথমে তাঁদের কাছ থেকেও সিকিউরিটি মানি নিয়েছিল বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ, কিন্তু এতদিন হয়ে গেলেও সেই টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। অতএব, কর্তৃপক্ষের ভণ্ডামি ও প্রতারণার বিরুদ্ধে তাঁরাও তাঁদের প্রতিবাদ জারি রাখলেন।
‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’- দিনের শুরুতে কুনাট্যের অবতাড়না করে আসর জমিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং উপাচার্য। বামপন্থী ছাত্ররাও আশ্রমের গেটে পাল্টা অবস্থানে বসলেন। তাঁদের দাবিসমূহের নির্যাস থেকে মূলত তিনটি বিষয় উঠে আসে। 1) তুঘলকি সিদ্ধান্তে সম্মাননীয় শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাসপেন্ড করা বন্ধ করতে হবে। 2) বিশ্বভারতীর অভ্যন্তরে বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। 3) অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন চালু করতে হবে। এ ব্যাপারে অনেকেই চলমান মহামারী পরিস্থিতির কথা বলছেন। পড়ুয়াদের একাংশের প্রশ্ন, অমিত শাহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা বিরাট সংখ্যক কর্মী-সমর্থক নিয়ে শহরের রাস্তায় পদযাত্রা, রোড-শো করছেন, রাজনৈতিক মিটিং মিছিলে কোনও সুরক্ষা বিধিও মানা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা নেই, শুধু পঠনপাঠন শুরু হলেই কি সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে? বিক্ষোভরত ছাত্ররা শনিবার অর্থনীতি বিভাগের বন্ধ ক্লাসঘরের তালা ভেঙে দিয়েছেন।
হতে পারেন তিনি শিক্ষাবিদ, তবে রাজনীতির কানা গলিও তাঁর কাছে অপরিচিত নয়। এমনটা যে হতে পারে তা আন্দাজ করেই উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী প্রেস, পার্ষদ, জনতাকে সাক্ষী রেখে ধ্যানমগ্ন হলেন! তবে বিশ্বভারতীর অন্দরে গুঞ্জন, উপাচার্যের সহসা এই মৌনব্রত অবলম্বনের কারন নাকি অনুব্রত মন্ডল। বোলপুরের ‘কেষ্ট’ নাকি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশমতো দলবল নিয়ে এসে শান্তিনিকেতনের রাজ্য সরকার অধিকৃত রাস্তাটি বিশ্বভারতীর কাছ থেকে পুনর্দখল করেছেন। নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে দলীয় পতাকায় মুড়ে ফেলা হয়েছে সেই রাস্তা। আর এতেই নাকি ভীষন আহত হয়েছেন উপাচার্য। তিনি এখন সেই রাস্তা বিশ্বভারতীর অধীনে ফিরিয়ে আনতে চান।
অভিজ্ঞমহল বলছে বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করে এই রাজনৈতিক দড়ি টানাটানিতে রাজ্যের শাসকদলের সঙ্গে টক্কর নেওয়া উপাচার্যের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে তাঁর বিরুদ্ধ মত এবং পথের ব্যক্তিরা। যেমন- তাঁর বিশ্বভারতীর চারদিকে পাঁচিল তোলার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন প্রবীন আশ্রমিকরা। উপাচার্য আশ্রমিকদের পুরনো দপ্তরটাই বন্ধ করে দিলেন। তেমনই তার কথামতো না চলা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশ করার শাস্তিস্বরূপ অধ্যাপকদের সংগঠন বিশ্বভারতী ফ্যাকাল্টি অ্যাসোসিয়েশনের ঘরে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। সংগঠনের মাথাদের শায়েস্তা করতে শীর্ষ পদাধিকারীদের নিয়ে 3 ঘন্টার সভায় একটানা বলে গেছেন, অবাধ্যদের সাসপেন্ড করতেই হবে। আদালতের রায়কে মেনে চলার প্রয়োজনীয়তাও তিনি এখন দেখছেন না। এর আগে তিনি বিশ্বভারতী প্রশাসনে নিজের এবং তাঁর অনুগতদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে বহু গুণী অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মীকে সাসপেন্ড করেছিলেন। উপাচার্যের সর্বশেষ শিকার অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য। কিন্তু তাঁর অপরাধ কী ছিল?
উপাচার্য ঘনিষ্ঠদের অভিযাগ, ছাত্র-ছাত্রীদের NRC CAA NPR বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে ওই অধ্যাপক নাকি প্ররোচনা দিয়েছেন। পড়ুয়ারা উপাচার্যকে দেখলে যেভাবে কার্যত তাঁকে তাড়া করিয়ে বেড়াচ্ছেন, তার পিছনেও নাকি সুদীপ্তবাবুরা আছেন! উপাচার্যের দাবি, এবিভিপির সর্বভারতীয় সম্পাদককে তিনি বিশ্বভারতীর হলকর্ষন উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে নিয়ে এলে, যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, তার পিছনেও এই অবাধ্য অধ্যাপককূল আছেন। আরএসএসের সাংস্কৃতিক সংগঠনকে দিয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে অনুষ্ঠান করা যায়নি এইসব বিরোধীদের বাধায়। একের পর এক তার রাজনৈতিক কর্মসূচি রূপায়নে ব্যর্থতার কারন হিসেবে VBUFA নামক অধ্যাপক সংগঠনকে চিহ্নিত করে, সেই সংগঠন দখল করার ছকও কষতে শুরু করেছেন উপাচার্য। সম্প্রতি তাঁর প্রিয়পাত্রী এক শিক্ষিকার নিয়োগ কতটা বৈধ, সেই প্রশ্ন তোলায় আগে থেকে তৈরি করা চিঠিতে তারিখ বসিয়ে সাসপেন্ড করে দেওয়া হল অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্যকে। এক উপাচার্য ঘনিষ্ঠের দাবি, 3 ঘন্টার মিটিং-এর প্রায় পুরো সময় ধরেই এই অধ্যাপককে কীভাবে সাসপেন্ড করা যায়, তার ছক তৈরি করেন উপাচার্য।
তবে ডান-বাম সব মতের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের প্রিয় শিক্ষক সুদীপ্তদাকে ভালোবাসে, স্থানীয় মানুষজনও পছন্দ করেন তাঁকে। ফলে ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া যে হবেই তা বুঝে নিয়ে নজর ঘোরানোর চেষ্টা চালিয়ে যান উপাচার্য। সেক্ষেত্রে তাঁর নতুন হাতিয়ার মৌনব্রত অবলম্বন করে ধ্যানমগ্ন হওয়া। তবে, বিশ্বভারতীর ভিতরে উপাচার্যের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানুষজনের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মচারী, ছাত্র-ছাত্রী থেকে আশ্রমিক, হস্তশিল্পী, ব্যবসায়ী কিংবা রাজনীতিতে যুযুধান বাম থেকে তৃনমূল- সকলেই তাঁর অপকর্মের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছে। আর যে দলের সঙ্গে উপাচার্যের ঘনিষ্ঠতা বলে গুঞ্জন, সেই বিজেপির কী অবস্থান এই নিয়ে? দলের এক জেলা নেতা বলেই ফেললেন, ‘এই লোকটা হল গলার কাঁটা, বিদায় নিলে আমাদেরও মুখ রক্ষা হয়!’
প্রায় তিন দশক হতে চললেও তার রিপোর্ট কেউ জানে না।
সব রাজনীতির বাইরে থেকে যে এলাকা বহুজনের কাছে রূপকথার ভূমি, তা দখলের রাজনীতি নাই বা হল।
উপাচার্যের কার্যকলাপ একপেশে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অভিযোগে সরব বিশ্বভারতীর অনেকেই।