×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • পাঁচিল তোলার দরকার নেই

    জয়দীপ সরকার | 18-08-2020

    প্রতীকী ছবি।

    অরাজনীতির লেবেলে সব থেকে বেশি কদর্য একদলীয় রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে শান্তিনিকেতনে। এখানে ভিন্নমতের পথচারী হলে তাকে সমস্ত দিক থেকে কোনঠাসা করে তার শিক্ষা জীবনটাই শেষ করার চেষ্টা হয়

     

    বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্র প্রয়াত কবি জয়দেব বসুর ওই কথাগুলো এখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীর কথা।

     

    শান্তিনিকেতনের নানা অলিন্দে এখন আলোচনা, প্রতিবাদের ধরন কেমন হবে। একসময় ছিল মিছিল মিটিং, অবরোধ, ধরনা, অবস্থান তারপর প্রতিবাদে এল বোমা মেশিনগান, এবার প্রতিবাদে যুক্ত হল অতিকায় আর্থ মুভার মেশিনপ্রতিবাদীরা পতাকা নয়, দাবির ফেস্টুন নয়, প্রতিবাদ জানাতে রথের মতন চালিয়ে আনলেন নির্মাণ ভেঙে মাটিতে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জেসিবি মেশিন। তুলে ফেললেন বহু পুরনো বিশ্বভারতীর গেট। ভাঙা হল ত্রিপলের ম্যারাপ, অস্থায়ী নির্মাণ সবটাই। 

     

    কারা করল? স্থানীয়রা বলছেন এদের নেতৃত্বে ছিলেন তৃণমূলের দুবরাজপুরের বিধায়ক, স্থানীয় একাধিক তৃণমূল কাউন্সিলার সহ নেতা কর্মীরা। বীরভূম জেলার প্রসিদ্ধ তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল অবশ্য দাবি করলেন, যারা একাজ করেছে তারা দলের হয়ে যায়নি, এদের মধ্যে অনেকে প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। 

     

     

    কিন্তু তৃণমূলের এত ক্ষোভ বা শক্তি প্রদর্শনের কারণ কী? বিশ্বভারতীর অন্দরে এখন তৃণমূলের নেতা কর্মীদের খুঁজতে যথেষ্ট চেষ্টা করতে হয়বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছাত্র শক্তি হয়ে উঠেছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের জোট ছাত্র ঐক্য, আর তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এবিভিপি, যাদের অনেকেই বলে থাকেন উপাচার্যর নিজের সংগঠনএই ছাত্রদের একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গের নয়, ঝাড়খণ্ডের। 

     

    মেলার মাঠে পাঁচিল তোলার ঘটনা একটি প্রতীক মাত্র, উপাচার্য বনাম তাঁর বিরোধীদের আন্দোলন গত দু'বছরে তুঙ্গে উঠেছে বিশ্বভারতীতে। সেটা আসল বিষয়।

     

    এটা এক রকম প্রতিষ্ঠিত যে, কেন্দ্রে যে দল ক্ষমতাসীন হন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতীর উপাচার্য হন সেই শাসক দলের লোক। সেই হিসেবে বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী সঙ্ঘ পরিবারের পুরনো মানুষ। তাঁর পৈত্রিক গ্রাম বীরভূমের সদর সিউড়ির কাছেই। তিনি এসেই বোলপুরে রাঙাবিতানে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন,  আলাপ করেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে। অবশ্যই অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎটাও করে প্রায় নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। গতবছর অনুব্রত দলের সভায় বলেই দেন বিশ্বভারতীতে আপনারা কিছু ঝামেলা করবেন না।

     

     

    কিন্তু সেই সুসম্পর্কে হঠাৎ চিড় কেন? 

     

    স্থানীয়ভাবে উঠে আসছে একাধিক যুক্তি। প্রশাসক হিসেবে ব্যর্থ বিদ্যুৎ চক্রবর্তী পৌষ মেলা হবে না এমন ঘোষণা করে শেষ পর্যন্ত কোনও মতে দায়সারা ভাবে মেলা হয়েছে। বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বসন্ত উৎসব হয়নি। যেহেতু বোলপুরের অর্থনীতির একটা বড় অংশ পর্যটনকেন্দ্রিক এই উৎসব থেকে আসে, তাতে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা তৃণমূলের উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন উপাচার্যর বিরোধিতা করার জন্য। এরপর উপাচার্য একের পর এক কটাক্ষ করে কখনও বোলপুরের ব্যবসায়ীদের, কখনও পুরনো আশ্রমিকদের আক্রমণ করছেন, স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

     

    তৃণমূলের হামলার আগের দিন উপাচার্য ডাক পাঠিয়ে শিক্ষক কর্মচারীদের বিরাট মিছিল করান। করোনার সব বিধিনিষেধ উড়িয়ে দিয়ে উপাচার্যের কোপ থেকে বাঁচতে প্রায় চারশো কর্মী এসছিলেন। তাদের একত্রে পাহারার কাজে নিযুক্ত করেন উপাচার্য। বাম ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল তাদের সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীদের দিয়ে আটকান তিনি। বৃদ্ধা আশ্রমিক মেলার মাঠে পাঁচিল তোলার প্রতিবাদ করাতে নিগৃহীতা হন। তখনও সবাই জানতেন পাঁচিল হবে। নির্মাতা ঠিকাদারও প্রাচীর নির্মাণের বরাত পেয়ে মাটি কেটে কাজ করছিলেন।

     

    সোমবারের ভাঙচুরের পর উপাচার্যের দূত ডা: সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "পাঁচিল নয় ফেন্সিং দেওয়া হচ্ছিল। তাহলে এতদিন ধরে এত ক্ষোভ বিক্ষোভ যখন চলছে তখন বিষয়টি স্পষ্ট করে জানাননি কেন উপাচার্য?'

     

    কিন্তু এই প্রাচীর কেন? 

     

    2004 সালে, নোবেল পদক চুরির পর রবীন্দ্র ভবন এবং কেন্দ্রীয় দপ্তরের চারদিকে প্রাচীর দিয়ে নিরাপত্তা বাড়াতে চেয়েছিলেন তৎকালীন উপাচার্য সুজিত বসু। তখন তাঁকে "পাঁচিল কাকু' বলে কটাক্ষ করে যিনি পোস্টারিং করেছিলেন তিনি বর্তমান উপাচার্যের ছায়াসঙ্গী এবং রবীন্দ্রভবনের সর্বেসর্বা তিনি এবং উপাচার্যর সাঙ্গোপাঙ্গদের এখন বক্তব্য, রবীন্দ্রনাথের সময় আর এখন এক সময় নয়, পাঁচিলের জেদকে জেতাতে হবে। বিশ্বভারতীর দীর্ঘ দিনের ইতিহাসে সম্পদ বেদখল হওয়ার কোনও বড় নজির নেই। কয়েকটা ঝুপড়ি হোটেল হয়েছিল রতনপল্লীতে যেখানে কুড়ি টাকায় দুপুর বা রাতের খাবার পেতেন সবাই। বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীরাই খেতেন এখানে। উপাচার্য সব গুঁড়িয়ে দিয়ে চতুর্দিকে পাঁচিল দিয়ে ভাবছেন সুরক্ষাবলয় তৈরি হল।

     

    কিন্তু স্থানীয় মানুষ, গুণীজন, শিক্ষক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, গবেষক, ছাত্রছাত্রী সবাই কেন সর্বত্র পাঁচিল দেওয়ার বিরোধিতা করছেন? কেন শান্তিনিকেতন "আমাদের খোলা মাঠের মেলা' স্বতন্ত্র? চতুর্দিক প্রাচীর দিয়ে ঘিরলে শ্বাসকষ্টে হাঁপাবে শান্তিনিকেতনের মেলার মাঠ। সুপ্রিয় ঠাকুর, মোহন সিংরা শ্বাস নেবেন কোথায়? দানবীয় যন্ত্র দিয়ে প্রাচীর ভাঙা আর সিআরপিএফ-এর রুট মার্চ দুটোই বেমানান শান্তিনিকেতনে।

     

    শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিজেপি, তৃণমূল, বাম কোনও আমলেই জন্মায়নি, বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেনি। সব রাজনীতির বাইরে থেকে যে এলাকা বহুজনের কাছে রূপকথার ভূমি, তাকে নিয়ে দখলের রাজনীতি নাই বা হলযেমন ছিল তেমনই থাক বিশ্বভারতী তথা শান্তিনিকেতন।

     

     


    জয়দীপ সরকার - এর অন্যান্য লেখা


    সব রাজনীতির বাইরে থেকে যে এলাকা বহুজনের কাছে রূপকথার ভূমি, তা দখলের রাজনীতি নাই বা হল।

    উপাচার্যের কার্যকলাপ একপেশে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অভিযোগে সরব বিশ্বভারতীর অনেকেই।

    প্রায় তিন দশক হতে চললেও তার রিপোর্ট কেউ জানে না।

    পাঁচিল তোলার দরকার নেই-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested