×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • সমকালের পুরাণ: হস্তিনাপুর থেকে হাথরাস উন্নাও

    রজত রায় | 15-05-2022

    নিজস্ব ছবি

    দ্রৌপদী ও গান্ধারী। মহাভারতের দুই কেন্দ্রীয় নারীচরিত্র। একজন পঞ্চপাণ্ডবপ্রিয়া হয়েও নিজের পাঁচ পুত্রকে যুদ্ধে হারিয়েছেন। অন্যদিকে শতপুত্রের জননী গান্ধারীও যুদ্ধে সর্বহারা। কিন্তু দুজনেই সমাজে তাঁদের অবস্থান ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন। এই দুই নারীর অবস্থানকে সামনে রেখে তীজন বাঈ কলকাতায় আবার দর্শকদের সামনে তাঁর পাণ্ডবাণী নিয়ে হাজির হলেন। সঙ্গে তাঁরই যোগ্য শিষ্যা সীমা ঘোষ।

     

    কলকাতার দর্শকমণ্ডলীর কাছে তীজন বাঈ সুপরিচিত, এখানে তিনি বার বার আসেন। তবে অন্তত 40 বছর ধরে দেশে বিদেশে পাণ্ডবাণী পরিবেশনের পরে তীজন বাঈকে এখন দেখে বয়সের ভারে কিছুটা ক্লান্ত মনে হল। আকাদেমি অব ফাইন আর্টসের মঞ্চে তাঁর চলাফেরাও যেন কিছুটা শ্লথ। তবু গলার কর্কশ আওয়াজ, উচ্চগ্রামে শব্দক্ষেপণ ও চড়া সুরে গান, সব মিলিয়ে ছত্তীসগঢ়ের মাটির গন্ধ বয়ে আনা সেই আওয়াজ এখনও অমলিন। তিনি গান ধরলে বা কথকতা শুরু করলে আর চিনতে ভুল হয় না তাঁকে।

     

     

    ছত্তীসগঢ় এবং মধ্যভারতের বেশ কিছু জায়গায় গান ও কথকতার সাহায্যে (সঙ্গে কিছুটা অভিনয়ও) মহাভারতের কাহিনী পরিবেশনের এই পুরনো ধারা পাণ্ডবাণী নামেই পরিচিত। এ দিন গুরু ও শিষ্যা দুই পর্বে আলাদা আলাদা করে পাণ্ডবাণী পেশ করলেন। এঁদের সঙ্গে উপযুক্ত সঙ্গত করলেন সহগায়ক ও তালবাদ্যের যন্ত্রীরা। সীমা ঘোষ করলেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতের আবশ্যিক অঙ্গ কৌরব রাজসভায় দ্যূতক্রীড়া বা বাজি ধরে পাশা খেলার সেই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যেখানে যুধিষ্ঠির শকুনির কাছে একের পর এক দানে বাজি হেরে পঞ্চপাণ্ডব তো বটেই, দ্রৌপদীকেও হারিয়ে বসেন। আর তীজন বাঈ নিজে বেছে নিয়েছিলেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরের অধ্যায়, যেখানে একমাত্র জেষ্ঠ্য সন্তান দুর্যোধন ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেইগান্ধারী তখন দুর্যোধনকে বাঁচাতে উদ্যোগী হলে কৃষ্ণের ছলনায় হেরে যান। তার পরেই কৃষ্ণকে গান্ধারীর অভিশাপ, তাঁর যদুবংশও সমূলে ধ্বংস হবে। তাঁকেও পুত্রশোক পেতে হবে।

     

    কিন্তু এ সবই তো মহাভারতের পরিচিত আখ্যান। তা হলে কেন এ নিয়ে পাণ্ডবাণীর আবেদন এখনও পুরনো হয় না? এখানেই পাণ্ডবাণীর কর্ত্রীদের কৃতিত্ব। সীমা ঘোষ এবং তীজন বাঈ স্বয়ং মহাভারতের বিভিন্ন পর্ব নিয়ে কথকতার সময় নিজের দেশ, কাল ও পারিপার্শ্বিক - সব কিছু মাথায় রেখেই মহাভারতের চরিত্রদের উপস্থাপন করেন। এ প্রসঙ্গে তীজন বাঈ নিজেই একসময় দর্শকদের কৌতূহল নিবৃত্ত করতে বলেছিলেন, "মহাভারত কোনও সমাজবিচ্ছিন্ন কাহিনী নয়। আজ আমাদের সমাজে যা ঘটছে তা সবই ছিল মহাভারতের কালে এবং মহাভারতের সময় যা যা ঘটেছিল সে সবই আমরা দেখতে পারছি এখন।'

     

    আরও পড়ুন:শ্রীলঙ্কার দুর্দশা বাকিদের শিক্ষা

     

    আর তাই কৌরব রাজসভায় পাশায় পণ রেখে যুধিষ্ঠির হেরে যাওয়ার পর দ্রৌপদীকে দুঃশাসন কীভাবে বস্ত্রহরণ করতে উদ্যত হয়, সেই পরিচিত আখ্যান পাণ্ডবাণীর কথক (এখানে সীমা ঘোষ) দর্শকদের সামনে মেলে ধরতে ধরতেই প্রশ্ন তোলেন, ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য্য, কৃপ প্রমুখ জ্ঞানীগুণী মহারথীরা রাজসভায় উপস্থিত থাকতেও দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টায় বাধা দিলেন না কেন? এরপরই কথক প্রশ্ন তোলেন, নারীর এই অবমাননা কেন এভাবে সবাই চোখ বুজে চলতে দেবে? কেন দিল্লি, হাথরস, উন্নাও এবং আরও অনেক জায়গায় এ ভাবে নারীর সম্মান হানির ঘটনা চলতেই থাকবে? মহাভারতের দ্রৌপদী যেন আজকের দিনের দ্রৌপদীদের হয়ে সমাজের ক্লীবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। দোহাররা গান ধরেন-রাজা অন্ধা, রাজ্য ভি অন্ধেরা হো গয়্যা। অর্থাৎ, যে দেশে রাজা ন্যায় বিচার দিতে অপারগ, সেখানে আইনের শাসনই অন্তর্হিত। পাশা খেলায় নিজে হেরে যাওয়ার পরে কী করে দ্রৌপদীকে বাজি রাখেন, তার যৌক্তিকতা ও নৈতিকতা নিয়ে ইরাবতী কার্ভে থেকে শুরু করে বহু টিকাকারই প্রশ্ন তুলেছেন।  পিটার ব্রুকের মহাভারত নাটকে দ্রৌপদীর ভূমিকায় অবতীর্ণা মল্লিকা সারাভাইকেও দেখি যুধিষ্ঠিরের ওই কাজের তীক্ষ্ণ সমালোচনা করতে। তীজন বাঈয়ের সুযোগ্যা শিষ্যা সীমা ঘোষ আর এক ধাপ এগিয়ে পুরাণের দ্রৌপদীর সঙ্গে সমকালীন সমাজে লাঞ্ছিতা, নিগৃহীতা নির্ভয়াদের বিনা দ্বিধায় একাসনে বসান।

     

     

     কৌরব রাজসভায় দ্রৌপদীর অবমাননা যদি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ এবং কৌরব বংশ ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে থাকে, তা হলে ছলে বলে কৌশলে দুর্যোধনকে ভীমের কাছে পরাজিত করা ও পরে মৃত্যুর জন্য মূল চক্রী কৃষ্ণকে ঠিকই চিনেছিলেন গান্ধারী। তাই শতপুত্রহারা গান্ধারীর তীব্র অভিশাপ নেমে আসে কৃষ্ণের জীবনে, যদুবংশ ধ্বংসের আগাম বারতা দিয়ে। তীজন বাঈ নিজেই স্বীকার করেন যে পাণ্ডবাণীর অনুষ্ঠানে তিনি নিয়ম করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করে থাকেন। এদিনের অনুষ্ঠানেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্ভবত সমকাল, সমাজ ও দেশ সম্পর্কে সচেতন এবং অভিজ্ঞ শিল্পী গান্ধারীর প্রতি কিছুটা বেশিই পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে আবারও নারীর মর্যাদা ও অধিকারের কথা মনে করিয়ে দেন। ছত্তীশগঢ়ের প্রত্যন্ত গ্রামের এক আদিবাসী পরিবার থেকে উঠে আসা এই শিল্পীর প্রথাগত শিক্ষা নেই। শৈশব থেকেই দাদুর কাছে পাণ্ডবাণীর গান ও কথকতা শুনতে শুনতে তাঁর এই শিল্পীজীবনের প্রতি আগ্রহ। কিন্তু এক দরিদ্র ও সমাজের প্রান্তিক অবস্থানে থাকা পরিবারের কন্যা সন্তান থেকে শিল্পী হয়ে ওঠার পথে তীজন বাঈকে বহু অপমান সইতে হয়েছিল, বাধা অতিক্রম করতে হয়েছিল। নিরক্ষর  তীজনবাঈয়ের মহাভারতের আখ্যান নিয়ে কথকতা একেবারেই স্মৃতিনির্ভর। লোকসংস্কৃতির অনেক ধারার মতোই এখানে লিখিত পাঠের ভূমিকা নেই। কিন্তু নিজে এবং শিষ্যা সীমা ঘোষের সুবাদে তীজন বাঈ যে মহাভারতের পাণ্ডবাণী আমাদের শোনালেন, তা পৌরাণিক হলেও একান্তই সমসাময়িক।

     

     


    রজত রায় - এর অন্যান্য লেখা


    দলীয় রাজনীতির বাইরে মানুষের আন্দোলনই ভরসা জোগাচ্ছে

    খোদ রাজধানীর বহু জায়গাতেও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে

    করোনা মোকাবিলায় মোমবাতি নাটক দেশবাসীর কাছে দীপাবলির পরে অমাবস্যাকে ফিরিয়ে আনতে পারে।

    বাম কংগ্রেস আইএসএফ মোর্চার সমাবেশে মানুষের রাজনৈতিক দাবি শোনা গেল না।

    জগতের কোনও কিছুই সংশয়াতীত নয়, ভারতের প্রাচীন দর্শন লালিত শিক্ষা কি আজ আমরা ভুলে যাব?

    উন্নয়নের খাজনা যখন দিতেই হবে, তখন আয়করের মতো একটা স্বীকৃত ঘোষিত হার থাকলেই ভাল!

    সমকালের পুরাণ: হস্তিনাপুর থেকে হাথরাস উন্নাও-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested