প্রবল শীতের মধ্যে দিনের পর দিন রাতের পর রাত রাজধানীর উপকণ্ঠে সড়কের উপর আন্দোলনরত কৃষকরা কি শেষ পর্যন্ত সফল হবেন? সরকার যাকে কৃষি সংস্কার বলে মনে করে সেই লক্ষ্যে প্রণীত তিনটি নতুন আইন প্রত্যাহারের দাবির পরিণতি কী? এর উত্তর এখনও অজানা। কিন্তু এই আন্দোলন ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের বক্তব্য পেশের বিষয়ে আমাদের সাতটি নির্দিষ্ট নতুন শিক্ষা দিয়েছে।
কৃষক আন্দোলন এ দেশে নতুন নয়, কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তার রূপ বদলেছে। 2007 সালে 60 হাজার ভূমিহীন কৃষক ভূমি সংস্কারের দাবিতে ভোপাল থেকে দিল্লিপদযাত্রা করেছিল। 2012 সালে প্রায় 25 হাজার কৃষক একই দাবিতে আবার দিল্লিপৌঁছনোর চেষ্টা করে। তখনকার মন্ত্রী জয়রাম রমেশ আগ্রায় তাঁদেরথামিয়ে সেখানেই আলোচনা চালিয়েছিলেন। এই পদযাত্রার দাবিও ছিল ভূমি সংস্কার। এই তো কয়েক মাস আগে কৃষক সহ আরও অনেক গণ সংগঠনের মহামিছিল মহারাষ্ট্রে কয়েকশো কিলোমিটার হেঁটে মুম্বাই পৌঁছেছিল। বয়স্ক মানুষদের তেভাগা আন্দোলনের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? অথবা 1987 সালে মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের নেতৃত্বে দিল্লিতে কৃষকদের সেই মহাজমায়েত। তেভাগা আন্দোলনে কৃষকেরা ফসলের ভাগ চেয়েছিল, টিকায়েতের দাবি ছিল কৃষি পণ্যের উপযুক্ত দাম ও ভর্তুকি। বর্তমানের কৃষক আন্দোলন চাইছে, চাষিকে বাঁচানোর জন্য নতুন নীতি প্রণয়ন করা হোক।
আরও পড়ুন: বঞ্চিত সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েই অতীতে সাফল্য পেয়েছে বামপন্থীরা
গত 30 বছরে কৃষি ও চাষি এক মহাসংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। আমরা ভুলে যাইনি যে 3 লক্ষ 30 হাজারের বেশিচাষি আত্মহত্যা করেছেন; ফি বছর কোনও না কোনও ফসল রাস্তায় ফেলে চাষিরা তাঁদের হতাশা আর ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। কখনও ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে, কখনো ঋণ মুকবের দাবিতে, কখনও সরকার যাতে আরও ফসল কেনে, এই দাবিতে তারা রাস্তায় নেমেছেন। এবারের কৃষক আন্দোলন তো সরকারি নীতি ও নীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়ার মূলে আঘাত হেনেছে। কৃষির তিনটি আইন যে ভাবে প্রথমে অধ্যাদেশ ও পরে গায়ের জোরে দুই সংসদে পাস করানো হল, সেই প্রক্রিয়া কতটা ন্যায়সঙ্গত ছিল, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে এবারের আন্দোলন। আগের নানা গণ-আন্দোলন ও এবারের কৃষক আন্দোলনকে একসঙ্গে দেখলে সামাজিক আন্দোলনের কয়েকটি ক্রমশ প্রকাশ্য বৈশিষ্ট আমাদের কিছু নতুন শিক্ষা দেয়।
সংসদের বাইরে আলোচনার গুরুত্ব বাড়ছে
এক, গণতন্ত্রে বড় রকমের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধু সংসদীয় প্রক্রিয়া নয়, তার সঙ্গে সংসদের বাইরে বৃহত্তর সমাজের পরিসরে আলোচনা বিতর্কের প্রয়োজন আরও বেশি করে জরুরি হয়ে উঠছে। সংসদ মূলত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের জায়গা। সেখানে তাঁরা মতামত ব্যক্ত করেন, তারপর সংখ্যার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। সংসদীয় পদ্ধতিকে জোরদার করার জন্য সিলেক্ট কমিটি নামক একটা প্রক্রিয়া আছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদের সিলেক্ট কমিটি আছে, সেখানে অনেক রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা একসঙ্গে আলোচনা করেন, এবং সর্বসাধারণের মতামত আহ্বান করেন। প্রয়োজনে তারা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেন, তারপর সব বিচার করে একগুচ্ছ সুপারিশ করেন। সংসদ সেই সুপারিশ গুলিকে বিচার করে। এই প্রক্রিয়াটি বহু ক্ষেত্রেই দলীয় ভাবনার উপরে উঠে কাজ করেছে, এবং সাধারণ ভাবে এই প্রক্রিয়ার কোনও দুর্নাম শোনা যায় না। কিন্তু গত দশ বছরে, বিশেষত গত ছয় বছরে শাসক দল গায়ের জোরে সিলেক্ট কমিটিকে এড়িয়েই সংসদে গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলি পাশ করিয়েনিচ্ছে। ফলে সংসদীয় প্রক্রিয়াটি এখন সামান্য একটি পাটিগণিতের অঙ্কের হিসেবে পরিণত হয়েছে। এরপর সংসদে আলোচনা করার কি সত্যি আর দরকার আছে? সংসদে কে কী বলবেন তা তো বাকিরা সবাই জানেন, সেটা রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়, আর অন্য লাইনে সদস্যরা তাঁদের ভোট দিলেই তো হয়, এ কথাও কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: নিজের ভাল পাগলেও বোঝে, চাষিরা বোঝে না?
আমাদের দেশের নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি যে বিপজ্জনকভাবে একটি ফাঁকা আওয়াজে পরিণত হয়েছে, কৃষক আন্দোলন আবার তা দেখিয়ে দিল। কৃষির বাজারিকরণ নিয়ে নীতি হল, কিন্তু 300-র বেশি কৃষক সংগঠনের একটির সঙ্গেও আলোচনা করা হল না। একইভাবে চারটি শ্রমিক আইন নিয়েও কয়েকশো শ্রমিক সংগঠনের একটির সঙ্গেও আলোচনা হয়নি। উদাহরণ আরও আছে, কিন্তু এখান থেকে একটা বড় শিক্ষা এই যে, সংসদীয় প্রক্রিয়ার উপর আর আস্থা রাখা সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক দলের পরিধির বাইরেই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন
দুই, এবারের এবং আগের কৃষক আন্দোলন এবং আরও বেশ কিছু গণ-আন্দোলন থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলির পরিসরের বাইরেই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনগুলি গড়ে উঠছে। এটা একটা নতুন বাস্তবতা, যা হয়তো আমরা এখনও পুরোটা বুঝে উঠতে পারিনি। এই আন্দোলনগুলি ইস্যুভিত্তিক, এবং ক্ষমতাকামী নয়। এগুলির কোনওটাই রাষ্ট্রক্ষমতা দাবি করে না, সমস্যার সমাধান দাবি করে। অদ্ভুত কথা এই যে, রাজনৈতিক দলগুলির কাছে মানুষ আর ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন প্রত্যাশা করে না, প্রয়োজনে নিজেরাই সংগঠিত হয়ে মাঠে নেমে পড়ে। পরিবেশ আন্দোলন, মেয়েদের অধিকার ও সুরক্ষার আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, নাগরিকত্ব আন্দোলন, খাদ্যের অধিকারের আন্দোলন, জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন- সব জায়গাতেই আগে এগিয়েছে মানুষ, রাজনৈতিক দল ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করেছে। এটা পরিষ্কার যে, ভবিষ্যতেও ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন রাজনৈতিক দলের পরিসরের বাইরেই হবে। রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষে ইস্যুভিত্তিক গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব কিনা, এ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
ছাপমারা রাজনৈতিক দল ও নেতারা স্বাগত নন
তিন, কৃষক আন্দোলনের একটা বড় বিশেষত্ব এই যে, খুব সচেতনভাবে তারা রাজনৈতিক রঙের থেকে নিজেদের আলাদা রাখছে। 10 সেপ্টেম্বর হরিয়ানার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও এক নেত্রী টিকরি বর্ডারে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের কৃষক নেতারা মঞ্চে উঠতে দেননি। এমনি অন্য সব রাজনৈতিক দলকেও বলে দিয়েছেন দলীয় পতাকা নিয়ে, দলীয় টুপি পরে যেন কোনও রাজনৈতিক নেতা/কর্মী আন্দোলনে না আসেন। কৃষক নেতাদেরস্পষ্ট বক্তব্য, সাধারণ মানুষ হিসেবে সবাই স্বাগত, কিন্তু দলের কর্মী-সমর্থক হিসেবে কেউ স্বাগত নয়। শাহিনবাগেও এই বৈশিষ্ট দেখা গিয়েছিল। গণআন্দোলনের এই বৈশিষ্ট বেশ নতুন। এই কিছুদিন আগেও গণ-আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে কুক্ষিগত হয়ে যেতে দেখেছি, এই বাংলায়। কিন্তু গত এক দশকে অনেকগুলি গণআন্দোলনের মধ্যে রাজনৈতিক দলের রং থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলার প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষক আন্দোলনে এসে তার একটা বেশ পরিণত রূপ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতের জন্য এটা পরিষ্কার যে, এই ধরনের জনআন্দোলন দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবে।
পরিচিত নেতৃত্ব না থাকলেও সুসংগঠিত শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলন
চার, কৃষক আন্দোলন ও আগের বেশ কিছু আন্দোলন আবার দেখিয়ে দিল যে, সেগুলি কতটা সুসংগঠিত, শান্তিপূর্ণ ও অহিংস হতে পারে। আমাদের সাধারণ ধারণা এই যে, গণ-আন্দোলন গড়তে গেলে যে সাংগঠনিক শক্তি লাগে তা একমাত্র রাজনৈতিক দলগুলির আছে, তার বাইরে আন্দোলন সাধারণত খুবই স্বতঃস্ফূর্ত ও ক্ষণস্থায়ী হয়। কৃষক আন্দোলন সমেত সাম্প্রতিক কালের একাধিক গণ-আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে, রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শক্তি ব্যতিরেকেও ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব। তার জন্য যে সাংগঠনিক দক্ষতা, পরিকল্পনা ও শক্তি লাগে তা এমন কিছু আসাধ্য নয়। আর হিংসা? ভাবুন তো, হাজার হাজার মানুষের পদযাত্রা গুলি? 2007 সালের পদযাত্রায় সামিল মধ্যপ্রদেশের এক কৃষক নেতা আমাকে বলেছিলেন অহিংসার কথা। হাইওয়েতে রাত্রিবেলায় এক লরি চালক টাল সামলাতে না পেরে মিছিলে ধাক্কা মারে, এক মিছিল যাত্রীর মৃত্যু হয়। রাজনৈতিক দলের মিছিল হলে কী হত আমাদের সবার জানা। এক্ষেত্রে কিন্তু সেই লরি চালককে বন্দি করা হয়, তাকে পরদিন সকালে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তার গায়ে আঁচড় পর্যন্ত লাগেনি। এই ধরনের সামাজিক আন্দোলন যে সাধারণত শান্তিপূর্ণ হয়, অহিংস হয় তার উদাহরণ ভুরিভুরি। আন্দোলনগুলির নৈতিক বল এতটাই বেশি থাকে যে, শান্তিভঙ্গের দরকার পড়ে না। এবারের কৃষক আন্দোলনও সেটাই আবার প্রমাণ করল।
সাধারণ মানুষের স্বত্ঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে সহায়তা
পাঁচ, রাজনৈতিক দলের পরিসরের বাইরে বিভিন্ন সময়ে যে সব আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তার আর একটা শিক্ষা হল, এই আন্দোলন গুলিকে সাধারণ মানুষ ও সমাজের অন্য নানা অংশের সহযোগিতা করা। মনে পড়ছে সেই জুতার ব্যবসায়ীর কথা, যিনি মহারাষ্ট্রের পদযাত্রায় সামিল আন্দোলনকারীদের জন্য তার চপ্পলের সমস্ত স্টক নিয়ে এসেছিলেন, এবারের কৃষক আন্দোলনে হাইওয়ের পাশে অনেকে তাঁদের গুদাম খালি করে দিয়ে আন্দোলনকারীদের থাকতে দিয়েছেন, রাস্তার ধাবায় বিনামূল্যে দিনের পর দিন খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এরকম উদাহরণ আরও কত আছে। আর কত যে প্রতিষ্ঠিত গুণী মানুষ এই আন্দোলনগুলির পাশে দাঁড়িয়েছেন, তার হিসাব নেই। বিদ্যা-সংগীত-চলচিত্র-নাট্য-খেলাধুলা-শ্রম- প্রায় সব জগতের গুণী মানুষদের সমর্থন আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তিকে ও সার্বজনীনতাকে আরও জোরদার করেছে। রাজনৈতিক দলের আন্দোলনে সেটা একেবারেই দেখতে পাওয়া যায় না। এই আন্দোলন গুলি যত স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক দলের থেকে দূরে থাকতে পেরেছে, ততটাই বৃহত্তর জনসমর্থন আদায়ে তারা সক্ষম হয়েছে।
আরও পড়ুন: নতুন কৃষি আইন: ফড়েরা যা হারাবে তা কি চাষি পাবে?
পেশীশক্তি, অর্থবল এবং ক্ষমতার দম্ভের রাজনীতি অনুপস্থিত
ছয়, সাম্প্রতিক কালে রাজনৈতিক দলগুলির প্রকাশ্য কুৎসা, অশালীনতা, পুরুষালি দম্ভ ও কালো টাকার উজ্জ্বলতায় জনগণ তাঁদেরওপর বীতশ্রদ্ধ। রাজনীতির ভাষার সঙ্গে খেউড়ের ভাষার তফাত পাওয়া যাচ্ছে না, মোটর বাইক আর এসইউভি-র কনভয় এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার সবচেয়ে বড় প্রকাশ। রাজনৈতিক মিছিলের প্রধান অস্ত্র এখন ইঁট পাটকেল, ছুরি, পিস্তল, তরোয়াল, রাইফেল। রাজনৈতিক কর্মীদের চোখে দামি গগলস, মুখে হিংসার আগুন – এটাই পাবলিক রাজনীতির পরিচিত ছবি। শুধু কৃষক আন্দোলন কেন, যে কোনও গণ-আন্দোলনকে তার পাশে রাখলে, এগুলির শৃঙ্খলা, শালীনতা, স্বতঃস্ফূর্ততা, তার পোশাকের বৈচিত্র, শ্লোগানেরঅভিনবত্বে, তার আঞ্চলিক বৈচিত্র্যে এই আন্দোলন গুলির সার্বজনীনতা, স্বচ্ছতা ও নাগরিকত্বে-র আসল রূপটি ধরা পড়ে। দলীয় রাজনীতি একদিকে যেমন ভিড়ের, মত্ততার ও দম্ভের রাজনীতি হয়ে গেছে, অন্যদিকে কৃষক আন্দোলনের মতোগণ-আন্দোলন গুলি নতুন করে আমাদের সার্বজনীনতার ধারণায় আস্থা রাখতে সাহায্য করছে।
দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়েই আন্দোলনে নামা
সাত, কৃষক আন্দোলন ও নাগরিকত্ব আন্দোলন, এমনকি আন্না হজারের আন্দোলনেও একটা নতুন বৈশিষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ইস্যুভিত্তিকগণ-আন্দোলন সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয়। এর কয়েকটি কারণ খুব স্বাভাবিক। গণ-আন্দোলন পূর্ণ সময়ের রাজনৈতিক কর্মী দিয়ে তৈরি হয় না, দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়ার মতো রসদ তাঁদের থাকে না, গণআন্দোলনে আবেগের মাত্রা সাধারণত বেশি থাকে, আবেগের প্রকৃতিটাই এখানে ক্ষণস্থায়ী এবং আরও অনেক কিছু। কৃষক আন্দোলনে প্রথম থেকেই দেখছি, আন্দোলনকারীরা অনেকদিনের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন, শাহিনবাগের আন্দোলনও দেখাল কীভাবে তিন মাস আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া যায়। প্রস্তুতির অনেক দিক আছে। খাদ্য, পানীয়, মাথার ওপরে সামিয়ানা, বাচ্চাদের পড়াশোনা, যারা বাড়িতে রয়ে গেলেন তাঁদেরদেখাশোনার ব্যবস্থা, এমনকি কাপড় কাচা, টয়লেট, অসুস্থদের দেখাশোনা, প্রচারের ব্যবস্থা, আরও কত কি। কৃষক আন্দোলনে দেখলাম ধোপার সার্ভিস চালু হয়ে গেছে, শাহিনবাগে দেখেছিলাম বাচ্চাদের দৈনন্দিন দুধের ব্যবস্থা, নিয়মিত ডাক্তারদের ভিজিটের ব্যবস্থা, এমনকি বাচ্চাদের স্কুল চলছে নিয়মিত। অর্থাৎ, গণআন্দোলনের মধ্যে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে সরকারের দম্ভ, স্থবিরতা ও আন্দোলনকে ক্লান্ত করার চেষ্টা একদিকে যেমন স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে বোধহয় প্রতিটি জনআন্দোলন থেকে অন্যেরা শিক্ষা নিচ্ছে, বুঝতে পারছে দীর্ঘ লড়াইদের প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নামতে হবে।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলি জাত, অঞ্চল, গোষ্ঠী, ভাষা ইত্যাদির আবর্তে এতটাই দ্বিধা বিভক্ত, তাঁদের নৈতিকতা এতটাই তলানিতে, ক্ষমতালিপ্সা ও সেই সুবাদে দুর্নীতির কালিমায় তাঁদেরপাবলিক ইমেজ এতটাই বিপর্যস্ত, রাজনৈতিক খেউড়বাজিতে তাঁরা এতটাই ব্যস্ত, এবং তাঁরা এতটাই নির্বাচনকেন্দ্রিক মেশিন, যে বৃহত্তর কোনও ইস্যুতে নানা রাজ্য জুড়ে ব্যাপক জনআন্দোলন গড়ে তোলা তাঁদেরপক্ষে আর সম্ভব নয়। নির্বাচন লড়তে যেহেতু এখন আর বৃহত্তর কোন ইস্যু-র প্রয়োজন হয় না, ভাষা, জাতপাত, আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে যেহেতু নির্বাচন লড়া যায়, তাই বৃহত্তর জনস্বার্থের কোনও বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এখন আর মুখ্য এজেন্ডা নয়। তারা নির্বাচন লড়তে জানে, নির্বাচনে কী বলে মানুষকে সংগঠিত করা যায় তা জানে, কিন্তু বৃহত্তর জনস্বার্থে আন্দোলন করতে গেলে যে নৈতিক বল লাগে তা তাঁদেরনেই, মানুষের কাছে তারা সেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। মানুষ এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য যায়, সেই মানুষই ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে দলগুলিকে পাশে সরিয়ে রাখে। রাজনৈতিক দলগুলো এটা জানে। তারা ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টায় কসুর করে না, অরবিন্দ কেজরিওয়াল তার সর্বশেষ প্রমাণ। তবে ক্রমশ এটা পরিষ্কার হচ্ছে যে, জনতার সম্মিলিত কণ্ঠ একটা মূল শক্তি এবং তা ভবিষ্যতে এই ধরনের গণ-আন্দোলন থেকেই আসবে, রাজনৈতিক দলের কোল থেকে নয়।
(লেখক বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের School of Development-এর অধ্যাপক)
আধুনিক রাষ্ট্র,কল্যাণ, উন্নয়ন আর ন্যায়ের তত্ত্ব আর তথ্য দিয়ে সে সমাজকে বোঝা যাবে না।
কৃষকদের গণ-আন্দোলনেই জনতার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলের স্লোগানে নয়।
পুলিশকে গণতান্ত্রিক শাসনের অঙ্গ হতে গেলে, জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক কী হবে এই প্রশ্নটা বড়ই জরুরি