×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • গুরু ও ভক্ত-দাস নিয়ে গড়া সমাজই ভারতের ভবিতব্য; ​​​​​​সেখানে উন্নয়ন, ন্যায়, জনকল্যাণ হয়ে যাচ্ছে গৌণ

    অশোক সরকার | 16-11-2020

    প্রতীকী ছবি

    নির্বাচন বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে আমরা ভাবি একটা নির্বাচন হচ্ছে, আসলে হচ্ছে দুটো। একটা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলেরা লড়ে দেশে বা রাজ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য, আর মানুষ প্রতিটা ভোটে কাকে ভোট দেবে সেটাও মনে মনে নির্বাচন করে। দলগুলির কাছে নির্বাচন লড়ার জন্য নানা ইস্যু থাকে কেউ বলে কত কাজ করেছি দেখো’, কেউ বলে, ‘ও তো কোনও কাজ করেনি’, কেউ বা বলে ওরা এলে এই হবে, বা ওরা তো আমাদের জাত শত্রুআর মানুষ মনে মনে কী বলে? ‘ও আমাদের জাতের লোক’, ‘সে তো ওই জাতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে’, ‘ওরা এলে আমাদের শেষ করে দেবে’, অথবাসে তো পাল্টি খাওয়া লোক’, আরও কত কী! মানুষের মনের নির্বাচন আর দলের লড়াই মিলে চলে নির্বাচনের প্রক্রিয়া। 

     

    দলগুলি একটা নির্বাচনী ইস্তেহার বের করে, তাতে অনেক কথা লেখা থাকে। মানুষের কজন ইস্তেহার পড়ে মন ঠিক করে? আজ পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, ইস্তেহার পড়ে কেউ মন ঠিক করে না। আর নির্বাচনের সময় আগের বার ইস্তেহারে কী লেখা হয়েছিল, তা নেতারাই মনে করতে পারেন না, জনতা তো ও কথা বললে হাসে। তার মানে ইস্তেহার দিয়ে নির্বাচন বোঝা যাবে না। ময়দানের বক্তৃতায় নেতারা অনেক কথা বলেন। তার বিশ্লেষণ  করলে দেখা যায়, কিছুটা বিপক্ষ দলকে আক্রমণ, কিছুটা বিপক্ষ নেতাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ, ক্ষমতাসীন দল হলে কিছুটা নিজেদের জয়গান, আর কিছুটা স্বপ্ন দেখানো। নানা দলের ময়দানের বক্তৃতা শুনে মন ঠিক করেছে, এমন মানুষ এক হাতে গোনা যায়, কাজেই তা দিয়েও নির্বাচন বোঝা যাবে না। নির্বাচনের আগে নানারকম সার্ভে হয়, তাতে মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন ইস্যুটা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ নানারকম বলে, কিন্তু কদিন বাদে ভোটের ফলাফলের সঙ্গে তা মেলে না। ভারতে রাজস্থান, কেরল, তামিলনাড়ুতে পাঁচ বছর অন্তর সরকার পাল্টে যায়, প্রকৃতির নিয়মের মত। আবার 20-30 বছর একই দল রাজ্য শাসন করেছে, এমন উদাহরণও ভুরি, ভুরি। 

     

    গণতন্ত্রে নির্বাচনের গুরুত্ব নাকি অপরিসীম। মূল কথা হচ্ছে, মানুষ যেহেতু নিজেদের ভাল-মন্দ বোঝে, তাই তাদের সরকার ঠিক করতে বললে, তারা যে সরকার তাদের ভাল করবে তাদের-ই ঠিক করবে। একই কারণে মানুষ তাদের সঠিক প্রতিনিধি বেছে নেবে। ভোট আর সিট দিয়ে তা বোঝা যাবে। এই সরল ফর্মুলার একটা বড় সীমাবদ্ধতা নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে। আমেরিকার জয়ী সব নিয়ে যাবেবা ভারতের পোস্ট যে প্রথম পার করবেএবং অন্যান্য আরও যে নির্বাচনী পদ্ধতি আছে, তা কোনটা কতটা মানুষের পছন্দকে প্রতিফলিত করে তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ভারতে 20% ভোট পেয়েও সরকার গড়া যায়, সেটা 80% মানুষের পছন্দকে প্রতিফলিত করে না।  

     

    আমার প্রশ্ন সেটা নয়, আমার প্রশ্ন মানুষ ভাল-মন্দ বলতে কী কী বোঝে? ভাল-মন্দ বলতে কি শাসনতন্ত্রের গুণমান বোঝে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টি-রোজগার-চাকরি-সড়ক-বিদ্যুৎ-জল-ফ্লাইওভার-মল-এয়ারপোর্ট-ট্রেন বোঝে, নাকি মেয়েদের সুরক্ষা-স্বাধীনতা, দলিতদের সম্মান, শিশুদের আনন্দ, বয়স্কদের শান্তি-স্বস্তি, সামাজিক শান্তি-সৌহার্দ্য, ইত্যাদি বোঝে? না কি অন্য কিছু? কেন ভুরি ভুরি নির্বাচিত প্রার্থী পরিচিত ক্রিমিন্যাল? যে নির্বাচিত প্রার্থী পাল্টি খায়, সে আবার দিব্যি কীকরে জিতে ফিরে আসে? তাহলে কি মানুষের ভাল-মন্দ বোঝার চোখটা বদলে গেছে? এইখানে একটু ফিরে দেখার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। 

     

    90-র দশক থেকে ভারতের নির্বাচনী রাজনীতির মূল ধারাটি, জাত-পাত, আঞ্চলিকতা, ভাষা ও ধর্ম দিয়ে আবর্তিত হয়েছে। আজকের TDP, TRS, AIADMK, BJD, JDS, BSP, SP, JDU, RJD, JMM, RLD, LJP, MQM, YSR-Congress, শিবসেনা এবং মণিপুর,নাগাল্যান্ড, মিজোরামর আঞ্চলিক পার্টিগুলির সেটাই ভিত্তি। 90-এর দশককে বলা হত সামাজিক ন্যায়ের জমানা, কারণ ওই দশকে বহুজন সমাজ ভারতের রাজনীতির আঙিনায় উঠে এসেছিল সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, জনতা দল সেকুলার ইত্যাদি পার্টির হাত ধরে। সেই সঙ্গে আরও অনেক জাত ও আঞ্চলিকতা নির্ভর পার্টির উত্থান ঘটে, যেমন তেলুগু দেশম, অসম গণ পরিষদ ইত্যাদি। এই সব দলের উত্থান ও অগ্রগতিতে রাজনীতির ব্যাকরণ অনেকটাই বদলে যায় আমাদের দেশে। আজকের বিজেপি-র উত্থানও ওই একই সময়ে। 

     

    মানুষের ভাল-মন্দ বোঝার সঙ্গে ওই ব্যাকরণের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। জাতপাত, আঞ্চলিকতা, ভাষা, ধর্ম দিয়ে, রাজনীতি আবর্তিত হওয়ার পাশাপাশি মানুষের ভাল-মন্দ চিনে নেওয়ার আতস কাঁচটিও বদলে গেছে। উন্নয়ন, জনকল্যাণ ও সামাজিক ন্যায় মাপার জন্য যেসব সূচক ব্যবহার হয়, সেগুলি দিয়ে মানুষ তার নিজের ভাল-মন্দ বোঝে না; তার ভাল-মন্দ বোঝার সূচকগুলি অন্য। একটা দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক। বি জে পির সমর্থক প্রায় সবাই মনে করে (1) মুসলমান-রা আমাদের শত্রু, (2) মোদীর আমলে রাম মন্দির হয়েছে। এর একটা মিথ্যে একটা সত্যি, কিন্তু দুটোর কোনওটার সঙ্গেই নিজের বা দেশের ভাল-মন্দের পরিচিত সূচকের কোনও সম্পর্ক নেই। নীতীশ কুমার-এর জাত কুর্মি, বিহারের সব নির্বাচনেই কুর্মিদের 98% নীতীশ কুমারকে ভোট দেয়। এটার ভিত্তি জাতি-আত্মীয়তা। তার সঙ্গে নিজেদের বা রাজ্যের ভাল-মন্দের কোনও সম্পর্ক নেই। যাদব, কামা, পাসোয়ান, জাঠ, গুজ্জর, প্যাটেল, রাজপুতরা, তাদের পছন্দের জাত পার্টিকে ভোট দেয়, সেখানে ভিত্তিটা আসলে জাতি-আত্মীয়তা। একই ভাবে আঞ্চলিকতা, বা ভাষা আত্মীয়তার কথাও বলা যায়। 

     

    রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন জিততে গেলে অবশ্য শুধু নিজেদের জাতের ভোট পেলে চলে না, জাতে-জাতে বা বিভিন্ন সামাজিক গ্রূপের মধ্যে সমীকরণ তৈরির দরকার হয়। এই প্রক্রিয়াটা ব্যক্তি বা সমুদায়ের ভাল-মন্দ চেনার প্রক্রিয়া থেকে একটু আলাদা। এর মধ্যে একটা অংশ পার্টি প্রক্রিয়া - সেখানে সিট সমঝোতা, মন্ত্রী সমঝোতা, টাকা পয়সার লেনদেন আছে তার পাশাপাশি একটা সামাজিক প্রক্রিয়া চলে- সেখানে এই সমীকরণগুলি গ্রামে গ্রামে, মহল্লায় মহল্লায় ঝালাই করতে হয়। এখানে কিছুটা টাকা পয়সার খেলা আছে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি আছে, স্থানীয় সামাজিক বোঝাপড়া। এই বোঝাপড়ার ভিত্তি কী? এ নিয়ে যা গবেষণা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, সামাজিক অবস্থানে, স্থানীয় ক্ষমতার সমীকরণে শত্রু-মিত্রতায় কারা দূরে, কারা কাছে, তার উপর ভিত্তি করে বোঝাপড়া তৈরি হয়। যেখানে আঞ্চলিকতা বা ভাষাও ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে এই বোঝাপড়ার সমীকরণে ওই মাত্রাগুলিও যুক্ত হয়। সমাজ বিশ্লেষকেরা এই রাজনীতিকে পরিচয়ের রাজনীতি নাম দিয়েছেন। জাত, অঞ্চল, ভাষা, ধর্ম ভিত্তির পরিচয়। নাগরিক পরিচয়ের থেকে তা আলাদা। জাত-ভাষা-অঞ্চল ভিত্তিক সমুদায় এখন ভারতীয় রাজনীতির ভিত্তি, রাজনৈতিক সমুদায় নয়। রাজনৈতিক সামুদায়িকতা তৈরী হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামকে ঘিরে; আপামর ভারতীয় নিজেদের জন্ম থেকে পাওয়া সামুদায়িকতা মনে রেখেও সেই সময়ে এক বৃহ্ত্তর সামুদায়িকতার খোঁজ পেয়েছিল।

     

    পরিচয়ের রাজনীতি যত শক্তিশালী হয়েছে, তত মানুষের নিজেদের ও দেশের ভাল-মন্দের ধারণাগুলি বদলে গেছে। ভাল-মন্দের ধারনাগুলি এখন আর খাদ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, বিজলি, পানি, বন্যা, খরা, ইত্যাদি পার্থিব ধরা-ছোঁয়ার বিষয় দিয়ে নয়, নানা প্রতীকী বিষয় দিয়ে তৈরি হয়। যেমন এই ধরনের বিষয়: ‘ও আমাদের লোক’, ‘এ নবীন’, ‘সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মূর্তি বানিয়েছে’, ‘ও পাকিস্তানকে টাইট দিয়েছে’, ‘আমাদের জাতের নেতার নাম রাস্তা হয়েছে’, ইত্যাদি। এই রাজনীতিতে প্রতীক, টোকেন, হিরো, মুখপাত্র ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ নিজেদের ভাল-মন্দ খোঁজে; উন্নয়ন, জনকল্যাণ, ন্যায়-এর এজেন্ডা খোঁজে না। রাজনৈতিক দলও তখন আর ওই সব বিষয় নিয়ে কথা বলে না, বললেও সেটা নাম কে ওয়াস্তে হয়ে যায়। সেই কারণেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নিজেকে হিন্দু প্রমাণ করতে হনুমান চাল্লিসা আওড়াতে হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মসজিদে-মন্দিরে দু জায়গাতেই যেতে হয়, নিজেকে সেকুলার প্রমাণ করতে। 

     

    জাতপাত, অঞ্চল, ভাষা, ধর্মের রাজনীতি গত 20/25 বছরে রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে চলে এসেছে। প্রথম দিকে তা ভারতের বৈচিত্রের প্রকাশ বলে মনে হলেও এখন বোঝা যাচ্ছে, তাতে তিনটি ক্ষতি হয়েছে। এক, রাজনীতির পরিসরটি বহু বিভক্ত হয়ে গেছে; দুই, গণতন্ত্রের মূল ধারণা যে সব মানুষ সমান, আর উন্নয়নের মূল ধারণা যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সম্মানজনক কাজ, পরিবেশ সংরক্ষণএই সব বিষয় আর রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় নেই; তিন, ভারতের সমাজের বহু বিভাজন আরও পোক্ত হয়ে বসেছে আর এইসবের ফলে সরকারের গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার প্রয়োজনটাই এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। 

     

    গত ছয় বছরে একটা নতুন ঘটনা ঘটেছে। সমাজের এই বহু বিভাজনের সুযোগে অনেক মানুষ  ব্রাহ্মণ্যবাদের মধ্যে একটা নতুন সামুদায়িকতার খোঁজ পাচ্ছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদ বললে হলে পানি পাওয়া যাবে না, তাই তার নাম হয়েছে হিন্দুত্ব জাত-ভাষা-অঞ্চল মূলত স্থানীয় পরিচিতি, তা দিয়ে বড়জোর রাজ্য চালানো যায়, কিন্তু দেশ চালানো যায় না। দেশ চালাতে গেলে একটা রাজনৈতিক সামুদায়িকতার প্রয়োজন হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদ আজকে সেই রাজনৈতিক সামুদায়িকতার আধার। কিন্তু দুটো মুশকিল আছে। প্রথমত, ব্রাহ্মণ্যবাদ তার নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মেয়েদের, দলিতদের, আদিবাসীদের ও সংখ্যালঘুদের আলাদা করে, তাই তা সমাজের এক বিশেষ অংশের সামুদায়িকতা আর দ্বিতীয়ত, ব্রাহ্মণ্যবাদ সংবিধান, আইনের শাসন, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ক্ষমতার পৃথকীকরণ মানে না, তাই তা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে পারে না, কিন্তু এক ধরনের সমাজ তৈরি করতে পারে। ভারতে তাই হচ্ছে, দেশ-রাষ্ট্র ভাঙছে, ব্রাহ্মণ্যবাদ ভিত্তিক সমাজ জাগছে। জাতপাত, ভাষা, অঞ্চলের রাজনীতিও ক্রমশ কিছুটা হলেও ভেঙে যাচ্ছে। এটা নিশ্চিত যে, এই পথ প্রশস্ত করতে গেলে দেশ- রাষ্ট্রকে আরও ভাঙতে হবে। এমন একটা সময় আসবে যখন দেশ-রাষ্ট্র নামেমাত্র থাকবে, ব্রাহ্মণ্যবাদের নিয়মে চলবে সমাজসে সমাজ গুরু আর ভক্ত-দাসের সমাজ। আধুনিক রাষ্ট্র,কল্যাণ, উন্নয়ন আর ন্যায়ের তত্ত্ব আর তথ্য দিয়ে সে সমাজকে বোঝা যাবে না।

     

    লেখক আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

     


    অশোক সরকার - এর অন্যান্য লেখা


    পুলিশকে গণতান্ত্রিক শাসনের অঙ্গ হতে গেলে, জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক কী হবে এই প্রশ্নটা বড়ই জরুরি

    আধুনিক রাষ্ট্র,কল্যাণ, উন্নয়ন আর ন্যায়ের তত্ত্ব আর তথ্য দিয়ে সে সমাজকে বোঝা যাবে না।

    কৃষকদের গণ-আন্দোলনেই জনতার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলের স্লোগানে নয়।

    গুরু ও ভক্ত-দাস নিয়ে গড়া সমাজই ভারতের ভবিতব্য; ​​​​​​সেখানে উন্নয়ন, ন্যায়, জনকল্যাণ হয়ে যাচ্ছে গৌণ-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested