×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দলের পুলিশ না জনগণের পুলিশ?

    অশোক সরকার | 25-06-2020

    প্রতীকী ছবি

    গত কয়েক মাসে পুলিশের দু'টো চেহারাই একসঙ্গে দেখতে পেলাম। লাঠি পেটানো পুলিশ, আর সমাজকর্মী পুলিশ। পুলিশ সমাজকর্মী? কথাটা কি সোনার পাথরবাটির মতো শোনাচ্ছে না? কিন্তু, লাঠি পেটানো ছাড়া পুলিশের যে ভূমিকা চোখের সামনে দেখলাম, তাতে ঐ কথাটাই মনে আসে। গৃহহীনদের খাবার বিতরণ করছে পুলিশ, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে পুলিশের জিপে করে হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ, একলা থাকা অতিবৃদ্ধের ঘরে জীবনদায়ী ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ, আত্মীয়দের অনুপস্থিতিতে মৃতদেহ সৎকার করছে পুলিশ, এই ছবিগুলি চোখ এড়ানোর মতো নয়। এরকম ছবি টেলিভিশনের পর্দায় উঠে এসেছে, দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই, পুনে, একাধিক শহর থেকে। একই সঙ্গে বিভিন্ন শহরে পুলিশের সহায়তায় সাধারণ মানুষ যেভাবে এগিয়ে এসেছেন সেটাও দেখার মতো। 


    অনেকেই পুলিশের এই সমাজকর্মীর ভূমিকা দেখে বিস্মিত হয়েছেন, বলেছেন এ-ও কি সম্ভব! আমাদের কাছে, লাঠি পেটানো, কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া আর গুলি চালানো পুলিশের ছবিটাই দীর্ঘদিনের পরিচিত। গণতান্ত্রিক সমাবেশে আর মিছিলে পুলিশ লাঠি চালাবে, কাঁদানে গ্যাস দিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করবে, দরকারে গুলি চালাবে। থানায় ডেকে জেরার সুযোগে সাধারণ গরিব মানুষের উপর অত্যাচার করবে, দলিত আদিবাসী মেয়েদের ধর্ষণ করবে, এ ছবিও বিরল নয়। 


    পনিবেশিক আমলে পুলিশের এই ভূমিকাটি বোঝা সহজ ছিল। পুলিশ তখন ছিল শাসকের রক্ষক। দেশের মানুষকে ঔপনিবেশিক শাসনে দাবিয়ে রাখাটাই পুলিশের কাজ। তাই গণআন্দোলনকে দাবাতে হবে, সমাবেশ রুখতে হবে, কারফিউ, 144 ধারা জারি করতে হবে। মানুষ আইন অমান্য করবে, পুলিশ বাসে করে তাদের তুলে নিয়ে যাবে। তার পাশাপাশি, পুলিশের নামে যাতে সাধারণ মানুষ ভয়ে কাঁপে তার জন্য মানুষের মনে পুলিশের একটা দানবীয় ইমেজ গড়ে তুলতে হবে। 


    কিন্তু, গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশের ভূমিকা কী হবে? সংবিধান বলে, আমরা নাকি সবাই মিলে এই দেশে এমন একটা রাষ্ট্র তৈরি করেছি, যেখানে মানুষের জন্য, মানুষের দ্বারা, মানুষেরই শাসন। তাই যদি হয় তাহলে পুলিশ তো সেই শাসনের একটা অঙ্গ। পুলিশকে গণতান্ত্রিক শাসনের অঙ্গ হতে গেলে, জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক কী হবে এই প্রশ্নটা বড়ই জরুরি হয়ে পড়ে। এই সম্পর্কটা খুঁজতে গিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে 60-এর দশকের শেষের দিকে পুলিশি ব্যবস্থার একটি নতুন মডেল তৈরি হয়, যার পোশাকি নাম community policing; বাংলা করলে হবে সামুদায়িক পুলিশি, বা সামাজিক পুলিশি। যদিও সামাজিক পুলিশির ধারনার জন্ম আরও অনেক পুরনো। 

     


    কথার শুরুতে গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা থেকে যে উদাহরণগুলি লিখেছি, সেগুলো তাৎক্ষণিক বা ব্যতিক্রমী মনে হলেও আসলে তা নয়। এগুলি সবই সামাজিক পুলিশির কাঠামোর মধ্যে পড়ে। আরও কয়েকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা একটু স্পষ্ট হবে। ধরুন, যদি পুলিশ আপনাকে বলে, আপনি যদি হঠাৎ পড়ে গিয়ে আঘাত পান, আর তখন বাড়িতে কেউ না থাকে, আমাদের খবর দেবেন, আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাব, বা আপনি যে কুকুরটাকে রোজ খেতে দেন, সে যদি আপানার বাড়ির কুয়োয় পড়ে যায়, তাহলে আমরা এসে তাকে তুলে দেব, বা আমাদের থানার পিছনে যে ব্যাডমিন্টন কোর্ট আছে সেখানে যদি আপনার পাড়ার মেয়েরা ব্যাডমিন্টন খেলতে চায় খেলতে পারেএরকম উদাহরণ আরও দেওয়া যায়; এর কোনওটাই অবাস্তব কল্পনা নয়, আমাদের দেশেই সত্যি। শান্তিনিকেতনে দেখেছি, প্রতি বছর পুলিশ একলা থাকা অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বাসে চড়িয়ে চারপাশের দুর্গা পুজো দেখিয়ে নিয়ে আসে। ব্যাঙ্গালরে আমরা যে অঞ্চলে থাকি, সেখানে আমাদের সামনে পুলিশের বিশাল ব্যারাক; তার মাঠে পাড়ার ছেলেরা আর পুলিশ প্রায় প্রতিদিন বিকেলে একসঙ্গে ফুটবল খেলে। এলাকায় খুব বৃষ্টি হয়ে জল জমলে দেখি মিউনিসিপ্যালিটির লোক আসার আগেই, স্থানীয় জনগণ ও ব্যারাকের পুলিশ একযোগে কাজ করে জলনিকাশের ব্যবস্থা করে ফেলে। 


    শাসকের পুলিশ থেকে জনতার পুলিশ হতে গেলে জনতার সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কের আধারটি পাল্টাতে হয়। পুলিশের প্রধান দায়বদ্ধতা হতে হয় জনতার প্রতি, শাসকের প্রতি নয়, শাসক দলের প্রতি তো নয়ই। কীভাবে সেই দায়বদ্ধতা প্রকাশ পাবে? সামাজিক পুলিশির ম্যানুয়ালে এ বিষয়ে ছয়টি মৌলিক মন্ত্র লেখা আছে। বিশ্বাস ও আস্থা, খবরের স্বচ্ছ আদানপ্রদান, স্থানীয় প্রয়োজনের প্রতি নজর, জনতার ব্যক্তি ও সমষ্টিগত প্রয়োজনে সহযোগিতা, অপরাধ ঠেকানো-কমানো ও জনতার কাছে জবাবদিহি। জনগণকে শাসন করা পুলিশের কাজ নয়, জনগণের শাসন যাতে ঠিকভাবে চলতে পারে, তার জন্য জনগণের পাশে থাকা তাদের কাজ 


    সামাজিক পুলিশির যে মন্ত্রগুলি উল্লেখ করলাম, ইউরোপের অনেকগুলি দেশে সেগুলি পুলিশির মূল স্রোতে জায়গা করে নিয়েছে। এ ব্যাপারে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলি সবার চেয়ে এগিয়ে, অন্যান্যরাও খুব পিছিয়ে নয়। অপরাধ কমানো, আইনের শাসন বজায় রাখা, জনগণের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা, ন্যূনতম বলপ্রয়োগ ইত্যাদির সঙ্গে সমাজকর্মীর ভূমিকায় পুলিশকে যেভাবে দেখা যায়, যে দায়বদ্ধতা আর জবাবদিহির কাঠামোয় পুলিশ কাজ করে, তা থেকে সারা পৃথিবীর বিশেষত আমাদের তো প্রায় সবটাই শেখার আছে। 


    আমরা শিখতে শুরু করেছিলাম। আমাদের দেশে প্রায় 30 বছর আগে সামাজিক পুলিশির একটা পাইলট প্রোজেক্ট চালু হয়েছিল। বিভিন্ন রাজ্যে, কয়েকটি বিশেষ থানা নিয়ে শুরু হয়েছিল সেই প্রজেক্ট। পশ্চিমবঙ্গে শান্তিনিকেতন আর কলকাতার সল্টলেক থানা তার মধ্যে যুক্ত হয়েছিল। হয়তো আশা ছিল কোনও এক দিন মূল স্রোতের পুলিশির জায়গা নেবে সামাজিক পুলিশি। তা হয়নি। এখনও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেই সামাজিক পুলিশির কিছু হাল্কা রেশ রয়ে গেছে। নাগরিকের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কটা বিশেষ বদলায়নি। সামাজিক পুলিশির যে ছয়টি মৌলিক মন্ত্র উল্লেখ করেছি, তার একটিও মূল স্রোতে জায়গা পায়নি। 



    তার জন্য শুধু পুলিশকে দুষলে চলবে না। আমরা কখনও সমষ্টিগতভাবে দাবি করি নি যে, পুলিশ আমাদের। বরং রাজনৈতিক দলের ক্যাডার-সমর্থকের আর বাম-দক্ষিণের পরিচিতিতে তৈরি হওয়া নাগরিকতা আমাদের বলতে শিখিয়েছে বিপক্ষের লোকেদের ধরে জেলে পুরে দিলে কোনও ক্ষতি নেই, আমাদের যেন পুলিশ না ধরে। বিপক্ষের মিছিল যেন 144 ধারা করে আটকে দেওয়া হয়, আমাদের নয়। বিপক্ষের নেতা-নেত্রীদের গ্রেপ্তার করলে ক্ষতি নেই, আমাদের নেতা-নেত্রীরা যেন বিনা বিচারে ঘুরে বেড়াতে পারে। ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশির সঙ্গে আমাদের মূল স্রোতের পুলিশির একটাই বড় তফাৎ; তখন পুলিশ ছিল, ব্রিটিশ রাজের রক্ষক, আর স্বাধীনতার পরে পুলিশ হয়ে গেছে মূলত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-ক্যাডারদের রক্ষক। সাম্প্রতিক কালে তা একবারেই সব খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক দল, বিশেষত শাসক দলের সঙ্গে পুলিশের এই রাজা-প্রজার সম্পর্ক খুব সহজেই পুরনো ঔপনিবেশিক গঠনতন্ত্র ও পুলিশ সংস্কৃতিকে বজায় রেখেছে। 


    পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্কের মধ্যে একটা ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য আছে, যার জন্য পুলিশের ভিতর থেকেও নিজস্ব কোনও আভ্যন্তরীণ চাপ তৈরি হয় না। পুলিশের সব স্তরেই কিছু প্রিভিলেজ আছে যা সরকারি, আর বেশ কিছু প্রিভিলেজ আছে যা সমাজ থেকে তারা ভয়, সমীহ, আর ক্ষমতার জোরে আদায় করে। বিনা পয়সায় চা টিফিন খাওয়া থেকে শহরের দামি কল-গার্ল'-এর বিনা পয়সায় সঙ্গ পাওয়া বা কোনও ফাইভ স্টার হোটেলের রেস্তোরাঁতে পরিবার নিয়ে বিনা পয়সায় ডিনার, এগুলি পুলিশের কাছে জলভাত। সারা দেশের হিসেব নিলে এই তালিকা সংবিধানের চেয়েও লম্বা হয়ে যেতে পারে। এই প্রিভিলেজগুলির লম্বা ইতিহাস আছে। ঔপনিবেশিক আমলে, ব্রিটিশ রাজের পুলিশ বহু ক্ষমতা-বহির্ভূত প্রিভিলেজ ভোগ করত, তার মধ্যে স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করা, নেটিভদের দাস করে রাখা থেকে খাদ্য-পানীয়ের সাপ্লাই, অনেক কিছুই ছিল। সেই সংস্কৃতি স্বাধীনতার পরেও সাত দশক ধরে রয়ে গেছে। পুলিশের আভ্যন্তরীণ সংস্কৃতির এই বৈশিষ্ট্য পুলিশকে নাগরিকের কাছে আসতে দেয় না, কারণ জনতার পুলিশ হতে গেলে পুলিশকে ঐ সব প্রিভিলেজ খোয়াতে হবে। 


    যেখানে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে যাওয়া যাক। পুলিশকে সমাজকর্মীর ভূমিকায় দেখতে চাইলে সেটার জন্য আওয়াজ আমাদেরই তুলতে হবে, কোনও রাজনৈতিক দল তা কখনওই তুলবে না। সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমাতে গেলে, আইন ও ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে পুলিশকে দূরে রাখতে গেলে, পুলিশের হাতে লাঠি-বন্দুক-কাঁদানে গ্যাসের চেয়েও অনেক বেশি দরকার, পুলিশকে ভাবতে শেখানো, যে তাদের মূল দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি জনসাধারণের কাছে। এ এক নতুন রাজনীতি, রাজনৈতিক দলের কোল থেকে তা বের হবে না।

     

    লেখক আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
     


    অশোক সরকার - এর অন্যান্য লেখা


    আধুনিক রাষ্ট্র,কল্যাণ, উন্নয়ন আর ন্যায়ের তত্ত্ব আর তথ্য দিয়ে সে সমাজকে বোঝা যাবে না।

    কৃষকদের গণ-আন্দোলনেই জনতার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলের স্লোগানে নয়।

    পুলিশকে গণতান্ত্রিক শাসনের অঙ্গ হতে গেলে, জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক কী হবে এই প্রশ্নটা বড়ই জরুরি

    দলের পুলিশ না জনগণের পুলিশ?-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested