×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • মুমূর্ষু লেনিন: ইতিহাসের বদলা ১০০ বছর পর

    রজত রায় | 08-04-2022

    ছবিতে লেনিনের সঙ্গে তাঁর ভগিনী আনা এবং চিকিৎসককে দেখা যাচ্ছে।

    সোশাল মিডিয়ায় লেনিনের এই ছবিটি এখন প্রবলভাবে চর্চিত। দাবি করা হয়েছে, এই ছবি তোলার সময়কাল 1923 সালের মে মাস। তার আগে মার্চেই লেনিনের তৃতীয়বারের মতো সেরিব্রাল স্ট্রোক হয় এবং তাঁর শরীরের একটা দিক পক্ষাঘাতে অসাড় ও বাকশক্তি দুর্বল হয়ে যায়। ছবিতে লেনিনের সঙ্গে তাঁর ভগিনী আনা এবং চিকিৎসককে দেখা যাচ্ছে। লেনিনকে দৃশ্যতই খুব অসুস্থ দেখাচ্ছে ছবিতে। মনে রাখতে হবে, 1918 সালে লেনিনকে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল। ফ্যানিকাপলান নামে সোশাল রেভল্যুশনারি দলের এক সদস্যা তাঁকে প্রকাশ্যে গুলি করে। দুটি গুলি লেনিনের গায়ে লাগে। একটি গুলি কাঁধে বিঁধে থাকে, আর একটি ঘাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। এরপর 1922 সালে লেনিনের প্রথমবার স্ট্রোক হয়, এবং দীর্ঘদিন রোগভোগের পর 1924 সালের জানুয়ারিতে মাত্র 53 বছর বয়সে লেনিনের মৃত্যু হয়।

     

    তার প্রায় 100 বছর পরে লেনিনের ওই অসুস্থ চেহারার ছবি দেখে 1300-এর বেশি মন্তব্য জমা পড়েছে। সেই সব মন্তব্যে এক নজরে চোখ বোলালে বোঝা যায়, ইউরোপের এখনকার প্রজন্মের অধিকাংশই আর অক্টোবর বিপ্লব, লেনিন-স্তালিন আবেগে ভাসে না, বরং তারা রুশ বিপ্লব ও বিপ্লবীদের প্রতি প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। 1300 লোকের মন্তব্য পড়ে এই রকম একটা সিদ্ধান্তে আসা কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে কারও কারও মনে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু 1991 সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিলোপ এবং তারপরে রাশিয়া সহ ওই সব দেশে যেভাবে চরম দক্ষিণপন্থী স্বৈরতন্ত্র মাথা তুলেছে, তার বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের প্রতিরোধ করতে তেমন দেখা যায় না। তাই এটা ধরে নিতে অসুবিধা হয় না যে, ইউরোপে রুশ বিপ্লবের প্রতি আবেগ এখন অনেকটাই ম্লান। কিন্তু তাই বলে বিপ্লবের স্মৃতি ম্লান নয়। বরং, তার বিপরীত আখ্যান এখন সোচ্চারে গলা তুলছে। যেমন, একজন মন্তব্য করেছেন, এই মানুষটিই রোমানভ পরিবারকে (জার ও তাঁর পরিবার) হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল। এখন আশা করি সেনিজের কর্মফল ভোগ করছে। আর একজনের মন্তব্য, খুব শিগগিরই লেনিনের নরকবাসের 100 বছর পূর্ণ হবে। আর একজন বলছেন, এই মানুষটাকে নিয়ে বলার কিছু নেই। কারণ, এর জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ গেছে।কেউ বা বলছেন, ইতিহাসে অনেক দানবের কথা রয়েছে। লেনিনও তাদেরই একটি। কারও মতে, লেনিন নরকে যাওয়ার পরে দুনিয়াটা অনেক বাসযোগ্য হয়েছে আবার একজনের মন্তব্য, পুতিনকে আর ক'বছর পরেই লেনিনের মতো দেখাবে। অজস্র নেতিবাচক কটাক্ষের মধ্যে কয়েকটি ইতিবাচক মন্তব্যও আছে। একজন গ্রিক বলছেন, লেনিনের জীবন ছিল মহান, তাঁর স্বপ্নও তাই। সালাউদ্দিন আহমেদ (সম্ভবত বাংলাদেশি) লেনিনকে এই বিশ্বের অন্যতম মহান ব্যক্তি বলে মনে করেন। আরও একজন তাঁরই সুরে সুর মিলিয়েছেন। একজন আবার রুশ বিপ্লব সম্পর্কে সলঝেনিৎসিনকে উদ্ধৃত করে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষের ঈশ্বরকে ভুলে থাকার পরিণতি এটা।

     

    ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ- লেনিন 

     

    লেনিনের ওই ছবি দেখে এরকম অসংখ্য মতামত আসতে থাকায় একটা কথা স্পষ্ট, রুশ বিপ্লবের অভিঘাত ইউরোপের সামাজিক চেতনায় ভাল মতন শিকড় গেড়ে রয়েছে। তবে এই চেতনা বহুমাত্রিক, অনেক সময়েই বিপ্লবের বিরুদ্ধে। গত তিন দশকে খোদ রাশিয়াতেই বিপ্লবের বিরুদ্ধে যে সব প্রতিক্রিয়া দানা বেঁধেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু'টি বিষয় নিয়ে এই প্রসঙ্গে সংক্ষেপে আলোচনা করলে বিষয়টা বোঝা সহজ হতে পারে।

     

    এর প্রথমটি হল, জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বলশেভিকদের হাত রাজরক্তে রাঙানো। আর দ্বিতীয়টি হল বলশেভিকরা ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ায় হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন গ্রিক অর্থোডক্স চার্চকে (যার অনুগামী দেশের 70 শতাংশ মানুষ) কঠোর হাতে দমন এবং ওই ধর্মানুরাগীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা।

     

    লেনিনের ছবিটি দেখে প্রথম যে মন্তব্য এসেছে, তাতে জারকে সপরিবারে হত্যার জন্য লেনিনের ভূমিকার কথা রয়েছে। এখানে বলা দরকার, বিপ্লবের পরে পরেই বলশেভিক সরকারকে একাধিক ফ্রন্টে প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। বলশেভিকদের হাতে বন্দি জারকে মুক্ত করে তাঁর পতাকার তলায় আবার রাশিয়াকে সুসংহত করার একটা চেষ্টা অবশ্যই ছিল। তাই শত্রুপক্ষের বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসছে দেখে তড়িঘড়ি জার নিকোলাস ও তাঁর স্ত্রী, পুত্র, চার কন্যাকে দ্রুত হত্যা করার তাগিদ বলশেভিকদের থাকতেই পারে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে, জারের পরিবারের সঙ্গে লেনিনের ব্যক্তিগত হিসেবনিকেশ মেটানোর ব্যাপারও অনেক আগে থেকেই ছিল। লেনিনের দাদা আলেকজান্ডার উলিয়ানভ ঊনবিংশ শতাব্দীর রাশিয়ায় সক্রিয় সন্ত্রাসবাদী দল নারোদনিয়া ভলিয়ার সদস্য হিসাবে জার তৃতীয় আলেকজান্ডারকে হত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়েন ও তার ফাঁসি হয়। লেনিনের বয়স তখন 16 বছর। তার তিন দশকেরও সামান্য পরে 1917 সালে জার নিকোলাস সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তারপরে 1918 সালে বলশেভিক সরকারের নির্দেশে বন্দি অবস্থায় জারকে সপরিবারে হত্যা করা  হয়।

     

    গ্রিক অর্থোডক্স চার্চকে রাশিয়ার জাররা বহু শতাব্দী আগেই প্রধান ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করেছিল। রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে যে পারস্পরিক জোটের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা উভয়কেই রাশিয়ার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে রাখতে সাহায্য করে চলে। অথচ বলশেভিকরা ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রকে নিরীশ্বরবাদী এবং কঠোর ভাবে ধর্মাচরণের বিরোধী করে তোলে। লেনিনের সময় থেকেই এটা শুরু, স্তালিনের সময় তা আরও বাড়ে। ফলে, বহু চার্চ ধ্বংস করা হয়, চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়, ধর্মযাজকরা কারাবন্দি হন এবং অনেককেই হত্যা করা হয়। ফলে রাশিয়ার ধর্মানুরাগীরা প্রকাশ্যে উপাসনা করার বদলে যাবতীয় ধর্মাচরণকে গোপনীয়তার আড়ালে নিয়ে যান। শুধু হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করার পরে রাশিয়ার সমগ্র জনগণকে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সংগঠিত করতে চার্চের উপর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল করা হয়। সরকারি দৈনিক প্রাভদার প্রথম পাতায় স্তালিনের সঙ্গে চার্চের প্রধানের ফটো ছাপা হয়। এরপরেও সত্তরের দশক পর্যন্ত দফায় দফায় চার্চের উপর কড়া নিয়ন্ত্রণ বসেছে। শেষে 1991 সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে আবার চার্চের দরজা খুলে যায়, অনেক নতুন চার্চ তৈরি হয়। উরাল অঞ্চলের একাতেরিনাবার্গ শহরের যে বাড়িতে জারকে সপরিবারে 78 দিন আটকে রাখার পরে 1918 সালের জুলাইয়ে মেরে ফেলা হয়, সেখানে নিয়মিত জার ভক্ত মানুষ যেত। মজার ব্যাপার, স্তালিনের আমলে এক সময় সেই বাড়িতে নিরীশ্বরবাদীদের জন্য মিউজিয়ম করা হয়েছিল। পরে সেই বাড়িটি 1977 সালে ভেঙে ফেলা  হয়। সেখানে 2003 সালে নতুন একটি চার্চ হয়েছে, নাম— Church of all Saints বা Church on blood এবং জার নিকোলাসকে ও তার পরিবারের নিহত সব সদস্যকে চার্চ থেকে সন্তের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে ঠিক যে জায়গায় জার নিকোলাসকে হত্যা করা হয়েছিল, সেই জায়গাটাও চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। স্তালিনের আমলে ধর্মানুচরণ এবং নিহত জারের পরিবারে বিষয়ে প্রকাশ্যে চর্চা করা যেত না। তবু রুশিরা অনেকেই গোপনে চার্চ ও জারের পতাকার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে এসেছে।
     

    একাতেরিনাবার্গে জার হত্যার স্মরণে তৈরি Church on blood

     

    এখন প্রতি বছর 16 জুলাই (জার হত্যার তারিখ) রাশিয়ায় মহা ধুমধাম করে জার দিবস পালন করা হচ্ছে। 2018 সালের 16 জুলাই  চত্বরে লক্ষ মানুষ জড়ো হয়েছিল। পুতিন নিজেও 2003 সালে ওই চার্চে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছে। কারণ, পুতিনের মতো রাষ্ট্রের কর্ণধারদের এখন রাশিয়ার সাধারণ মানুষকে নিজেদের সঙ্গে পেতে জারের স্মৃতি ও চার্চের ধর্মাবেগের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হচ্ছে। যেমনটা অতীতে জারের আমলে হত। অর্থোডক্স গ্রিক চার্চের সক্রিয় উৎসাহে এই আবেগ রুশিচিত্তকে একটা উচ্চমনস্ক স্বতন্ত্র দেশের স্বপ্ন দেখায়। বলাই হয়, রাশিয়ার পরিচয় ইউরোপ বা এশিয়ার অন্তর্গত হয়ে নয়। রাশিয়া একেবারেই স্বতন্ত্র। অতীতে এই জাত্যাভিমান ও জাতীয়তাবাদকে উস্কে বারবার রুশি সাধারণ মানুষদের রাষ্ট্রের পতাকার তলায় জড়ো করা হয়েছে। এখন আবারও হচ্ছে। বরং পুতিনরা তো জারের সাম্রাজ্য থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহত্তর পরিসরকে একই কর্মধারার সূত্রে বাঁধা দেখতে এবং দেখাতে চায়। জার নিকোলাস, লেনিন ও স্তালিন— তিনজনেই এই আখ্যান অনুযায়ী রুশ দেশের মহান নেতা।

     

    রাশিয়াকে এঁরা বিশ্বের মধ্যে প্রবল শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। পশ্চিমি পিঠ চাপড়ানিতে মাথা ঘুরে গিয়ে গরবাচেভ গোটা রাশিয়াকেই দুর্বল করে দিয়েছেন। রাশিয়াকে আবার আগের জায়গার স্বপ্ন ফেরি করছেন পুতিন। ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করার পরে প্রথম টেলিভিশন বক্তৃতায় পুতিন এই ভাবনারই প্রতিধ্বনি করে বলেন, জারের আমল ও সোভিয়েত আমলের ভৌগোলিক মানচিত্র আবার ফিরে পেতে হবে। রাতারাতি বৃহৎ শক্তির মর্যাদা হারানোর ক্ষোভে রুশিরা আবারও স্তালিনের মতো একজন কড়া শাসককে চাইছেন। স্তালিনের স্মৃতি সেজন্যই এখন প্রবল জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। পুতিনও সেই পথেই হাঁটতে আগ্রহী। আর সেখানে জারের সঙ্গেই লেনিন স্তালিনের একটা সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে রুশ জনমানসে। অতীত রক্তপাতের অন্তত 100 বছর পরে হলেও।

     

    ছবিতে বামদিক থেকে লেনিন, জার নিকোলাস ও জোসেফ স্ট্যালিন

     

    মস্কোর রেড স্কোয়ারে ক্রেমলিনের দেওয়ালের গায়ে এখনও লেনিনের মরদেহ শায়িত, প্রতিদিনই বহু তীর্থযাত্রী সেখানে ভিড় করেন। এবার একাতেরিনবার্গে জারের বধ্যভূমিতে মাথা তোলা চার্চে ভক্তসমাগম শুরু হয়েছে। তৈরি হচ্ছে নতুন তীর্থক্ষেত্র। জার নিকোলাস, লেনিন ও স্তালিনের ত্রয়ীকে নিয়ে রুশ অর্থোডক্স চার্চের নতুন ট্রিনিটি  গড়ে উঠল বলে।

     


    রজত রায় - এর অন্যান্য লেখা


    এই অবস্থায় দেখার, সরকার কত দ্রুত মানুষকে দোরগোড়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

    করোনা মহামারীর সুবাদে ভারতের শহর ও গ্রামের মানুষ নতুন আর একটা কথার সঙ্গে পরিচিত হল - লক ডাউন।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি বাহিনীর ইহুদি গণহত্যা শুরু হয়েছিল ইউক্রেনের এই বাবি ইয়ারেই!

    বাংলায় বিজেপির পরাজয়ে উজ্জীবিত বিরোধী শিবির নয়া উদ্যমে মোদী বিরোধিতায় শান দিচ্ছে।

    80 কোটি দেশবাসীকে তিন মাসের রেশন বিনা পয়সায় দিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। 

    করোনার বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই অসংগঠিত। নির্দিষ্ট পন্থার বদলে একাধিক পরস্পরবিযুক্ত বা পরস্পরবিরোধী

    মুমূর্ষু লেনিন: ইতিহাসের বদলা ১০০ বছর পর-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested