প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ জাতীয় জীবনে মহীরুহ পতনের সামিল। বাঙালির গর্বের ভাণ্ডারে শূন্যতা বৃদ্ধি। প্রণববাবু তাঁর সুদীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন। সংকটকালে দল এবং সরকারের বিপত্তারণ হয়েছেন। জীবনের উপান্তে পৌঁছে প্রথম বাঙালি হিসাবে রাষ্ট্রপতির আসনেও বসেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি বারবার সুযোগ আসা সত্ত্বেও। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রায় অভিন্ন জীবন এবং রাজনৈতিক জীবনের নানা চড়াই-উতরাই এবং জনমানসে চর্চিত নানা প্রশ্ন নিয়েই www.4thpillars.com মঙ্গলবার, 1 সেপ্টেম্বর একটা আলোচনার আয়োজন করে। উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী এবং জয়ন্ত ঘোষাল— যাঁরা সুদীর্ঘকাল প্রণব বাবুকে কাছ থেকে দেখেছেন। আলোচনায় প্রণব বাবুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দুই অতিথিই চমকপ্রদ কিছু তথ্য দর্শকদের সামনে উপস্থিত করলেন।
1) দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলানো প্রণব বাবু নিশ্চয়ই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসতে চেয়েছিলেন। তিনবার তাঁর কাছে সেই সুযোগ এসেছিল। কিন্তু বিবিধ কারণে প্রণব বাবুর আর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি। দেশের প্রশাসনিক প্রধান না হতে পারার যে বেদনা, সেটা প্রণববাবুর থেকেই গেল। যদিও 2012 সালে দেশের সাংবিধানিক প্রধান হয়ে তাঁর খানিকটা হলেও সেই কষ্টের উপশম হয়েছিল।
2) 1984 সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর দলের অন্দরে প্রণব-বিরোধীরা দাবি করেছিল, প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হতে চান। তারা আরও দাবি করেছিল, এই নিয়ে কলকাতা থেকে দিল্লি আসা বিমানে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে প্রণব বাবুর কথা কাটাকাটি হয়েছিল। কিন্তু প্রাক্তন আমলা পি.সি আলেকজান্ডার এবং ক্যাবিনেট সচিব রাও তাঁদের বক্তব্যে এটাকে খণ্ডন করেছিলেন। প্রণববাবুও তাঁর আত্মজীবনীতে এমন কোনও ঘটনার কথা স্বীকার করেননি।
3) প্রণব বাবু গুলজারিলাল নন্দের উদাহরণ টেনে ক্যাবিনেটের প্রবীণতম সদস্যকে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী করার কথা বলেছিলেন। রাজীব গান্ধী যে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা সেই বিমানেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শোকবিহ্বল গান্ধী পরিবারের এই নিয়ে একটা দ্বিধা ছিল। এদিকে রাষ্ট্রপতি জৈল সিং-ও তখন বিদেশ সফরে। প্রশাসনিক অচলাবস্থা এড়াতে কংগ্রেসকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হত। প্রণব বাবুই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝিয়ে রাজীবকে রাজি করান।
4) বাঙালি বলেই প্রণব মুখোপাধ্যায় দেশের শীর্ষপদ পাননি, এটা বলা বোধহয় বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তবে এটা ঠিক, বাঙালি যখনই দিল্লির রাজনীতিতে কোনও নীতিনির্ধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে গেছে, তখনই নানা দিক থেকে বাধা এসেছে। প্রণব বাবুও তার ব্যতিক্রম নন।
5) অরুণ নেহরুদের গোষ্ঠীটা চেয়েছিল রাজীব গান্ধীকে তাদের মতো পরিচালনা করতে। সেটা হয়তো প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজীব-ক্যাবিনেটে থাকলে সম্ভব হত না। তাই প্রধানমন্ত্রী রাজীবের কাছে প্রণব সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। শেষমেশ প্রণব কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু তারপরেও প্রকাশ্যে রাজীব গান্ধীর নাম করে তিনি কোনও খারাপ কথা বলেননি। শুধু আকারে ইঙ্গিতে বলতেন, ম্যানেজাররা সরকার চালাচ্ছে। ইঙ্গিতটা হয়তো অরুণ নেহরুদের দিকে।
6) মনমোহন সিং-নরসিংহ রাওদের সংস্কারমুখী অর্থনীতির সমর্থক প্রণব বাবু ছিলেন না। ইন্দিরা মন্ত্রীসভার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী হিসাবে তিনি নেহরুবাদী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতেই ভরসা রাখতেন। হয়তো এই কারণেই আর কিছুটা প্রণব বাবুর অতীতে কংগ্রেস ত্যাগের জন্য সনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহন সিং-এর উপর আস্থা রেখেছিলেন। তবে 2012 সালে প্রণব যখন রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন, তখন সনিয়া গান্ধীর সঙ্গে তাঁর খুব ভাল বোঝাপড়া ছিল।
7) প্রণব বাবু তাঁর মেধা, পাণ্ডিত্য, যোগ্যতা নিয়ে দেশের রাজনীতিতে চাণক্যের ভূমিকা পালন করতেন। তাঁর নিজের যে একটা জনভিত্তি থাকাও দরকার, সেটা নিয়ে তিনি কখনও ভাবিত হননি।
8) প্রণব বাবু নিজে জননেতা ছিলেন না। জনমোহিনী (পপ্যুলিস্ট পলিটিক্স) রাজনীতির মানুষ প্রণব বাবু ছিলেন না। কিন্তু যে নেতা দেশ চালাবেন, তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন তিনি।
9) প্রণব বাবুর মাপের নেতা বা এমন কোনও বাঙালি নেই, যিনি আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে পারেন।
10) অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন উনিই প্রথম বিদেশি বিনিয়োগ দেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন।
11) প্রণব বাবু প্রচার বিমুখ ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা ক্রমাগত প্রচার করেছিলেন যে, উনি নাকি বাংলার অনেক প্রকল্প আটকে দিচ্ছেন। প্রণব বাবু সুস্থায়ী উন্নয়ন (sustainable development)-এ বিশ্বাসী ছিলেন। চমকের রাজনীতি তাঁর ধাতে ছিল না। অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন নিয়ম মেনে প্রত্যেকটা রাজ্যকেই সমান অর্থ সাহায্য করেছেন।
12) রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতায় বিশ্বাস করতেন না প্রণব বাবু। বাংলা কাগজ ভীষণ খুঁটিয়ে পড়তেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ভাল করে পড়েন যাতে ভুলগুলো সহজে ধরতে পারেন।
13) বর্তমান সময়ে যখন রাজনীতিতে নীতিহীনতা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে, ধর্মান্ধতা, জাতপাতের রাজনীতি, ব্যক্তিপ্রচার ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছে, সেখানে প্রণব বাবুকে ভীষণ প্রয়োজন ছিল। প্রণব বাবুর ন্যায়নিষ্ঠতার কারণেই ভাবীকাল তাঁকে স্মরণে রাখবে।
বিদেশ ও প্রতিরক্ষার মধ্যে দলীয় রাজনীতি আনার ফলেই স্বচ্ছতার অভাব।
পশ্চিমবঙ্গে এবারের ভোটে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন।
বিজেপির আধিপত্যবাদী, বিভাজনকেন্দ্রিক এবং পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে দ্বিধাহীন রায় দিল বাংলা।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন 2021 এর নায়ক এক এবং একমাত্র বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
দেশের শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার নাগরিক সমাজ। প্রতিবাদে সামিল কলকাতার শিল্পীরা।
এক টাকা আর 100 কোটি টাকার যোগসূত্র কোথায়?