×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • এক প্রাইভেট টিউটরের যন্ত্রণা

    তিয়াস বন্দ্যোপাধ্যায় | 22-03-2021

    প্রতীকী ছবি।

    সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী চন্দ্রা দাস ইদানিং স্লিম হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। দিনে একবার সে এইটুকু খায়, আর বাকি দিন গ্যাসট্রিকের ব্যথায় ছটফট করে। সপ্তাহে প্রায়দিনই অসুস্থতা হেতু পড়া কামাই। এদিকে সামনে মাধ্যমিক। পরিবারের চিন্তার শেষ নেই

     

     

    চন্দ্রার বাবা একটা ফ্ল্যাটবাড়ির কেয়ারটেকার। মা চার বাড়ি রান্না করে সন্ধে সাতটায় ফেরেন। অতএব, চন্দ্রা সারাদিন বাড়িতে একা, অবাধ স্বাধীনতা। সত্যি বলতে কী, বাবা মা কোনও অভাব রাখেননি। বাড়িতে সময় দিতে পারেন না বলে মেয়ে না চাইতেই সবকিছু জুগিয়ে চলেছেন

     

     

    তবু পড়াশোনায় কোনওদিনই উৎসাহ নেই চন্দ্রার। করোনার হাওয়া লেগে এখন তো আরওই নেই। যতই তাকে বোঝানো হোক, একজন নারীর স্বাবলম্বী হওয়া কেন আগে প্রয়োজন, তার যাবতীয় আগ্রহ কেবলই ওই স্মার্টফোনে। তার আজও ধারণা বইয়ে পাশাপাশি পাতায় রয়েছে মানেই রবিঠাকুর আর শঙ্খ ঘোষ একই সময়ের মানুষ। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের অধ্যায় তার মাথায় না ঢুকলেও মুসলিম সহপাঠীদের সম্পর্কে তার হুটহাট মন্তব্যে বেশ বোঝা যায়, সে ইতিমধ্যেই মুসলিম-বিদ্বেষী হয়ে পড়েছে। যেমন, জাপান দেশটি সম্পর্কে তার একটাই জ্ঞান। না, হিরোশিমা নাগাসাকি নয়! সে হল ‘জাপানি তেলসারাদিন চটুল গান, tiktok জোকস আর প্রেমের ব্যর্থতার কোটেশনে ভরা তার হোয়াটসঅ্যাপ স্টেটাসের দিকে চোখ গেলে বুকটা হু-হু করে ওঠে কৌশানি ম্যাডামের। তাঁর ছাত্রী হয়ে চন্দ্রা কীভাবে এসব করে চলেছে! সমস্তই যেন তাঁরই ব্যর্থতা। সারাদিন বিভিন্ন কাজের মধ্যে এই দুঃসহ ছাত্রীটির কথা ইদানিং কৌশানির মন তিক্ততায় ভরিয়ে তোলে। কিন্তু দিনের শেষে তিনিও একজন মাইনে করা ঠিকে পরিষেবাদাত্রী, যাকে বলে প্রাইভেট টিউটর। তাঁর আর জোর কতটুকু? শুরুতে ভেবেছিলেন আহা, পড়ার বইয়ের বাইরে অন্য কোনও বই কেউ কখনও চন্দ্রাকে কিনে দেয়নি বলেই বোধহয় পড়ার অভ্যেস তৈরি হয়নি। প্রথমবার ক্লাস নাইনের চন্দ্রাকে কিনে দিয়েছিলেন একটা ঈশপের গল্পের বই। সে বইটি ফেলে রেখে রেখে শেষমেশ গায়েব করে দেওয়ার পেছনে চন্দ্রার অজুহাত ছিল যে, ‘কঠিন’ ইংরেজি পড়তে অসুবিধে হয়। ক্লাস নাইনের একজন কিশোরীর কাছে ঈশপের গল্পের ইংরেজি যে কঠিন লাগতে পারে এমনটা ধারণার বাইরে ছিল কৌশানির। সেও তো সরকারি স্কুলেরই ছাত্রী ছিল একদিন। এ ক'বছরে সরকারি শিক্ষার মান এতখানি বদলে গেছে?!

     

     

    স্কুল বন্ধ থাকায় গত এক বছর যাবৎ মাধ্যমিকের ছ'জন ছাত্রীর পড়াশোনার সম্পূর্ণ ভার এসে পড়েছে কৌশানির ওপর। সাবজেক্ট একটা তো নয়, চার-চারটে! কৌশানির কাছে তারা পড়ে গোটা আর্টস গ্রুপ। অর্থাৎ, ল্যাঙ্গুয়েজ এবং হিউম্যানিটিস। কৌশানিরও তো টাকার দরকার। সে একজন ভাল শিক্ষিকা হবার সুবাদে অভিভাবকরা তাঁর কাছে মেয়েদের পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান। অগত্যা চন্দ্রার মতো দু-এক পিস ছাত্রীকেও পড়ানোর আবদারে রাজি হতে হয়। বয়সের ফারাক খুব বেশি না হলেও তাঁর কাছে ছাত্রীরা কন্যাসম। বয়ঃসন্ধির টানাপোড়েনে যাতে কেউ বিচলিত না হয়ে পড়ে, তাই কৌশানি আগেই ছাত্রীদের সবকিছু বুঝিয়ে রেখেছে। রিয়া, মৌ, সুলেমা, রুকসানা, পিউ সকলেই এখন ভাল রেজাল্ট করবে বলে রাতদিন পড়ছে। কিন্তু চন্দ্রার কথাটা আলাদা। যখন বোঝানো হয়, তখন ভাবগতিক দেখে মনে হয়, তার মতো বুঝদার এবং বুদ্ধিমান মেয়ে আর একটিও নেই। কৌশানি রোজ ভাবেন, এইবার বুঝি মেয়ের মতি ফিরল। ক্লাসগুলো আরও আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করেন, বলা ভাল বিশেষ করে চন্দ্রাকে মনোযোগী করাটাই তাঁর যেন একমাত্র চ্যালেঞ্জ!

     

     

    ওদিকে চন্দ্রা স্তিমিত চোখে মজা দেখে, তারপর ম্যাডাম পড়িয়ে চলে গেলেই মোবাইল হাতে বিছানায় উপুড়। প্রেমিক জুটছেনা তার এখনও! কেউ তাকে প্রোপোজ অবধি করল না এতদিনে! লম্বা-চওড়া শ্যামলা চেহারাই বুঝি এর জন্য দায়ী। এর চেয়ে ব্যর্থতা আর কীই বা হতে পারে? ম্যাম যতই যা-ই বলুন, তিনি কীভাবে বুঝবেন চন্দ্রার ‘দুঃখ!

     

     

    চন্দ্রার স্কুলের কি কোনও ভূমিকা নেই? কৌশানির মতে, এই ধরনের স্কুলের পরিবেশই শিক্ষার্থীর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এতদিন ধরে একটা মফঃস্বলি কো-এড স্কুলে পড়ে চন্দ্রা কেবল একগাদা গালাগালি এবং অপসংস্কৃতি শিখেছে। উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ওপরের ঘরে নিজেদের মধ্যে কী কী করে, সেই বিষয়ে অদম্য কৌতূহল এবং সেইসঙ্গে আফসোস, ক্ষোভ ইত্যাদি জমা হয়েছে তার শিশুমনে। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সেদিকে খুব একটা গা আছে বলে অবশ্য মনে হয় না। উক্ত স্কুলেই একটা বড় সময় ট্রেইনি টিচার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন কৌশানি। ওখানকার স্থায়ী শিক্ষকদের তিনি একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনারা কিছু শেখাননি ওদের?’ ভৌতবিজ্ঞানের শিক্ষক কমন রুমে ক্যারম খেলতে খেলতে হেসে উত্তর দেন ‘কী বলি বলুন! ওরা তো পড়া শোনেই না। কাদের পড়াব? যারা পড়তে চায় তাদের আলাদা করে প্রাইভেট টিউশন দিই।'

     

     

    এই পরিস্থিতি কিন্তু রাজ্যের অন্যান্য সরকারি কিংবা আধা সরকারি স্কুলগুলোর ক্ষেত্রেও খুব একটা আলাদা নয়। গ্রাম এবং মফঃস্বলের বেশিরভাগ সরকারি স্কুলের শিক্ষকই অনলাইন ক্লাস করাতে দক্ষ নন। গত বছর লকডাউনের সময় থেকে বহু স্কুলের সঙ্গেই তাই শিক্ষার্থীদের যাবতীয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু এদিকে চন্দ্রার মতো অনেক শিক্ষার্থীই স্মার্টফোন কিনে ফেলেছে স্যার-ম্যাডামরা এতে নোটস পাঠাবেন, এই অজুহাত দেখিয়ে। তারা বাড়িতে বলে ফোনের ডেটা ভরাচ্ছে পড়াশুনো করবে বলেই। আদতে ব্যাপারটা কতদূর গড়াচ্ছে সে বিষয়ে প্রশাসনের দূরদৃষ্টি ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। না হলে কি আর দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির সমস্ত পড়ুয়াদের অ্যাকাউন্টে ভোটের আগে দশ হাজার টাকা করে ঢোকে স্মার্টফোন কেনার জন্য? মুখ্যমন্ত্রী জানতেন স্মার্টফোন পেলেই সরকারি স্কুলের ছেলেমেয়েরা সবাই অনলাইন ক্লাস করতে পারবে। আর কি বা ভাবনা থাকতে পারে! কিন্তু শিক্ষিকা রিতা চক্রবর্তীর আক্ষেপ ‘কী করে আর পড়া হবে? স্মার্টফোন কিনলেই তো আর হল না। জেলাগুলোতে ইন্টারনেট পরিষেবা ঠিকমতো থাকতে হবে। কাকদ্বীপ, সুন্দরবনের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক পাওয়াই দুষ্কর। তাছাড়া অনলাইন ক্লাস করতে অনেকখানি ডেটা বা মোবাইল নেট খরচ হয়, বারবার রিচার্জ করাও সবার পক্ষে তো সম্ভব হয় না। সব ছাত্র-ছাত্রীকে না হলেও অন্তত কয়েকজনকে একসঙ্গে না পেলে পড়ানো যাবে না।'

     

     

    যেহেতু শিক্ষার আগে সুরক্ষা, তাই করোনা সংক্রমণের জেরে সেই যে বন্ধ হয়েছে সরকারি স্কুল, আজও পঠনপাঠনের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ নারাজ। শিক্ষা দপ্তর জানিয়েছে, দ্বিতীয়বার করোনার ঢেউ এসে পড়ায় আপাতত মে মাস পর্যন্ত স্পর্শ বাঁচিয়ে চলতে হবে। তাই যথারীতি আরও পিছিয়ে গেছে পুরোদমে স্কুল খোলার তারিখ

     

     

    অন্যদিকে বেসরকারি স্কুলগুলো বন্ধ থাকলেও জোরদার চলছে অনলাইন ক্লাস। শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ এবং বাঁধা নির্দেশ সেখানে জারি। বাড়ি থেকেই তাই পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা, স্কুল করছে নিয়মমাফিক। বছর কিন্তু থমকে থাকেনি বেসরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের। কলকাতার এক নামী বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা বনানী বসু জানালেন ‘স্কুল বন্ধ তো কী হয়েছে? প্রতিদিন ইউনিফর্ম পরে আমাদের ছাত্রীরা বাড়ি থেকেই ক্লাস করছে। হোমটাস্ক করে পাঠাচ্ছে। অনলাইন টেস্ট দিচ্ছে। অসুবিধে যথেষ্টই হচ্ছেকিন্তু তার জন্য তো আর পড়াশোনা থেমে থাকতে পারে না।' 

     

     

    সম্পূর্ণ উল্টো এই পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে বলে দেওয়া সহজ যে, সরকারি স্কুলে শিক্ষার মান তলানিতে। সেখানে পড়াশোনা এমনিও হয় না, অমনিও হচ্ছে না। অতএব প্রাইভেটে ভর্তি করানোই শ্রেয়। কিন্তু সেই সামর্থ্য না থাকলে? বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর মাসিক যা খরচ, তা হয়তো চন্দ্রার পরিবারের মাসিক আয়ের চেয়েও বেশি। সেই কারণেই পরবর্তী বৃহত্তর ক্ষেত্রে মেধা ও পরিণতির বিভাজনও আজকাল বেশি প্রকট। চাকরি ক্ষেত্রেও বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম বনাম সরকারি বাংলা মাধ্যমের দ্বন্দ্ব আজ দুই যুযুধান শিবির হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজ্যে। বৈষম্যের নীতি এবং ধনতন্ত্রের শাসন শৈশব থেকে শুরু করে আজন্ম এভাবে চোখ রাঙিয়ে আসবে বহু শিক্ষার্থীর জীবনে। কিন্তু অনেকে বলবেন, সরকারি স্কুল থেকে কি ভাল ছাত্র বেরোয় না? শিশুর প্রতিভা কি কখনও চাপা থাকে? এর উত্তরে খেদ প্রকাশ করে কলকাতার এক নামী সরকারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক রথীন সরকার বললেন, ‘সরকারি স্কুলে ভাল ঘরের ছাত্ররা এখন আর আসে কই! অধিকাংশেরই বাবা মা লেখাপড়া জানেন না। তাদের বাড়ির পরিবেশও ভাল নয়। স্কুলে এসে ছেলেরা অনেক সময়ই অসভ্যের মতো আচরণ করে, কিন্তু তাদের কড়া শাসন করলেই বিপদ অভিভাবকরা এসে বিশ্রী ঝামেলা করলে অহেতুক থানা পুলিশ হয়, তাছাড়া মন্ত্রীর ছেলেরাও পড়ে...বুঝতেই পারছেন। আমাদের হাত-পা বাঁধা। ওরা ওদের মতো থাকে, আমরা আমাদের মতো।' যদিও ছাত্রর প্রতিভা থাকলে তাকে একটু আধটু নজর যে দেওয়া হয়, সে বিষয়েও আশ্বস্ত করছেন সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা। অন্যদিকে পঠনপাঠন নিয়ে আদৌ খুশি নয় সরকারি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা। কলকাতার একটি আধা-সরকারি স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী আজমীরা জানাল, ‘একমাত্র বি.এড-এর স্যার ম্যাডামরা ট্রেনিং-এ এলেই আমাদের স্কুলে পড়া হয়। বাকি সময় স্কুলের স্যার ম্যাডামরা ক্লাসে এসে ফেসবুক করেন, নিজেদের বাড়ির গল্প করেন আর রিডিং পড়িয়ে চলে যান। ওতে আর কী পড়া হয়!’ অতএবপ্রাইভেট টিউশন ছাড়া গতি নেই। সে কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশের দাবি, তারা স্কুলে যাচ্ছে না তো কী হয়েছে, টিউশনে যাওয়া শুরু করেছে। প্রস্তুতি ঠিক হয়ে যাবে। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনেই। স্কুল কর্তৃপক্ষের নিশ্চয়ই আগে থেকে হিসেব করা আছেসিলেবাস শেষ হবে কী করে অথবা কীভাবে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা হবে গোটা একটা বছর ক্লাস বন্ধ থেকে! সেই নিয়েই কৌশানির মাথায় হাত। চন্দ্রার ভবিষ্যত নিয়ে স্কুল চিন্তিত নয়, চন্দ্রা তো নয়ই। কিন্তু কী করবেন কৌশানি ম্যাডাম? ফেল করতে দেখার চেয়ে মুখের ওপর বলে দেওয়াই ভাল; ‘সামনের মাস থেকে তোমাকে আর পড়াব না চন্দ্রা’, নাকি আর একবার চেষ্টা করে দেখবেন, যদি মেয়েটা শুধরোয় শেষ দুটো মাসে?


    তিয়াস বন্দ্যোপাধ্যায় - এর অন্যান্য লেখা


    ফেসবুক বা সোশাল মিডিয়ায় অনেক পুরুষের কাছে নারী মানেই সহজে সস্তায় পণ্য।

    অধার্মিক হওয়ার অনেক জ্বালা, ধার্মিকের দায় শুধু নিঃশর্ত আনুগত্যেই।

    পড়ুয়াদের মনের অতলে কী চলছে, তা জানতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকারি স্কুলগুলি।

    চিড়িয়াখানায় খাঁচার ভিতরের চেয়ে বাইরে বেশি আমোদ।

    সিঙ্গুরে মাস্টারমশাই সত্যিই তো ইতিহাস যে তালগোল পাকিয়ে দিলেন একেবারে।

    এক প্রাইভেট টিউটরের যন্ত্রণা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested