×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ভাইরাসের মিউটেশন স্বাভাবিক ধর্ম, ভাল-মন্দ দু’দিকেই যেতে পারে

    সুস্মিতা ঘোষ | 26-12-2020

    মিউটেশনের মাধ্যমে চরিত্র বদলাচ্ছে করোনা ভাইরাস

    করোনা-যুদ্ধে নতুন মোড় জাতীয় একটা শিরোনাম দিলে বোধহয় অনেক চমক সৃষ্টি করা যেত। ব্রিটেনে উদ্ভূত নতুন প্রজাতির কোভিড ভাইরাস নিয়ে অনেকে অবশ্য এটাই করছেন। গুজব, সরকারী ঘোষণা, ভ্যাকসিন কোম্পানির ঘোষণা আর বিজ্ঞানীদের নানা মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণ। কিন্তু নতুনটা কী হল? 


    নতুন আসলে কিছুই হয়নি। জেনেটিকমিউটেশন প্রকৃতির নিয়ম- সমস্ত জীবের মধ্যে ঘটে থাকে। মিউটেশনের ফল ভালও হতে পারে, খারাপও হতে পারেআবার একেবারেই কোনও বহিঃপ্রকাশ হল না, এমন ঘটনা ঘটে ভুরিভুরি। প্রকৃতির নিয়মে মিউটেশন ঘটে, আবার প্রকৃতিই চায় যে, মিউটেশনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে যেন তেমন ওলটপালট না ঘটে। সেইজন্যে যত উন্নত হবে জীব, তার জিনে, তার ক্রোমোজোমে তত জটিলতা। প্রুফরিডিং, সারাই-এর ব্যবস্থা, ক্রোমোজোমের মধ্যে মাইলের পর মাইল অর্থহীন জিন রাখা- এসবই প্রকৃতির নিজস্ব ব্যবস্থা। এই যে বললাম মাইলের পর মাইল- সত্যি সত্যিই মানুষের একটা মাত্র কোষে যত জিন থাকে-অর্থপূর্ণ এবং অর্থবাহী সবাইকে পাশাপাশি জুড়লে পৃথিবীকে কয়েক পাক দেওয়া যায়। প্রাকৃতিক মিউটেশনের সম্ভাব্যতা আসে ক্রোমোজোমের নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য অন্তর অন্তর সেখানে কী ধরনের জিন রইল, অর্থহীন না অর্থপূর্ণ- তাতে খুব একটা এসে যায় না। বরং গাদা গাদা অর্থহীন জিন থাকলে বেশিরভাগ মিউটেশন তাদের ওপরই হয়- মিউটেশনের ভাল বা খারাপ কোনও ফল চট করে নজরে আসতেই পারে না। এমনটাই হয় উন্নততর প্রাণীর ক্ষেত্রে। পরিবেশ ও জীবনযাত্রার কু-অভ্যাসে মিউটেশনের হার বেড়ে যায়- তখন অনেকের ডায়াবেটিস ধরে, ক্যান্সার হয়

    করোনা ভাইরাসের ক্রোমোজোম খুব ছোট্ট- সেখানে কোনও অর্থহীন জিনের কুশন বা বাফার নেই। ওদের প্রুফরিডিং-এর যন্ত্র নেই। কাজে কাজেই মিউটেশনের ফল বেশ তাড়াতাড়িই নজরে আসতে পারে। ফল ভাইরাসের পক্ষে ভাল হতে পারে, অর্থাৎ ভাইরাস তার আশ্রয়দাতার মধ্যে আরও গেড়ে বসতে পারে, আরও দ্রুতগতিতে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে, আরও অন্য প্রাণীকে আক্রমণ করার ক্ষমতা লাভ করতে পারে। ফল ভাইরাসের পক্ষে ক্ষতিকারকও হতে পারে। ভাইরাসের আক্রমণাত্মক ক্ষমতা কমে যেতে পারে, এমনকি হারিয়েও যেতে পারে। কিন্তু কী কী হতে পারে, ভাল হতে পারে, না খারাপ হতে পারে, হলে কী মাত্রায় হতে পারে এগুলো কিছুই জানা নেই। কোনও দিন অঙ্ক কষে এবং বাকি অন্য সমস্ত ধরনের বৈজ্ঞানিক তথ্য একত্র করে কোনও দিন ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে কিনা জানি না, কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা কেউ কিছুই জানি না। 

    হ্যাঁ, আমরা কেউ কিছুই জানিনা SARS- Cov2-র আরও কত মিউটেশন আসতে চলেছে। এটা একেবারেই নতুন ঘটনা নয়। বৈজ্ঞানিকরা এটার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না বলা চলে না, কিন্তু খুব কিছু তো করারও ছিল না। 


    তাহলে প্রশ্ন কী কী দাঁড়াল:-


    1) যুক্তরাজ্যের নতুন প্রজাতিই কি SARS - Cov2-র একমাত্র নতুন প্রজাতি?

     

    উত্তর- না। এর আগে নানা দেশে নানা মিউটেশন পাওয়া গেছে, দু’-এক ধরনের মিউটেশনকে বেশি মারাত্মক বলে মাঝেমধ্যে মনেও করা হয়েছে (যেমন শোনা যায় গুজরাতের অনেক কেসই নাকি মারাত্মক প্রজাতির) কিন্তু যথেষ্ট তথ্যের অভাবে ভারতে মারাত্মক নতুন প্রজাতির কাহিনি বেশি চলেনি। Wuhan থেকে উদ্ভূত ওই D614G মিউটেশন সারা পৃথিবীর সমস্ত কোভিড কেসের সিংহভাগ। 


    যুক্তরাজ্যের এই নতুন প্রজাতিটিতে অনেকগুলি মিউটেশন এক এক করে জমা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মিউটেশনের আধিক্য দেখা গেছে কোনও একটি ধরনের মিংকের মড়কে, এবং সেই মিউটেশনটিই পাওয়া গেছে কিছু কিছু কোভিড রোগীর মধ্যে, যাদের রোগ অনেক প্রলম্বিত হয়েছে, প্লাজমা থেরাপি কাজ করেনি। আরো দু’-একটি মিউটেশনের হয়তো কোনও তাৎপর্য আছে, আরও তথ্য হয়তো সে রহস্য উদ্ঘাটিত করবে। এ ছাড়া একটি মিউটেশন মানুষের নাক ও কন্ঠনালীর মধ্যে এই ভাইরাসকে আরও দৃঢ়ভাবে আটকে থাকতে সাহায্য করে। কিছু কিছু সেল কালচারে করা পরীক্ষা এবং কিছু রোগীর নাক ও শ্বাসনালীর মধ্যে ভাইরাসের সংখ্যা মাপার পর মনে করা হচ্ছে সংক্রমণের হার বাড়াতে এই মিউটেশনটির অবদান আছে। দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এই মিউটেশনটি পাওয়া গেছে, কিন্তু এর উৎস আলাদা। 
     


    2) নতুন প্রজাতি গুলি কি মারাত্মক? 

     

    উত্তর- এই প্রশ্নের কোনো ঢালাও উত্তর হয় না। যুক্তরাজ্যে পাওয়া প্রজাতিটি সম্বন্ধে এখনও পর্যন্ত যত তথ্য পাওয়া গেছে, তার থেকে সিদ্ধান্ত আসা গেছে যে, এই প্রজাতি আগের চেয়ে বেশি ছোঁয়াচে, কিন্তু বেশি মারাত্মক নয়, কারণ মৃত্যুহার এখন এপ্রিল-মে মাসের তুলনায় অনেকটাই কম।


    কিন্তু এরপরে আর কোনও মিউটেশন হবে না, এমন কথা তো কেউ হলফ করে বলতে পারে না। আরও মারাত্মক মিউটেশন আসতে পারে। যেমন আসতে পারে এমন মিউটেশন, যাতে এই ভাইরাস আর মানুষকে আক্রমণ করতেই পারবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই আশা শুধু মিছে ছলনা!

     


    3) এই সব মিউটেশনের পরও কি ভ্যাকসিন কাজ করবে? 


    উত্তর- ভ্যাকসিন এখনও কাজ করছে কিনা সেটাই জানা নেই। সবেমাত্র জোর করে গুঁতিয়ে ট্রায়াল শেষ করা হয়েছে, যাতে আস্তে আস্তে টিকাকরণ শুরু করা যায়। প্রসঙ্গত বলা যায়, ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের কিন্তু ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে করোনা রোগীর মুখোমুখি ছেড়ে দেওয়া হয়নি বিনা বাধায়। তারা মাস্ক এবং অন্য সাবধানতা অবলম্বন করেছেন এবং করেই চলেছেনকাজেই, কেউ যদি ভেবে থাকেন যে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরদিন থেকে বিনা মাস্কে বদ্ধ ঘরে দলবল জুটিয়ে পার্টি করলে কিস্যু হবে না, খুব ভুল করছেন। একপ্রস্থ করোনা যোদ্ধাদের দুটো কোর্স ভ্যাকসিন দেওয়ার অন্তত তিন-চার মাস বাদে বোঝা যাবে এই ভ্যাকসিন কতটা কার্যকরী। 


    যুক্তরাজ্যের নতুন প্রজাতির মিউটেশন পরবর্তী ভাইরাসের গঠন এবং কার্যপদ্ধতির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, যে ভ্যাকসিন Pfizer বা Moderna বা অক্সফোর্ড আনছে, তার কার্যকরী থাকতে কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু যতক্ষণ না কাজ করছে, ততক্ষণ আমরা কিছুতেই বলতে পারি না এটি কার্যকরী। এর মধ্যে BioNtech, Pfizer ভ্যাকসিনের আবিষ্কর্তা কোম্পানিটি দু দিন আগে বলেছে, নতুন UK (যুক্তরাজ্য) প্রজাতির ভাইরাসটির জন্য ভ্যাকসিন বানাতে সময় লাগবে মাত্র ছ সপ্তাহ। এই কথাটি অবশ্যই ভীষণ গোলমেলে। কটা সহজাত প্রশ্ন উঠে আসে1) তাহলে কি পুরনো ভ্যাকসিনের ওপর ওদের আস্থাই নেই (ওই জন্যেই কি Pfizer-এর CEO রাতারাতি নিজের শেয়ারের 80% ছেড়ে দিয়েছিলেন)?  2) সপ্তাহ কি ছেলেখেলা নাকি? ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে হবে না? 3) মাসে গড়পড়তা দুটো করে মিউটেশন তো অবশ্যম্ভাবী- নতুন মিউটেশনরা যদি বড়সড় গড়বড় করে? 


    কী বলি, এত শত ভেবে সত্যি কোনও লাভ নেই। এই ভারতের মহামানবের সাগরের কিছুতেই হাত নেই। ভাইরাসের মিউটেশনে না হয় কারও হাত নেই, কিন্তু কবে আপনার কাছে কার্যকরী ভ্যাকসিন পৌঁছবে, সত্যি সত্যি জানা আছে কি? নেতারা আসন্ন ভোটের মরশুমে অনেক প্রতিশ্রুতি দেবে, বিশ্বাস করে আশায় বুক বেঁধে শেষমেশ নিরাশ হবেন না তো?


    তার চেয়ে নিজের রক্ষার ভার নিজেই তুলে নিন না-চাচা আপন প্রাণ বাঁচা! মাস্ক পরা চালিয়ে যানপরতে অনীহা হলে কল্পনা করুন কেউ একজন খোলা মুখে যদি হ্যাঁচ্ছো করে আপনার মুখের ওপর হাঁচি ছড়িয়ে দেয়, কেমন হবে। সেই কল্পনায় দূরত্ব রক্ষাও চালিয়ে যান। এক বছর বাদেও স্ট্রাটেজি একই রয়ে গেল- break the chain. 

     

    (ড: সুস্মিতা ঘোষ ডায়াগনোরাইট-এর প্রতিষ্ঠাত্রী এবং জৈব-রসায়নবিদবিটস পিলানির পরামর্শদাত্রী। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো সুস্মিতার ডায়াগনোরাইট একটি সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত স্টার্ট-আপ সংস্থা, যার লক্ষ্য সকলের জন্য সুলভে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ডায়গনস্টিক্স)

     

     


    সুস্মিতা ঘোষ  - এর অন্যান্য লেখা


    ল্যাবরেটরিতে প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়ার মিউটেশন ঘটিয়ে সাফল্য আসলেও তার বাস্তবিক প্রয়োগ এখনও দূর

    দেশের সর্বত্র আইসক্রিম পাওয়া গেলে ভ্যাকসিন বণ্টনও অবশ্যই সম্ভব

    Covid-19 টেস্ট নিয়ে যা হচ্ছে তা কিন্তু কতটা বিজ্ঞানসম্মত তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

    মলদ্বারের ক্যান্সার নিরাময়ের সফল ওষুধ নিয়ে মাতামাতি কিন্তু সব ধরনের ক্যান্সারে প্রযোজ্য নয়

    স্বাধীনতার 75 বছরে অমৃতের সাগর কিনারে বসে বিষপানে মত্ত ভারত

    কোনও ঢাকা না থাকলে করোনা সোজা বর্ষিত হতে পারে মাথায়, মুখে, নাকে, হাতে

    ভাইরাসের মিউটেশন স্বাভাবিক ধর্ম, ভাল-মন্দ দু’দিকেই যেতে পারে-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested