×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়াতে কৃত্রিম মেধার ব্যবহার

    সুস্মিতা ঘোষ  | 19-05-2022

    নিজস্ব ছবি

    খাদ্য, অখাদ্য, এনজাইম ও জিন 

     

    ছাগলে কি না খায়! ছাগলে ঘাস খায়, কাগজ খায়, আমরা খেতে পারি না, বা খেলেও হজম করতে পারি না। তার কারণ, ঘাস বা কাগজের সেলুলোজ হজম করার এনজাইম মানুষের নেই, সেই এনজাইম সৃষ্টিকারী জিন কে মানুষের শরীর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে বিবর্তন। অর্থাৎ কিনা, কে কী খেয়ে হজম করে ফেলতে পারবে, সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে সেই খাদ্য বা অখাদ্যটি হজম করার মত এনজাইম খাদকটির আছে কিনা। আমরা অনেক সময়ে হজম না হলে বাইরে থেকে এনজাইম খেয়ে হজম শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করি। যাদের দুধ হজম হয় না, অর্থাৎ দুধের মধ্যে থাকা শর্করা ল্যাক্টোজ হজম হয় না, তাদের দুগ্ধজাত খাবারের সঙ্গে খেতে হয় ল্যাক্টেজ এনজাইম। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, এটা বেশ ঝামেলার ব্যাপার। এদের শরীরে যদি ল্যাক্টেজ উৎপাদক জিনটি ঠিক থাকত, তাহলে এত কষ্ট বা ঝামেলার মধ্যে যেতে হত না।

    হয়তো আপনি শুনেছেন, জিন তো সারানো যায়। অবশ্যই যায়।  কিন্তু মানুষের বা ছাগলের মত উন্নত প্রাণীর ক্ষেত্রে জিন সারানোর সাফল্য এসেছে মাত্ৰ কয়েকটি হাতে গোনা ক্ষেত্রে। তাও বহু বিজ্ঞানীর বহু প্রচেষ্টা, বহু অর্থব্যয়ের পর। তুলনা মূলক ভাবে জিন সারানো বা নতুন জিন ঢোকানো অনেক অনেক সহজ সাধ্য ব্যাকটেরিয়াতে। ব্যাকটেরিয়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব, অতি সহজ সরল তার গঠন। একটা প্রজন্ম আসতে সময় লাগে মাত্র পনের মিনিট। বিবর্তনের হার ও তাই মানুষের চেয়ে অনেক গুণে বেশি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এত বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া আছে এবং এত বিচিত্র পরিবেশে তারা জীবন যাপন করে, যে তাদের অনেকের মধ্যে অখাদ্য হজম করার এনজাইমও তৈরি হয়। কাজেই, বিজ্ঞান সম্মত ভাবে বলতে গেলে বলব, ছাগলে নয়, ব্যাকটেরিয়া কী না খায়!

     

    পেট্রল-খেকো ব্যাকটেরিয়া ও বাঙালি বিজ্ঞানী 

    ব্যাকটেরিয়ার এই কী-না-খায় গুণটার সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা আছে বর্জ্য পদার্থের নিকাশের বন্দোবস্ত করা এবং পরিবেশ দূষণ রোধ করাতে। বাঙালি যাঁরা বিজ্ঞানের খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা অনেকেই জানেন প্রয়াত বিজ্ঞানী আনন্দ মোহন চক্রবর্তীর নাম। আশি দশকের গোড়ায় তিনি সারা পৃথিবীতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন পেট্রোল খেকো ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করে। সমুদ্রের ওপর ভাসমান দূষণকারী পেট্রলের স্তরকে উধাও করার কার্যকারিতার পাশাপাশি আরো একটা কারণে এই হৈচৈ। তিনি প্রথম বলেছিলেন তাঁর আবিষ্কৃত জীব (অর্থাৎ জীবাণুকে) তিনি পেটেন্ট করতে চান। কোনো জীবকে এর আগে পেটেন্ট করা যেত না। তাঁর যুক্তি ছিল তাঁর আবিষ্কৃত জীবাণুটি প্ৰকৃতিতে পাওয়া যায় না, তিনি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর দ্বারা এটি "প্রস্তুত" করেছেন, সুতরাং এর মেধা স্বত্ব তিনি দাবি করতেই পারেনএর পর থেকে পেট্রোলিয়াম দূষণ রোধে সারা পৃথিবীতে, এমনকি ভারতেও ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয় এবং এই ব্যাকটেরিয়াগুলি নানাদেশের নানা বিজ্ঞানীর আবিষ্কার।

     

     

    পেট্রোলিয়াম জাত পদার্থের দূষণ 

    পেট্রোলিয়াম দূষণ যত বড় না আকারের, এই মুহূর্তে পেট্রোলিয়াম জাত পদার্থের, অর্থাৎ প্লাস্টিক দূষণ পৃথিবীর প্রধান সমস্যা গুলির একটা। এতই বড় সমস্যা যে মানুষের শিরা-ধমনীর রক্তধারাতেও প্লাস্টিক কণিকার অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। খুব দ্রুত সমস্যার সমাধান না হলে আমাদের নিজেদেরই অস্তিত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানা নেই। অবধারিত ভাবে প্রশ্ন ওঠে, ব্যাকটেরিয়া থেকে কিছু সমাধান পাওয়া যায় না? প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়া কি নেই? উত্তর হল অবশ্যই আছে। প্লাস্টিক বর্জ্য জমে থাকা মাটিতে প্রাকৃতিক বিবর্তন তাদের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু প্রকৃতির যে নিজস্ব ছন্দ বা গতি আছে , মানুষ তাকে বানচাল করে অনেক বেশি দ্রুত গতিতে এবং বেশি পরিমাণে উৎপাদন চালাচ্ছে- একে সাম্যাবস্থায় আনা প্রকৃতির সাধ্য নয়। মানুষকেই দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

     

    প্রকৃতিও চায় ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে দূষণ রুখতে : মিউটেশনের ব্যবহার 

    সমাধানের পথ কী কী বোঝার আগে বুঝতে হবে প্রকৃতি কীভাবে সমাধানের ব্যবস্থা করে।মানুষের প্রথম প্রেরণা বা ছাঁচ বা মডেল কিন্তু প্রকৃতিই

    আবার সেই খাদ্যাখাদ্যের প্রসঙ্গে যাই: যখন প্রচলিত খাদ্যের অভাব ঘটে, তখন জীব অখাদ্য খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। বেশিরভাগই মরে যেতে পারে, খালি পরিবেশের পক্ষে যে সবচেয়ে যোগ্য এবং উপযুক্ত সেই বেঁচে যায় (survival of the fittest)এটা ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রেও সত্যি। যখন কোনও ব্যাকটেরিয়া ক্রমাগতভাবে প্লাস্টিকের সংস্পর্শে রয়েছে, সত্যিকারের খাদ্যের অনটন চলছে, তখন তারা চেষ্টা করে কি করে প্লাস্টিক খেয়েও বেঁচে থাকা যায়। তখন তার জিনের মধ্যে মিউটেশন আসতে শুরু করে। করোনার দৌলতে আমরা সবাই জেনে গেছি, যে মিউটেশন পরিবর্তন আনে, সেই পরিবর্তনে কেউ হয় কমজোরি, কেউ হয় আরও সবল এবং সবল টিকে থাকে। প্রকৃতি নিজে কিন্তু এই মিউটেশনের হার খুব ধীরই রেখেছে। কিছু কিছু রাসায়নিক, এবং আল্ট্রা ভায়োলেট রে, এক্স রে, গামা রে ইত্যাদি আলোক বা তড়িৎচুম্বকীয় রশ্মি জিনে ভাঙা গড়া চালায়, এবং মিউটেশন ত্বরান্বিত করে। পরিবর্তন ত্বরান্বিত করে। এদেরকে বলা হয় মিউটাজেন (mutagen) 

    বিজ্ঞানীরা এইসব মিউটাজেন ব্যবহার করেন নিজের পছন্দমত পরিবর্তন আনার জন্যে। কিন্তু যেমন বলেছি, মিউটাজেন মিউটেশনের হার বাড়ায় মাত্র, কিন্তু ঠিক কোন জায়গায় মিউটেশন আনলে নিজের পছন্দের পরিবর্তনটি আনা যায়, সেখানে এদের কোনও ভূমিকা থাকে নাআবার কোন জায়গায় কোন মিউটেশন কী পরিবর্তন আনতে পারে, সেটা সম্বন্ধেও বিজ্ঞানীদের ধারণা সীমিত। কাজেই প্রাকৃতিক মিউটেশনের ওপর নির্ভর তো করতেই হয়। তারপরে জানা জিনের অংশ নিয়ে কাটা জোড়া করে চেষ্টা করা হয় প্রার্থিত জিনটি বানানোর, যে কিনা দেবে প্রার্থিত এনজাইম এক্ষেত্রে প্লাস্টিক খেকো এনজাইম।

     

    আরও পড়ুন:ওমিক্রন: আতঙ্কের কিছু নেই

     

    এইভাবেই গত দুই দশক ধরে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন নানা ব্যাকটেরিয়া যারা সত্যি সত্যি নানা রকম প্লাস্টিক খেতে পারে। কিন্তু কই প্লাস্টিক দূষণের সমস্যা তো দূর হল না।

    এর কারণ হল, এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের সাফল্য ওই টেস্ট টিউব পর্যন্তই। তাঁদের আবিষ্কৃত প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়াদের কারোর কাজ করতে লাগে 70 ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা, কারুর বা পঞ্চাশ ডিগ্রী। কোটি কোটি টন প্লাস্টিককে এভাবে খাওয়ানো যায়? 

     

    নতুন ও স্মার্ট পদ্ধতির মাধ্যমে নতুন ব্যাকটেরিয়া ডিজাইন 

    তবে হ্যাঁ, টেস্ট টিউবের মধ্যেও প্লাস্টিক ভক্ষণ কিন্তু ক্রমেই দ্রুততর হচ্ছে উন্নততর প্রযুক্তির সাহায্যে। ঠিক অমুক  অমুক জায়গায় এই এই মিউটেশন বসাতে হবে, যাকে বলে site directed mutagenesis, বহু দশকের পুরোনো পদ্ধতি। কিন্তু যেমন বলেছি, ঠিক কোন কোন জায়গায় কোন কোন মিউটেশন পেলে আমাদের পছন্দের গুণটি পাওয়া যাবে, আমরা এখনও সঠিক ভাবে বলতে পারি না। কিন্তু গত দেড় দশক ধরে একটা নতুন পদ্ধতিতে চেষ্টা করা হচ্ছে প্রার্থিত মিউটেশন গণনা করার। সেটা হল আকার বা গঠনের সাহায্য নেওয়া। সেটা এই ভাবে হয়: ধরা যাক আমি চাইব এমন একটি এনজাইম, যা PET প্লাস্টিককে ছোট ছোট অণুতে ভাঙার কাজ করবে। প্রাকৃতিক উপায়ে পাওয়া PET খেকো ব্যাকটেরিয়া থেকে যে এনজাইম পাওয়া যায়, তার গঠন বিশ্লেষণ করলে আন্দাজ পাওয়া যায় যে সে কীভাবে PET কে আঁকড়ে ধরে, এবং চিবানোর চেষ্টা করে। বিজ্ঞানীরা সেই মডেল থেকে গণনা করার চেষ্টা করেন, কীভাবে এই আঁকড়ে ধরাটা আরো কঠিন হয়, যাতে কাটার আগে  কিছুতেই পিছলে না বেরিয়ে যেতে পারে, এবং কাটাটা যেন এক কামড়েই খতম হয়। 

     

    আরও পড়ুন:   আজকের করোনা আর শতবর্ষে হর গোবিন্দ খুরানা

     

    সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ বিজ্ঞানী নানা এনজাইম নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। সবাই হয়ত প্লাস্টিক খেকো নিয়ে কারবার করেন না, কিন্তু এনজাইম এনজাইমই, যার একমাত্র কাজ হল রাসায়নিক বন্ড কাটা (কখনও কখনও জোড়াও)। অমুক এনজাইম এই ভাবে আঁকড়ে ধরে বা তুসুক এনজাইম এই ভাবে দাঁত বসায়, এই ধরণের বৈজ্ঞানিক তথ্যে এনজাইম ডেটাবেস দিনে দিনে সমৃদ্ধ হচ্ছে। কাজেই সেই ডেটাবেসের তথ্য ব্যবহার করে সঠিক গণনা করা ক্রমেই সহজসাধ্য হয়ে পড়ছে। 

    সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এমন একটি প্রবন্ধ নজরে এল। সেখানে এই রকম ডেটাবেস ব্যবহার করে AI (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স) এর দ্বারা এক PET খেকো এনজাইম ডিজাইন করা হয়েছে, যা এতদিন পর্যন্ত পাওয়া সব PET খেকো এনজাইম থেকে বেশি শক্তিশালী। এই পেপারটির বৈশিষ্ট্য হল AI এর ব্যবহার- যা থেকে মনে করা যাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে আর প্রকৃতি কি ডিজাইন করে দেবে তার ভরসায় হয়ত থাকতে হবে না, ডেটাবেস থেকে AI এর মাধ্যমেই সেই ডিজাইন করা সম্ভব হবে। 

     

    প্লাস্টিক দূষণ রোধ এখনও দূর অস্ত 

    অবাক হচ্ছেন, প্লাস্টিক দূষণের সম্বন্ধে কোনও আশার বাণী শোনালাম না বলে? কারণ এখানেও সাফল্য সেই টেস্ট টিউবের মধ্যেই। PET কে কুচি কুচি করে কাটতে হবে, বোতলের গলা ইত্যাদি শক্ত ক্রিস্টালের মত জায়গাগুলিকে গলিয়ে "সহজপাচ্য" করতে হবে, হ্যাপা অনেক। লক্ষ কোটি টনকে ম্যানেজ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। লক্ষ কোটি টনকে ম্যানেজ করা সেদিনই সম্ভব হবে, যেদিন বলতে পারব 

    " নিয়ে যাব ধাপা,

     দেব মাটি চাপা।

    সার হয়ে যাবি, 

    ঢ‍্যাঁড়শ ফলাবি 

    এর জন্য মাটিতে অবশ্যই PET খেকো ব্যাকটেরিয়া থাকতে হবে!

    তার আগে প্লাস্টিক ব্যবহার যত কম করা যায় ততই ভাল!

     

    (ড: সুস্মিতা ঘোষ ডায়াগনোরাইট-এর প্রতিষ্ঠাত্রী এবং জৈব-রসায়নবিদ। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের প্রাক্তন পোস্ট ডক্টরাল ফেলো। সুস্মিতার ডায়াগনোরাইট একটি সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত স্টার্ট-আপ সংস্থা, যার লক্ষ্য সকলের জন্য সুলভে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ডায়গনস্টিক্স।)

     


    সুস্মিতা ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    ভাইরাস তার নিজের কাজ করছে, মানুষও তাই করুক

    আত্মনির্ভর ভারত রাজনৈতিক স্লোগান মাত্র, বাস্তব চিত্র বলে দেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে আমদান

    স্বাধীনতার 75 বছরে অমৃতের সাগর কিনারে বসে বিষপানে মত্ত ভারত

    সংক্রমণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আর রোগের পরিসংখ্যানের তাৎপর্য বোঝে না সাধারণ মানুষ, সুযোগ নেয় মেডিক্যাল

    রতন টাটার আশীর্বাদধন্য Goodfellows সত্যিই কি বৃদ্ধদের সমস্যার মানবিক সমাধান?

    দেশের সর্বত্র আইসক্রিম পাওয়া গেলে ভ্যাকসিন বণ্টনও অবশ্যই সম্ভব

    প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়াতে কৃত্রিম মেধার ব্যবহার-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested